জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে দুনিয়ার কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি পাওয়া সম্ভব। জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন- ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ (সূরা আজ জুমার-৯)
ধূর্ত, চতুর, বুদ্ধি, জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা- এসব শব্দ প্রায় একই শ্রেণীভুক্ত হলেও অর্থের দিক দিয়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বুদ্ধি (সংস্কৃত) বোধ শব্দজাত। বোধ অর্থ জাগ্রত হওয়া, পর্যবেক্ষণ করা, মনোযোগ দেয়া বা সচেতন হওয়া। যিনি জ্ঞানকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কাজে লাগান তাকে বলা হয় ধূর্ত বা চতুর। সোনা দিয়ে পরিশোধনের মাধ্যমে অন্যান্য ধাতু বা অপদ্রব্য অপসারণ করে খাঁটি করা হয়; ঠিক সেভাবে যারা জ্ঞানকে মনোযোগসহকারে গভীর বিচক্ষণতার সাথে সঠিক পথে ব্যবহার করেন তাদের বলা হয় জ্ঞানী। জ্ঞানের পরিপক্ব রূপকে বলা চলে প্রজ্ঞা। এক কথায়, জ্ঞান ঠিক যেন একটি ক্ষুরধার হাতিয়ার, যার দ্বারা সফল অপারেশনের মাধ্যমে মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ রক্ষা করা যেমন যায়, তেমনি আবার নির্মমভাবে প্রাণ সংহারও করা যায়। ইসলামে জ্ঞান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেখানে জ্ঞানার্জন ও এর সঠিক ব্যবহার বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলামে জ্ঞানকে অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং জ্ঞানার্জনে বিভিন্ন উৎস পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে- ‘আর তিনি আদমকে বস্তুর নামসমূহ শিক্ষা দিলেন তারপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। আর প্রশ্ন করলেন, তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৩১)
সঠিক পথ দেখায় বলে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে জ্ঞান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। জ্ঞান মানুষকে বিভিন্ন কুসংস্কার ও ভুল ধারণা থেকে মুক্ত করে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে মানবজাতির উন্নয়ন ও কল্যাণে অবদান রাখে। কুরআন বিশুদ্ধ জ্ঞানের উৎস। কারণ, এটি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস হিসেবে বিবেচিত। এটি শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়; বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক। এতে মানবজীবন, মহাবিশ্ব সৃষ্টি, বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। জ্ঞান ছাড়া ঐশ্বরিক তথ্য, সৃষ্টিরহস্য উন্মোচন, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নির্দেশনা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ঐতিহাসিক ঘটনা শিক্ষা ও জানা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যে জ্ঞানীর চেয়ে বুদ্ধিমানের সংখ্যা বেশি- তাই শান্তির চেয়ে অশান্তি বেশি।
আল্লাহর পক্ষ থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ সা:-এর প্রতি প্রথম নির্দেশ ‘ইকরা’(পড়ো)। ‘পড়ো! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। পড়ো, আর তোমার প্রতিপালক মহাসম্মানিত। যিনি কলমের সাহয্যে শিখিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’ (সূরা আল আলাক, আয়াত-১-৫) ‘তিনি যাকে চান প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দেয়া হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দেয়া হয়। আর বিবেক সম্পন্নরা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সূরা বাকারা-২৬৯)
এখানে, প্রজ্ঞা অর্থ ‘হিকমাহ’। হিকমাহ বলতে বুঝায় প্রজ্ঞা, সঠিক বুঝ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জ্ঞানকে বোঝায়। যারা এ জ্ঞান লাভ করেন, তারা পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জীবনে কল্যাণ প্রাপ্ত হন। এ জ্ঞান শুধু তারা উপলব্ধি করতে পারেন, যাদের অন্তর পরিচ্ছন্ন।
জ্ঞান অর্থ-সম্পদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী বা উত্তম। কেননা, জ্ঞানী ব্যক্তিকে তার অর্জিত জ্ঞান পাহারা দেয়। কিন্তু অর্জিত অর্থ রক্ষা করতে পাহারা দিতে হয় তার অর্জনকারীকে। জ্ঞান হলো- শাসক আর অর্থ হলো শাসিত। অর্থ ব্যয় করলে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে আরো বাড়ে। ইসলামে, জ্ঞানের অনুসন্ধান করা নিরন্তর সংগ্রামের আওতাভুক্ত বলে বিবেচিত হয়। ইসলামী পণ্ডিতদের মতে, জ্ঞানার্জন একটি ইবাদত, অজ্ঞ ব্যক্তিকে জ্ঞান দেয়া সদকা আর উপযুক্ত ক্ষেত্রে তা ব্যয় করা আল্লাহর নৈকট্য লাভের কারণ। জ্ঞান হালাল-হারাম মানদণ্ড নির্ণয় করে। জ্ঞান, একাকিত্বের বন্ধু, নিঃসঙ্গতার সঙ্গী, সুখ-দুঃখের সাথী, চরিত্রের সৌন্দর্য এবং অপরিচিতের সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যম। কোনো মানুষ জ্ঞানী হয়ে জন্মগ্রহণ করেন না, তাকে জ্ঞানার্জন করতে হয়।
বিজ্ঞান অর্থ- পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লব্ধ বিশেষ জ্ঞান। ইসলামে বিজ্ঞানচর্চা উৎসাহিত করা হয়েছে। সেই সাথে ইসলামকে বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। জ্ঞান হলো মানুষের সেরা সম্পদ। সঙ্গত কারণে জ্ঞানীর কদর সর্বত্র। তাই জ্ঞানী ব্যক্তি যে কেউ হোন না কেন তিনি শ্রদ্ধার ও সম্মানের পাত্র। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সব মতাদর্শের মানুষের জন্য মূল্যবান। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মানুষ আলোকিত হয়। যেকোনো ব্যক্তি জ্ঞানী হলে, তাকে সম্মান করা উচিত। জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ একটি মানবিক গুণ এবং এটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য প্রযোজ্য। জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সমাজকে পথ দেখান, তাই তারা সম্মান পাওয়ার যোগ্য।
তবে এ কথা স্মরণযোগ্য যে, জগতের অর্জিত জ্ঞান মহাসমুদ্রের পানির তুলনায় এক আঙুলের মাথায় ধারণকৃত পানির চেয়েও কম। এ কথার উত্তর মেলে নিউরো সায়েন্টিস্টের কথায়ও, ‘মানব মস্তিষ্ক সর্বাধুনিক কম্পিউটারের চেয়েও কমপক্ষে ১০ লাখ গুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। ... মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ ক্ষমতা ব্যবহার করছেন। আর প্রতিভাবান ও সফল ব্যক্তিরা এ মস্তিষ্কের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ব্যবহার করেছেন।’ (কোয়ান্টাম মেথড, পৃষ্ঠা নং-২৩) জ্ঞান বিষয়ে স্যার আইজাক নিউটনের উক্তিও অভিন্ন, ‘আমরা যা জানি তা এক ফোঁটা, আর যা জানি না তা এক সমুদ্র।’ জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকা ভালো। কিন্তু জ্ঞান নিয়ে অহঙ্কার ভালো নয়। সব জান্তা মনোভাব না দেখিয়ে প্রয়োজনবোধে প্রকৃত জ্ঞানীর শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
সূরা কাহাফের ৬০ থেকে ৮২ নম্বর আয়াতে মুসা আ: এবং একজন জ্ঞানী ব্যক্তির মধ্যকার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ‘মুসা আ: নিজেকে জ্ঞানী মনে করেছিলেন এই ভেবে যে, তিনি ছাড়া আর কেউ বেশি জানেন না কিন্তু আল্লাহ তাকে এ ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দেন এবং তাকে এক ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে তার কাছ থেকে জ্ঞানার্জনের নির্দেশ দেন। ঘটনাটি ছিল এরকম : মুসা আ: যখন নিজেকে তাঁর সময়ের সবচেয়ে জানাশোনা ব্যক্তি ভাবছিলেন, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়, দুই সাগরের মিলনস্থলে একজন বান্দা রয়েছে যিনি তার চেয়েও বেশি জানে। আল্লাহর নির্দেশে মুসা আ:-কে সেই জ্ঞানীর কাছে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণের নির্দেশ দেন। যখন মুসা আ: সেই ব্যক্তির কাছে যান এবং তার সাথে বিভিন্ন ঘটনার সম্মুখীন হন, তখন তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর জ্ঞান সীমিত এবং ওই ব্যক্তির জ্ঞান অনেক গভীর।
এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া যায় যে, আল্লাহর কাছে জ্ঞানই চূড়ান্ত। মানুষের উচিত সবসময় বিনয়ী থাকা এবং নিজের জ্ঞান সীমিত বলে মনে করা। নিজেকে বেশি জ্ঞানী মনে না করে অন্যের কাছ থেকে শেখার মানসিকতা রাখা।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক



