দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ধীরে হলেও তাৎপর্যপূর্ণভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্ষমতার ভারসাম্য, অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের আকাক্সক্ষা এ পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি। এ বাস্তবতায় পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্ভাব্য জোট বা সমন্বয় কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং এটি দীর্ঘদিনের কাঠামোগত বাস্তবতা, অভিজ্ঞতা ও আঞ্চলিক অসন্তোষের স্বাভাবিক ফল। এই ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা- হোক তা আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক, দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার সমীকরণে মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে, বিশেষ করে ভারতের দীর্ঘদিনের আধিপত্যবাদী মনোভাব সীমিত করায়।
এ সমীকরণের কেন্দ্রে রয়েছে চীন। একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সক্রিয়তার মাধ্যমে তার উপস্থিতি সুদৃঢ় করেছে। পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক এ ত্রিপক্ষীয় কাঠামোর সবচেয়ে পরিণত স্তম্ভ। ‘অল-ওয়েদার’ বন্ধুত্ব হিসেবে পরিচিত এ সম্পর্ক কেবল আবেগের নয়; বরং কৌশলগত বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর এই সম্পর্ককে অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক সংযোগের এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। চীনের জন্য পাকিস্তান আরব সাগরে প্রবেশাধিকার, কৌশলগত গভীরতা এবং ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর পাল্টা ভারসাম্য। অন্য দিকে পাকিস্তানের জন্য চীন অর্থনৈতিক সহায়তা, সামরিক আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমর্থনের প্রধান উৎস।
এই ত্রিভুজে বাংলাদেশের অবস্থান তুলনামূলকভাবে সূ² হলেও ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে এর ভূকৌশলগত গুরুত্ব বহুগুণে বেড়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ সব পক্ষের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইলেও রাজনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক অসমতা ও নিরাপত্তা সংবেদনশীলতার অভিজ্ঞতা ধীরে ধীরে বিকল্প কৌশলের প্রয়োজনীয়তা সামনে এনেছে। চীন ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং অন্যতম প্রধান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী। বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অবকাঠামো খাতে সহযোগিতা দুই দেশের সম্পর্ক গভীর করেছে। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কও ধীরে ধীরে আবেগের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাস্তববাদী আঞ্চলিক স্বার্থের আলোকে পুনর্মূল্যায়িত হচ্ছে।
এই তিন রাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা কোনো আদর্শগত মিলের ফল নয়; বরং এটি অভিন্ন কৌশলগত হিসাব-নিকাশের ফল। তিন দেশ ভিন্ন ভিন্ন রূপে ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যের চাপ অনুভব করেছে- সামরিক দাপট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক প্রভাব বা বয়ান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ‘গেটকিপার’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার ভারতের প্রচেষ্টা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম সিদ্ধান্তের সাথে বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তান-চীন-বাংলাদেশ সমন্বয় এ ধারণা চ্যালেঞ্জ করে বিকল্প বাণিজ্যপথ, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সমন্বয়ের সুযোগ সৃষ্টি করছে, যা দিল্লিকেন্দ্রিক নয়। আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে এর সম্ভাব্য সুফল উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনের পশ্চিমাঞ্চল এবং বাংলাদেশের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সংযোগ স্থাপন ভারতের ভৌগোলিক একচেটিয়াত্ব ভাঙতে পারে। একই সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও গোয়েন্দা সমন্বয় একতরফা সামরিক দাপট নিরুৎসাহিত করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
অর্থনৈতিকভাবে অংশীদারিত্বের বৈচিত্র্য নির্ভরশীলতা কমায় এবং দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়ায়। রাজনৈতিকভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে সমন্বিত অবস্থান দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিক হয়ে থাকা কণ্ঠগুলো শক্তিশালী করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে এ উদীয়মান সমন্বয় এক বিরল ও মূল্যবান কৌশলগত সুযোগ এনে দেয়- বিশেষত এমন এক সময়ে, যখন আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। চীন ও পাকিস্তান- উভয়ের সাথে গঠনমূলক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে ঢাকা নিজের পররাষ্ট্রনীতিকে কোনো একক শক্তির ওপর অতিনির্ভরতা থেকে বের করে এনে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে পুনর্গঠন করতে পারে। কৌশলগত বৈচিত্র্য মানে, বিদ্যমান সম্পর্ক পরিত্যাগ করা নয়; বরং তা হলো সমীকরণ পুনঃস্থাপন করা- যাতে কোনো একক শক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার কিংবা নিরাপত্তা হিসেবের ওপর অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।
এই বিস্তৃত কূটনৈতিক পরিসর বাংলাদেশের দরকষাকষির সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করে, বিশেষ করে দীর্ঘদিনের ও সংবেদনশীল ইস্যুগুলোতে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের বৈচিত্র্য অসম নির্ভরতা কমায় এবং অনুকূল শর্ত, বাজারে প্রবেশাধিকার ও বিনিয়োগের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় করে। পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে- বিশেষত আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো নিয়ে, এ কৌশলগত সমর্থন বাংলাদেশকে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার বাইরে গিয়ে ন্যায়সঙ্গত ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সমাধানের দাবি জোরালোভাবে তুলতে সহায়তা করে।
সীমান্ত নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায়ও এর সুফল রয়েছে, কারণ এতে ঢাকা আরো বিকল্প কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা সক্ষমতা অর্জন করে, যা চাপমূলক আচরণ প্রতিরোধ এবং সীমান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়ক। আঞ্চলিক সংযোগের ক্ষেত্রেও এ সমন্বয় বাস্তব সুফল বয়ে আনতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এ সমন্বয় একটি স্পষ্ট ও দৃঢ় বার্তা দেয়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কোনো দরকষাকষির বিষয় নয়। দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হবে জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা দ্বারা, কোনো বাহ্যিক চাপের দ্বারা নয়। স্বাধীনভাবে অংশীদার নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে ঢাকা একটি আত্মবিশ্বাসী অবস্থান গ্রহণ করছে। এর ফলে বাংলাদেশ একটি প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র থেকে ধীরে ধীরে একটি প্রো-অ্যাকটিভ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হচ্ছে- যে তার কৌশলগত পরিবেশ নিজে গঠন করে, কেবল অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে এ পথ অনুসরণ করা গেলে বাংলাদেশ আর কোনো ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র নয়; বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিসরে একটি আত্মমর্যাদাশীল, স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
তবে এ সম্ভাব্য জোট ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জের বাইরে নয়। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো- আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি। ভারত এমন কোনো ব্যবস্থাকে সহজে মেনে নেবে না; যা তার প্রভাব সীমিত করে। সেই সাথে এর প্রতিক্রিয়ায় কূটনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার বা গোপন অস্থিতিশীলতামূলক তৎপরতা বাড়তে পারে। বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক ছোট রাষ্ট্রকে তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এগোতে হবে, যাতে কোনো প্রকার প্রক্সি প্রতিযোগিতার ময়দানে পরিণত হতে না হয়। অভ্যন্তরীণ ও ঐতিহাসিক সংবেদনশীলতাও বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের সমাজে পাকিস্তান সম্পর্কিত আবেগ এখনো বিদ্যমান, ফলে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি ইতিহাস বিকৃত না করে ভবিষ্যতমুখী ও স্বার্থভিত্তিক বয়ানে উপস্থাপন করা জরুরি। একই সাথে চীনের সাথে অতিরিক্ত অর্থনৈতিক নির্ভরতা ঋণ, কৌশলগত সম্পদ ও নীতিগত স্বাধীনতার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। পাকিস্তানের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জও তাকে কখনো কখনো সীমিত সক্ষমতায় আবদ্ধ রাখতে পারে।
আঞ্চলিকভাবে সমালোচকরা আশঙ্কা করেন, এমন জোট রাজনীতির ফলে সহযোগিতার পরিবর্তে মেরুকরণ বাড়তে পারে। দক্ষিণ এশিয়া ইতোমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায় ভুগছে। একই সাথে প্রতিদ্ব›দ্বী সমীকরণগুলো সেই দুর্বলতা আরো বাড়াতে পারে। অতিরিক্ত নিরাপত্তাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। তবু বাস্তবতা হলো- ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণ এমন পাল্টা সমীকরণের জন্ম দিয়েছে। যখন একটি রাষ্ট্র অংশীদারিত্বের পরিবর্তে আধিপত্য আরোপ করতে চায়, তখন ভারসাম্য সৃষ্টিকারী জোট অনিবার্য হয়ে ওঠে। পাকিস্তান-চীন-বাংলাদেশ সমন্বয়ের লক্ষ্য ভারতকে বিচ্ছিন্ন করা নয়; বরং তার আচরণে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করা। বিকল্প পথের অস্তিত্ব দেখিয়ে এ সমন্বয় দিল্লির একতরফা শর্ত আরোপের ধারণা চ্যালেঞ্জ করে। এই অর্থে এটি আগ্রাসী জোট নয়; বরং একটি কৌশলগত সংশোধনী।
যদি পরিণত মনোভাব, স্বচ্ছতা ও সংযমের সাথে এ সমন্বয় পরিচালিত হয়, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে পারে। ক্ষমতার ভারসাম্য একতরফা দুঃসাহসিকতা কমায়, পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সংলাপের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং এমন এক বহুপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্র খুলে দেয়, যেখানে ভারতও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে- যদি সে আধিপত্যের বদলে অংশীদারিত্বের পথে হাঁটে।
পরিশেষে, পাকিস্তান-চীন-বাংলাদেশ সমীকরণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি বৃহত্তর প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে- মাঝারি ও ছোট রাষ্ট্রগুলো আর কঠোর শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে নীরব দর্শক হয়ে থাকতে চায় না। নিজেদের সক্ষমতা ও স্বার্থ অনুযায়ী অংশীদারিত্ব বৈচিত্র্যময় করছে তারা। এ ছাড়া আঞ্চলিক ব্যবস্থাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। এই পুনর্বিন্যাস সঙ্ঘাত না ভারসাম্য বয়ে আনবে, তা নির্ভর করবে শুধু এই তিন দেশের ওপর নয়; বরং ভারতের প্রতিক্রিয়ার ওপরও। আধিপত্য প্রতিরোধ ডেকে আনে, আর সহযোগিতা জন্ম দেয় স্থিতিশীলতার। এ উদীয়মান ত্রিভুজ সেই চিরন্তন সত্যের বাস্তব প্রতিফলন।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক



