কোরবানি ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবাই করার আমল, যা প্রতি বছর ঈদুল আজহার সময় আদায় করা হয়। হজরত ইব্রাহিম আ:-এর মহান ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে প্রতি বছর মুসলমানরা কোরবানি দেন। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যেন তারা আল্লাহর দেয়া পশুর ওপর তাঁর নাম স্মরণ করে কোরবানি করে।’ (সূরা হজ, আয়াত ৩৪) অন্য সূরায় আল্লাহ বলেন, ‘অতএব আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করুন ও কোরবানি করুন। (সূরা কাওসার, আয়াত ২)।
রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ, ৩১২৩)
কোরবানির চামড়ার ব্যবহারবিধি
কোরবানির চামড়া শুধু পশুর একটি উপাদান নয়, এটি ধর্মীয় অনুশাসনের একটি অনুষঙ্গ, অর্থনৈতিক সম্পদ এবং সামাজিক কল্যাণের উৎস। এই কোরবানির পশুর চামড়া ব্যবহারের রয়েছে ইসলামী বিধান। চামড়া বিক্রির অর্থ নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করা জায়েজ নয়। এটি সদকা বা আল্লাহর পথে দান করার জন্য নির্ধারিত। গরিব-দুস্থ, মাদরাসা, এতিমখানা এবং কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে দান করা উত্তম। এমনকি এই চামড়া দিয়ে কসাইকে পারিশ্রমিক দেয়াও নিষিদ্ধ। রাসূল সা: বলেন, ‘যে কেউ কোরবানির পশু জবাই করে, তার পারিশ্রমিক কোরবানির কোনো অংশ দিয়ে দিও না।’ (সুনান আবু দাউদ)
কোরবানির চামড়া কোরবানিদাতা বিক্রি বা ব্যবহার করতে না পারলেও এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে। মাদরাসা ও এতিমখানাগুলো সাধারণত কোরবানির চামড়ার অর্থ দিয়ে বছরের একটি বড় অংশের খরচ চালায়। বাংলাদেশে যদি ইসলামী মূল্যবোধ বজায় রেখে চামড়া রফতানি বা চামড়াভিত্তিক শিল্প (লেদার গুডস, জুতা) গড়ে তোলা যায়, তাহলে প্রতি বছর পাঁচ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
বিভিন্ন দেশের কোরবানির চামড়ার দাম
দেশে প্রতি বছর ঈদুল আজহায় প্রায় ৮০-৯০ লাখ পশু কোরবানি হয়। তার মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ গরু এবং বাকিগুলো ছাগল, ভেড়া ও মহিষ। এতে উৎপন্ন হয় প্রায় দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার চামড়া। কিন্তু বাস্তবে এই চামড়ার প্রকৃত মূল্য পাওয়া যায় না। বছরভিত্তিক কোরবানি দেয়া গরুর সংখ্যা, গরুর দাম ও চামড়ার দামের ট্রেন্ড থেকে দেখা যায় প্রতি বছর কোরবানি দেয়া গরুর সংখ্যা বাড়ছে, দামও বাড়ছে অথচ কাঁচা চামড়ার দাম কমছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে মোট গরু কোরবানি হয় ৩৫ লাখ, যা ২০২৪ সালে বেড়ে হয়েছে ৫০ লাখ। একইভাবে ২০১৫ সালে গরুপ্রতি গড় দাম ছিল ৩৫ হাজার টাকা অথচ তা বেড়ে ২০২৪ সালে হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। পক্ষান্তরে, ২০১৫ সালে গড়ে প্রতি পিস গরুর চামড়ার মূল্য ছিল এক হাজার ২০০ টাকা যা ২০২৪ সালে কমে হয়েছে মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। অর্থাৎ ২০১৫ সাল থেকে গরুর দাম অনেকগুণ বেড়েছে অথচ চামড়ার দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। ২০২৪ সালে অনেক স্থানে চামড়া নষ্ট হয়েছে বা বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে।
২০২৪ সালের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের কয়েকটি মুসলিম, যেমন তুরস্ক, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ার কোরবানির চামড়ার গড় দাম এবং চামড়ার ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তুরস্কে কোরবানির চামড়ার গড় মূল্য ২০০ থেকে ২৮০ টাকা প্রতি বর্গফুট; সৌদি আরবে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা প্রতি বর্গফুট; মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি বর্গফুট ১৮০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানে প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য অনেক কম (৭০-১২০ টাকা বর্গফুট) অথচ সেই মূল্যও বাংলাদেশের কোরবানির চামড়ার মূল্যের (৩০-৫০ টাকা/বর্গফুট) চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
বিভিন্ন দেশে কোরবানির চামড়ার ব্যবস্থাপনা
অন্যান্য দেশের কোরবানির চামড়ার দাম অনেক বেশি হওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে তবে চামড়ার ব্যবস্থাপনা একটি অন্যতম কারণ। যেমন তুরস্কের কোরবানির চামড়া কেন্দ্রীয়ভাবে সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে, সৌদি আরব ওয়াকফ বা মসজিদভিত্তিক সংগৃহীত হয়, মালয়েশিয়ায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা নিয়ন্ত্রিত সংগ্রহ, ইন্দোনেশিয়ায় মসজিদভিত্তিক আয়োজন। অন্য দিকে পাকিস্তানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়। অথচ বাংলাদেশে চামড়ার ব্যবস্থাপনার কোনো নিয়মই নেই। দেশের বেসরকারি ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং অত্যন্ত বিশৃঙ্খল সংগ্রহ। প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ চামড়া প্রতি বছর পচে যায়। মধ্যস্বত্বভোগী ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে থাকা সিন্ডিকেট চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশের চামড়ার দামের পতনের নানাবিধ কারণের মধ্যে চামড়া সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের দুর্বলতার পাশাপাশি প্রক্রিয়াকরণে দুর্বলতা; মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য; সরকারি মূল্য নির্ধারণ কার্যকর না হওয়া; অনুৎপাদনশীল রফতানি নীতিমালা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দাম কমানো ইত্যাদি রয়েছে। সঙ্গত কারণেই চামড়ার যেমন অপচয় হয় তেমনি চামড়ার বেনিফিশিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়।
বিভিন্ন দেশের পশুর চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, যেমন সৌদি আরব, পাকিস্তান, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ায় তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে সংগঠিত। গরুর চামড়ার সৌদি আরব এবং পাকিস্তানে প্রক্রিয়াজাতকরণের হার যেখানে, যথাক্রমে ৯৫ শতাংশ এবং ৭০ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের হার মাত্র ৩০ ভাগ। এমনকি ওই সব দেশে রফতানিযোগ্য চামড়ার মানও বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য চামড়া মান থেকে অনেক ভালো। কাঁচা ও পাকা চামড়ার দামের ট্রেন্ড থেকে দেখা যায়, ২০১০ সালে দেশে গরুর কাঁচা চামড়ার গড় দাম ছিল এক হাজার ৬০০ টাকা। ২০২৪ সালে তা নেমে আসে ১০০-১৫০ টাকায়।
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পাকা চামড়ার চাহিদাও কমে গেছে। চীন, ইতালি ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের চামড়ার রফতানি ২০১৭ সালের পর ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অথচ বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার জুতার বাজার রয়েছে। তবে এখানে দেশীয় চামড়ার পরিবর্তে চীন ও ভারত থেকে আসা রাবার/সিন্থেটিক চামড়ার চাহিদা বেড়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে দেশীয় চামড়ার ব্যবহার ছিল ৮০ ভাগ এবং বিদেশী সিন্থেটিক চামড়ার ব্যবহার ছিল শতকরা ২০ ভাগ অথচ ২০২৪ সালে বিদেশী সিন্থেটিক চামড়ার ব্যবহার বেড়ে ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে। এতে স্থানীয় চামড়াশিল্প মার খাচ্ছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশে বহু ক্ষেত্রে কাঁচা চামড়া ভারতে পাচার হয়। ভারত ওই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করে লাভবান হয়। অথচ বাংলাদেশে কাঁচা চামড়ার কোনো মূল্যই থাকে না।
কোরবানির চামড়া নিয়ে রাজনীতি
বাংলাদেশে কোরবানির চামড়া মাদরাসা, এতিমখানা ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে দান করা হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ধরনের বহু প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরিচালনা ব্যয়ের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত আসত কোরবানির চামড়ার বিক্রয়মূল্য থেকে। কিন্তু ২০১৫-২০১৬ সালের পর থেকে চামড়ার দাম আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করে। এই কমার পেছনে রাজনীতি রয়েছে বলে বাংলাদেশের সমাজে বিশেষত ইসলামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও ধর্মীয় মহলে ধারণা রয়েছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে চামড়া বিক্রি না হওয়ায় তা ফেলে দিতে হয়েছে বা মাটি চাপা দিতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মাওলানা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘চামড়ার দাম ধসে পড়া একটি পরিকল্পিত অপচেষ্টা। এর মাধ্যমে কোরবানি-নির্ভর দারুল উলুমগুলোকে আর্থিকভাবে দুর্বল করা হচ্ছে।’ বাংলাদেশ জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মতে, ‘প্রতি বছর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাঁচা চামড়ার দাম কমিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিঃস্ব হচ্ছে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পর্যবেক্ষণে (২০১৯) উল্লেখ করে যে, কিছু বড় ট্যানারি মালিক সিন্ডিকেট করে কোরবানির সময় দাম কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে। প্রতি বছর ঈদের সময় কিছু নির্দিষ্ট ট্যানারি মালিকের একটি গ্রুপ কোরবানির দুই-তিন দিনের মধ্যে কাঁচা চামড়ার দাম কমিয়ে দেয় এবং পরে নামমাত্র দামে কিনে নেয়। এভাবে দাতাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। অনেক গবেষক মনে করেন, ধর্মীয় অনুদানের উৎসগুলোর কার্যক্রম একে একে বন্ধ করার কৌশল হিসেবে চামড়া বাজারে ধস নামানো হয়েছে।
কোরবানির চামড়ার দাম পেতে করণীয়
কোরবানির চামড়ার মূল্য পেতে সরকার ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত¡াবধানে একটি ‘কোরবানি চামড়া ওয়াকফ বোর্ড’ গঠন করে এসব চামড়া জমা, সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। জাতীয় চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য হাট ও মাদরাসাভিত্তিক একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রহকাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে। কোরবানির সময় মসজিদ, মাদরাসা ও সামাজিক সংগঠনকে লাইসেন্স দিয়ে চামড়া সংগ্রহের অনুমতি দিলে মানুষ নির্ভরযোগ্যভাবে দান করতে পারবেন। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে লবণ ও কোল্ডস্টোরেজ সংরক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক্স নিশ্চিত করা। কোরবানির পশু চামড়ার জন্য সরকারি হিমাগার, পরিবহন সুবিধা ও অনলাইন ট্র্যাকিং-ব্যবস্থা চালু করা হলে দুর্নীতি কমবে এবং দানের অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগবে। প্রসেসড লেদার রফতানির ব্যবস্থা বাড়ানো এবং কাঁচা চামড়া রফতানিতে নীতিগত সহায়তা। যাচাই-বাছাই করে নির্ভরযোগ্য মৌসুমি ব্যবসায়ী নির্ধারণ করা ইত্যাদি।
কোরবানির চামড়ার সঠিক মূল্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেও সমাধান করা যেতে পারে, যেমন ইসলামে কোরবানির চামড়া বিক্রয় করে নিজের লাভ গ্রহণ করা নিরুৎসাহিত; বরং গরিবদের জন্য সদকা করা বা ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হওয়াই উত্তম; ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেন দায়িত্বশীলতার সাথে চামড়ার সদ্ব্যবহার করে এবং প্রাপ্ত অর্থের হিসাব দেয় তা নিশ্চিত করা; সৌদি আরবের মতো সরকার-নিয়ন্ত্রিত ওয়াকফ ফাউন্ডেশন বা ইসলামিক ট্রাস্ট ব্যবহার করে চামড়া সংগ্রহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা; যারা চামড়া সংগ্রহ করবে তাদের জন্য ন্যায্য পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা এবং বাকি আয় দরিদ্রদের কল্যাণে ব্যয় করা।
মূল কথা হলো, কোরবানির চামড়া একটি ধর্মীয় অনুশাসনের অনুষঙ্গ, অর্থনৈতিক সম্পদ এবং সামাজিক কল্যাণের উৎস। এই আমানতের যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইসলামী বিধান অনুসরণ করে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি।
বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও ইসলামী আদর্শভিত্তিক স্বচ্ছ, সংগঠিত, কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা চালু করলে চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব। এ জন্য সরকারকে সদ্য বিতাড়িত সরকারের চামড়া নিয়ে ধর্মবিরুদ্ধ রাজনীতি বন্ধ করতে হবে এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও জনগণকে নিয়ে চামড়ার ন্যায্য দাম নির্ধারণ করতে হবে; বাঁচাতে হবে চামড়ার বেনিফিশিয়ারি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বাঁচাতে হবে চামড়াশিল্প তথা দেশের অর্থনীতি।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট