দেশপ্রেমের বাতিঘর ওসমান হাদি

‘আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ- সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’, এই চেতনায় পুরো জাতিকে কাঁপিয়ে জাগরণী গানে মুক্তির বার্তা নিয়ে দেশ গড়ার নতুন স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করে ধূমকেতুর মতোই ঝরে পড়ল অকুতোভয় যোদ্ধা ওসমান হাদি। স্বল্প সময়ে সমাজের চেতনার গভীরে শিহরণ ছড়ানোর উদাহরণ তার মতো আর দ্বিতীয়টি নেই। তিনি ইতিহাসের অমোঘ পুরুষ হয়ে রইলেন। রইলেন জাতির মুক্তির রাহবার হয়ে। তার মৃত্যুহীন প্রাণ আগামী দিনগুলোতে জাতিকে আলোর পথ দেখাবে নিঃসন্দেহে। এর প্রতিফলন ঘটেছে প্রধান উপদেষ্টার বাণীতে- ‘আমরা তোমাকে বিদায় জানাতে আসিনি, এসেছি তোমার কাছে ওয়াদা করতে। তোমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার ওয়াদা।’ বস্তুত প্রধান উপদেষ্টার এ উচ্চারণ ছিল পুরো জাতির প্রত্যাশার উচ্চারণ। এই উচ্চারণ সেদিন গোটা জাতিকে মুহূর্তেই একক সত্তায় রূপান্তরিত করেছিল। এভাবেই শহীদ ওসমান হাদি হয়ে উঠেছেন জাতির মিলন সূত্র।

যেসব বাস্তবতার কথা উচ্চারণ করতে হিমশিম খেয়েছেন আমাদের অধিকাংশ জাতীয় নেতা, তা শহীদ হাদি নিঃসঙ্কোচে দ্বিধা ও ভীতিহীনভাবে বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। এখানেই তিনি ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে। হাদির অকাল মৃত্যু আর একবার জাতিকে নাড়া দিয়ে গেছে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই গণতন্ত্রে উত্তরণের। অথচ পরিবর্তে নেতিবাচক এক ন্যারেটিভ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে অত্যন্ত চতুরতা ও নিপুণতার সাথে; বলা হচ্ছে- সরকার ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়। উগ্রবাদীদের প্রশ্রয় দিয়ে দেশকে অস্থির করে সরকার নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্র করছে ক্ষমতা প্রলম্বিত করার। সুপরিকল্পিতভাবে এ ন্যারেটিভ তৈরি করা হচ্ছে। যেন এক দিকে সরকারের নেতিবাচক ভাবমর্যাদা তৈরি করা যায়, সেই সাথে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে নির্বাচনী ট্রেন ঠেকানো যায়। এ ক্ষেত্রে সামনে আনা হচ্ছে দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ঘটনাকে।

হাদির হত্যাকাণ্ড ঘিরে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের এমন কর্মকাণ্ড আরো বেগবান করা হচ্ছে বিভিন্ন রঞ্জকে। ঘটনাপঞ্জি এমনভাবে সাজানো হচ্ছে, যেন দেশে কোনো কার্যকর সরকার কাঠামো নেই। এ ধরনের চেষ্টা লক্ষ করা গেছে শহীদ হাদির নামাজে জানাজার সময়। জানাজার আয়োজনে বিভিন্ন দুর্বলতা, অব্যবস্থার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। জানাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলো মনে হয়েছে ইচ্ছাকৃত অবহেলার প্রকাশ। জানাজায় বিস্তৃত জনসমুদ্রে মাইকের অকার্যকারিতা, নিরাপত্তার অভাব- বিশেষ করে যেখানে প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদ, সব বাহিনীর প্রধান, জাতীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন সেখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থা, জনসাধারণের আগমন-নির্গমন সবই ছিল অগোছালো, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। যেকোনো সময়ে এ বিশাল জনসমুদ্র বিস্ফোরিত হতে পারত, বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠতে পারত। নিয়ন্ত্রণবিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারত। মনে হয়, এটিই চেয়েছিল কেউ। একই সাথে হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে অগ্নিসংযোগ, বাড়িঘর পোড়ানো নিশ্চয়ই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এ ধরনের ঘটনা গণতান্ত্রিক উত্তরণ বিঘ্নিত করতে পারে। এটিকে ব্যবহার করে তৈরি হতে পারে ভিন্নতর ন্যারেটিভ, যার চেষ্টা আমরা দেখেছি। যদিও এগুলোকে দ্রুততা ও বিচক্ষণতার সাথে সামাল দেয়া হয়েছে। তবু এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দুর্বলতা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এসব কিছুই একটি ভিন্ন প্রেক্ষিত তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। তারা কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের প্রশ্রয় দেয় না। কিছু স্বার্থলোলুপ সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কার্যকলাপ কোনোমতেই উগ্রবাদীর উত্থান বলে অভিহিত করা সমীচীন নয়। এ ধরনের অভিধা ব্যবহারের আগে সবারই সতর্ক থাকা উচিত। বিশেষ করে প্রিন্ট ও ইলেকট্র্রনিক মিডিয়ার। একই সাথে জাতীয় নেতাদেরও উচিত এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের। এই ক্রান্তিকালে তাদের সুদক্ষ ও সুচিন্তিত নির্দেশনা অনেক অঘটন থেকে জাতিকে রক্ষা করতে পারে।

শহীদ হাদি জাতিকে একসূত্রে বেঁধেছেন। জাতির স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দুকে আবারো দীপ্তিমান করেছেন। জাতীয় সঙ্কটের এই মুহূর্তে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তার এই কর্মযোগ সামনে এগিয়ে নিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় নেতাদের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। জাতীয় জাগরণের এই স্রোতধারাকে তারাই পারেন সঠিকভাবে অভীপ্সিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে। জাতীয় নেতাদের এ ভূমিকার জন্য পুরো জাতি বুকভরা প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষমাণ। শহীদ হাদি জ্বালিয়ে গেছেন দীপ্ত আলোর মশাল। বিভেদ নয়, অনৈক্য নয়, জাতির প্রত্যাশাকে বাস্তবতার পরিণতিতে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন জাতীয় ইস্পাতকঠিন ঐক্যের। এর কোনো বিকল্প নেই। এ মুহূর্তে বিভেদ, অনৈক্য কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না, জাতির জন্য তো নয়ই। শহীদ শরিফ ওসমান হাদির মতো স্রষ্টার প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও দেশপ্রেমের তুলনাহীন দৃষ্টান্ত অনাগত দিনে জাতিকে প্রেরণা জোগাবে সমৃদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

[email protected]