সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষাচুক্তি

উম্মাহর ঐক্য পুনরুজ্জীবন হবে কি

মুসলিম বিশ্বের সমস্যা সামরিক সামর্থ্যের ঘাটতি নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। এটি না বদলালে, প্রতিরক্ষাচুক্তি ও শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাগুলো কেবল প্রতীকী হয়েই থাকবে।

সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালে ইসরাইল দোহায় হামলা চালানোর পর আরব ও মুসলিম নেতারা জরুরি সম্মেলন আহ্বান করেন। তারা ইসরাইলের ‘আন্তর্জাতিক আইনের প্রকাশ্য লঙ্ঘন’ নিন্দা করেন এবং কাতারের সংযমের প্রশংসা করেন; কিন্তু আগের মতোই যৌথ বিবৃতিতে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ ছিল না। সিএনএন একে বলেছিল, ‘শব্দে ভরা ঘোষণাপত্র’, আর এপি মন্তব্য করেছিল যে, বৈঠকটি ‘কোনো বাস্তব পদক্ষেপে পৌঁছায়নি।’ মাত্র তিন দিন পর সৌদি আরব ও পাকিস্তান নতুন প্রতিরক্ষাচুক্তি স্বাক্ষর করল। বিশ্লেষকরা সাথে সাথে জল্পনা শুরু করলেন : এটা কি ‘ইসলামিক ন্যাটো’র সূচনা? পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান কি উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য প্রতিরক্ষামূলক ছাতা হতে পারে?

ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। মুসলিম ঐক্যের নতুন যুগের সূচনা নয়; বরং এই ঘটনাগুলো দেখায় কিভাবে জাতীয়তাবাদ ও অভিজাত স্বার্থ ১৯৬৯ সালে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সমষ্টিগত পদক্ষেপকে দুর্বল করেছে।

আল-আকসা অগ্নিকাণ্ড থেকে ওআইসির অবক্ষয় পর্যন্ত

ওআইসি জন্ম নিয়েছিল এক সঙ্কট থেকে। ১৯৬৯ সালের আগস্টে জেরুসালেমের আল-আকসা মসজিদে আগুন লাগলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো মরক্কোর রাবাতে মিলিত হয়। তারা প্রতিশ্রুতি দেয়, ফিলিস্তিন রক্ষা করবে, জেরুসালেম মুক্ত করবে এবং রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে সহযোগিতা জোরদার করবে। নতুন সংগঠনটি এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করত এবং বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বলে মনে হচ্ছিল; কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি এসে সেই গতি হারিয়ে গেল। উচ্চ আদর্শে ভরা প্রস্তাবগুলো জমা হচ্ছিল; কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব প্রকট ছিল। শাসকশ্রেণী যখন ক্ষমতা ও বিশেষাধিকারে অভ্যস্ত হলো, তখন তাদের উদ্যম হারিয়ে গেল। ১৪০০ শতকের ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন সতর্ক করেছিলেন যে, রাজবংশগুলো কয়েক প্রজন্ম পর তাদের উদ্যম হারায়, যা অনেক মুসলিম জাতীয়তাবাদী এলিটের ক্ষেত্রেও সত্য।

জাতীয়তাবাদ : অস্ত্রও, ফাঁদও

২০শ শতকে জাতীয়তাবাদ ছিল ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার। মিসর, ভারত, আলজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নেতারা ‘দেশপ্রেম ঈমানের অংশ’ বাক্যটি একটি হাদিস হিসেবে উদ্ধৃত করতেন; কিন্তু এটি কোনো সহিহ হাদিসগ্রন্থে নেই। স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য এই বক্তব্য কার্যকর ছিল।

তবে ইংরেজ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি যুক্তি দিয়েছিলেন, জাতীয়তাবাদ সহজেই গোত্রপ্রীতিতে পরিণত হতে পারে, যেখানে জাতির প্রতি আনুগত্য সর্বজনীন নীতির উপরে স্থান পায়। উপনিবেশ-উত্তর মুসলিম বিশ্বে ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর নামে ঘরে দমননীতি ও বাইরে বিভাজন ন্যায্যতা পেয়েছে। পাকিস্তানের উদাহরণটি স্পষ্ট। তাদের সামরিক এলিট দীর্ঘ দিন ‘ইসলামী বোমা’-র ভাবমূর্তি ব্যবহার করেছে মর্যাদা অর্জনের জন্য; কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতি উপেক্ষা করেছে, সম্প্রতি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সাইডলাইন করে। জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করেছে; কিন্তু মুসলিম সংহতির বৃহত্তর লক্ষ্যকে দুর্বল করেছে।

সৌদি-পাকিস্তান চুক্তি : প্রচার নাকি বাস্তবতা?

এই প্রেক্ষাপটে, সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষাচুক্তিকে কিভাবে দেখা উচিত? কিছু বিশ্লেষক একে সম্ভাব্য ‘গেম চেঞ্জার’ বলে মনে করছেন। ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম একে ন্যাটোর সাথে তুলনা করেছে; সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় কর্মীরা একে ‘ভূমিকম্পসদৃশ পরিবর্তন’ বলেছেন।

অন্যরা বেশি সতর্ক। দ্য টাইমস অব ইসরাইল লিখেছে, সৌদি আরবের প্রকৃত লক্ষ্য ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ, সঙ্ঘাত নয়। হার্ভার্ড বেলফার সেন্টারের গবেষকরা বলেছেন, রিয়াদ ও ইসলামাবাদের মধ্যে দীর্ঘ দিনের সামরিক সহযোগিতা নতুন নয়- নতুন হলো কেবল আনুষ্ঠানিকীকরণ, রূপান্তর নয়। সংক্ষেপে, এই চুক্তিকে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রতিশ্রুতি নয়; বরং রাজনৈতিক সংহতির প্রতীক হিসেবে দেখা উচিত। ন্যাটোর অনুচ্ছেদ ৫-এর মতো ‘একজনের ওপর হামলা মানে সবার ওপর হামলা’ ধরনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নিশ্চয়তা বা বাস্তবায়ন ব্যবস্থা নেই।

বিশ্বাস, বাস্তববাদ ও ঐক্যের প্রশ্ন

মুসলিম জনসাধারণের জন্য মূল প্রশ্নটি নৈতিক। নবী মুহাম্মদ সা: বিশ্বাসীদের একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন : ‘দেহের এক অঙ্গ ব্যথা পেলে পুরো দেহ কষ্ট পায়।’ (সহিহ মুসলিম ২৫৮৬) অথচ আজ মুসলিম সরকারগুলো ইসরাইলের কর্মকাণ্ডে যৌথ পদক্ষেপ নয়, কেবল বিবৃতি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়।

অতীতের উদাহরণগুলোর সাথে তুলনা করলে পার্থক্য স্পষ্ট। ১৯৭৩ সালে সৌদি বাদশাহ ফয়সাল ইসরাইলের মিত্রদের বিরুদ্ধে তেল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অর্থনৈতিক শক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনীতি পাল্টে দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে তুরস্ক বন্দী ইসরাইলি গিলাদ শালিতের মুক্তিতে মধ্যস্থতা করে দেখিয়েছিল যে, শক্তি ব্যবহার না করেও বাস্তববাদী কূটনীতি কার্যকর হতে পারে।

আজকের নেতারা কেন দ্বিধাগ্রস্ত? কারণ জাতীয়তাবাদ তাদের অগ্রাধিকারকে অভিজাত টিকে থাকা ও পরাশক্তির সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির দিকে সরিয়ে নিয়েছে। বস্তুবাদী বাস্তববাদ যৌথ নীতির ওপর প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলাফল হলো সঙ্কটের সময় পক্ষাঘাত, যেমন গাজায় যুদ্ধ।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা

একটি বিষয় স্পষ্ট : মুসলিম ঐক্য কেবল শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্র বা প্রতিরক্ষাচুক্তির মাধ্যমে অর্জিত হয় না। এটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা দাবি করে, যা বিশ্বাসের ভিত্তিতে দাঁড়ায়- ইসলামী পরিভাষায় একে বলা হয় আমানাহ (বিশ্বাসযোগ্যতা)। ইসলামী ও অন্যান্য সভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছে যখন শাসকরা এই নীতি রক্ষা করেছেন প্রশাসন, বাণিজ্য ও ন্যায়বিচারে; আর এই নীতির বিশ্বাসঘাতকতা তাদের পতনের কারণ হয়েছে।

কুরআন এ বিষয়ে বলে : ‘নিশ্চয় আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের ভেতরের অবস্থা পরিবর্তন করে।’ (সূরা রা’দ : ১১) এবং সতর্ক করে : ‘তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্য গ্রহণ করেছে, সাহায্য পাওয়ার আশায়; কিন্তু তারা তাদের সাহায্য করতে পারবে না, যদিও তারা তাদের জন্য প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।’ (সূরা ইয়াসিন : ৭৪-৭৫)।

বর্তমান সঙ্কটও এক বৈপরীত্য উন্মোচন করেছে : যখন ওআইসি সরকারগুলো সতর্ক অবস্থান নিয়েছে, বৈশ্বিক নাগরিক সমাজ-দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা থেকে শুরু করে ইউরোপের শহরগুলোর প্রতিবাদ পর্যন্ত- ফিলিস্তিনের পক্ষে বেশি দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে।

আগামীতে নজর রাখার বিষয়

সৌদি-পাকিস্তান চুক্তি ‘ইসলামিক ন্যাটো’-তে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর প্রকৃত গুরুত্ব নিহিত রয়েছে পরিবর্তিত জোট ও ওআইসির সমষ্টিগত ভূমিকার ক্ষয়ে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যত বেশি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও অভিজাত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো তত বেশি অকার্যকর হয়ে পড়বে। মুসলিম বিশ্বের সমস্যা সামরিক সামর্থ্যরে ঘাটতি নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। এটি না বদলালে, প্রতিরক্ষাচুক্তি ও শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাগুলো কেবল প্রতীকী হয়েই থাকবে।

লেখক : ইস্তাম্বুল সেহির বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তুলনামূলক সভ্যতার অধ্যাপক