বড়জোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কলম্বোর বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের এয়ারবাস ইউএল-১৯০। সপ্তাহখানেকের সফরে আমরা সপরিবারে বিদেশ থেকে বেড়াতে আসা পুত্র, পুত্রবধূ, তাদের দুই সন্তান ও পুত্রের শাশুড়ি যাচ্ছি শ্রীলঙ্কায়। ঢাকা থেকে আমাদের ওড়ার কথা ছিল বেলা ১টায়; কিন্তু বিলম্ব মাত্র ৫২ মিনিট। বিলম্বের উপলক্ষ- ছয় হাজার ৩১৪ দিন পর এক দেশনায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। আকাশপথে বাংলাদেশ বিমান তাকে নিয়ে আসছে। অন্যদের তাই একটু রয়েসয়ে ল্যান্ড করতে বলায় এই বিলম্ব শুরু। আজ ২৫ ডিসেম্বর, এই ডামাডোলে ভুলেই গিয়েছিলাম আজ আমাদের জাহিনুল ইসলাম রবাবের জন্মদিন। জন্মদিন যিশুখ্রিষ্টের, মোহাম্মদ আলী জিন্নারও। সরকারি ছুটির দিন হলে কী হবে, গত কয়েক দিন ধরে আলাপ-আলোচনায় এ দিনটি রাজনৈতিক গাছের আগায় উঠে এসেছে।
দীর্ঘ দিন পর দেশনায়কের দেশে ফেরার আবেগঘন দিনক্ষণ ঠিক, যে সময়টায় আমাদের কলম্বোর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগের কথা প্রায় সেই একই সময়ে। গত কয়েক দিন ধরে আমরা প্রমাদ গুনছিলাম- আমাদের ফ্লাইট ধরায় ও চড়ায় কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি হবে না তো। তাই সকাল ৯টা ১৭ মিনিটে মগবাজার থেকে রওনা দিলাম হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে। এয়ারপোর্ট কাস্টমসের মাইক ফোরটিন চঞ্চল জানাল, ‘স্যার সরকারি ভিআইপি লাউঞ্জে আসার আর নামার আদৌ দরকার নেই। সেটি ভোররাত থেকে সাবধানী ও অগ্রিম যাত্রীরা আগেভাগে এসে হাজির হয়ে দখল করে নিয়েছে। বসা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। অগত্যা ডিপারচার লাউঞ্জের ৬ নম্বর গেট দিয়ে ঢুুকলাম, সে সময় কোনো বিড়ম্বনা ভোগ করতে হয়নি; কিন্তু চেক ইনের সময় বেজায় ভিড় ও কিছুটা বিশৃঙ্খলা। অনলাইনে চেক ইন করা থাকলেও লাগেজ জমা দিতে বেশ বিড়ম্বনা। চঞ্চল ও অন্যরা বিশেষ ব্যবস্থায় লাগেজগুলো সতর্কতার সাথে সৎগতি করল। এর পর ইমিগ্রেশন পার হতে লাগল বেশ খানিকটা সময়। যাই হোক, ভেতরে ঢুকে বিজনেস লাউঞ্জে বসার সিট পাওয়া গেল না। পুত্র অগত্যা স্ত্রী-সন্তান ও শাশুড়িকে নিয়ে নিচতলায় তড়িঘড়ি করে কিছু খাওয়াতে গেল। আমি আর আমার স্ত্রী বিজনেস লাউঞ্জে বিশেষ সৌজন্যে দু’টি সিট পেলাম। এত ভিড় সচরাচর দেখা যায় না। টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে- স্বাগতম, শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের পর্ব। সবাই বলল, আজকের দিনটি একটু আলাদা। হাজার হোক, অন্য ধরনের বড়দিন।
শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছি এই নিয়ে তৃতীয়বার। ২০০৬ সালে গিয়েছিলাম এইচআইভি সম্মেলনে যোগ দিতে। ২০১৫ সালে সার্ক স্টক এক্সচেঞ্জ ফেডারেশনের সভাপতির পদ বা নেতৃত্ব কলম্বো স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে হস্তান্তর করতে এসেছিলাম। সার্ক স্টক এক্সচেঞ্জ ফেডারেশনের সভাপতি বা নেতৃত্ব ২০১৪-১৫ ছিল বাংলাদেশের জিম্মায়, চট্টগ্রামের স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি হিসেবে ছিলাম আমি। পাকিস্তানিরা এক প্যাঁচ পেড়ে আমাদের কাছ থেকে নেতৃত্ব শ্রীলঙ্কাকে দেয়ার ওকালতি শুরু করে দিলো। আমরা সে বছর চীনের কুনমিংয়ে বিআইসিএম ইসিতে সার্ক এক্সচেঞ্জ ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে চীনের লালনপালনে নবজাতক ইনন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (আইআইবি) সদস্য পদ লাভের জন্য বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বিসেকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল আলম জানতে চাইলেন, এ ব্যাপারে ভারতের মনোভাব কী? সে সময় বাংলাদেশ যা করুক ভারতের সায় থাকা চাই। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে চীনের জায়গায় ভারতকে শেয়ারের স্বল্পমূল্যে হলেও দিতে বেশ জটিলতা সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন বিসেক কর্র্তৃপক্ষ, শেষমেশ চীনকে স্ট্রাটেজিক পার্টনার নিয়োজনের জন্য ঢাকা স্টক একচেঞ্জের এমডিকে অনেক গালমন্দ শুনে বিদায় নিতে হয়েছিল। ২০১৩ সালে ঘটা করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম একচেঞ্জকে ডি-মিউচুয়ালাইজড করা হয়েছিল। আইনে যাই থাকুক না কেন, এই দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে দুদণ্ড কাজ করতে দেয়নি, সম্ভবত এখনো রাজনৈতিক বলশালী বিসেক।
এ সব এখন ইতিহাস। যাই হোক, সে সময় বিসিআইএমের অন্যরকম ক্ষয়রোগ ধরেছে। বিসিআইএম মানে বাংলাদেশ, চায়না, ইন্ডিয়া ও মিয়ানমার। সে সময় বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা নিয়ে সমস্যা চলছিল। চীন মিয়ানমারকে এক বিশেষ কারণে আনুগত্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের এলাকায় ব্যবসায় বিনিয়োগে আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছিল। এ দিকে ভারতের সাথে চীনের মনকষাকষি তো চলছিলই। আমরা বাংলাদেশ চীনের কাছ ঘেঁষতে চেয়েও পারছি না। ভারত বলল, বিসিআইএমএ ‘সি’ (চায়না) থাকলে আঁই ন থাকুম। আবার চায়না বলে আই (ইন্ডিয়া) থাকলে আঁই ন যাইয়ুম। ২০১৫-১৬ সালে বিসিআইএম, ইসি বেশ বেকায়দায় পড়ে, শেষ তারাবির দিকে এগোচ্ছিল। ঠিক সে সময় শ্রীলঙ্কাকে সায়েফের (সার্ক এক্সচেঞ্জ ফেডারেশন) নেতৃত্ব দিতে কলম্বো সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলাম। সায়েফের বিদায়ী সভাপতি হিসেবে নতুন সভাপতি শ্রীলঙ্কানরা আমাদের (আমি ও এমডি মরহুম মারুফ মতিন) বেশ যত্ন করল।
ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কার গভর্নর ও অর্থমন্ত্রীর সাথে আমার ছবি ছাপা হলো শ্রীলঙ্কার জাতীয় পত্রিকায়। সেই শ্রীলঙ্কায় এবার যাচ্ছি ব্যক্তিগত পারিবারিক সফরে। টোকিওতে শ্রীলঙ্কান কমার্শিয়াল কাউন্সেলর নিমল করুনাতিলক আমাদের কূটনৈতিক সহকর্মী ছিলেন, আমি যখন টোকিওতে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর (১৯৯৪-২০০০) ছিলাম।
আগের দু’বার (২০০৬ ও ২০১৫) শ্রীলঙ্কা সফরের সময় করুনাতিলকের খোঁজ পাইনি। তখন তিনি বিদেশে পোস্টেড ছিলেন। করুনাতিলক এখন আমার মতো রিটায়ার্ড লাইফ লিড করছেন। বহু বিদেশ পোস্টিং পেয়েছিলেন, মাঝে ডব্লিউটিওতে শ্রীলঙ্কার প্রধান প্রতিনিধি হয়েছিলেন। এখন এই আকাশ থেকে আমাদের পরম বন্ধু ও কনসালট্যান্ট চ্যাট জিপিটির মাধ্যমে করুনাতিলকের হদিস জানার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে মাথায় এলো ২০২২-২৩ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পতনের পথে যাওয়ার এবং পরের দু’বছরে পুনরুদ্ধার প্রাপ্তির বিষয়টি। এর পাঁচ প্রধান কারণ অনুসন্ধানে নামলাম-
প্রথমে পতনে, খাদের কিনারে যাওয়ার পাঁচ কারণ যা জানলাম-
১. বৈদেশিক ঋণের সঙ্কট ও ঋণখেলাপি (উবনঃ উবভধঁষঃ) : শ্রীলঙ্কা দীর্ঘ দিন ধরে অতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ২০২২ সালে দেশটি প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়, ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতা ধসে পড়ে।
২. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিঃশেষ হওয়া : ডলার রিজার্ভ প্রায় শূন্যে নেমে যাওয়ায় জ্বালানি, ওষুধ, খাদ্য ও কাঁচামাল আমদানি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফলে দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত হয়।
৩. ভুল নীতি-সিদ্ধান্ত (বিশেষত কর হ্রাস ও কৃষিনীতি) : ২০১৯ সালে বড় আকারের কর ছাড় দেয়ায় সরকারের রাজস্ব মারাত্মকভাবে কমে যায়। পাশাপাশি রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করায় কৃষি উৎপাদন ধসে পড়ে, খাদ্যসঙ্কট তৈরি হয়।
৪. কোভিড-১৯ ও পর্যটন খাতের ধস : কোভিডের কারণে পর্যটন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পর্যটন ছিল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস, যা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়।
৫. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণবিক্ষোভ : জ্বালানি ও খাদ্যসঙ্কট থেকে শুরু করে ব্যাপক গণবিক্ষোভ, সরকার পতন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতিকে আরো দুর্বল করে তোলে।
এর পর ২০২৩-২৫ সালে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পাঁচটি কারণ-
১. আইএমএফের সহায়তা ও সংস্কার কর্মসূচি : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাথে চুক্তির ফলে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংস্কার, ঋণ পুনর্গঠন ও বাজেট শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে।
২. কর ব্যবস্থা সংস্কার ও রাজস্ব বৃদ্ধি : কর ছাড়, প্রত্যাহার, ভ্যাট ও আয়কর বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে।
৩. মুদ্রানীতির কড়াকড়ি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ : কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনে। মুদ্রার মূল্যমান স্থিতিশীল হয় এবং রুপির ওপর চাপ কমে।
৪. পর্যটন ও প্রবাসী আয়ের পুনরুদ্ধার : পর্যটন খাত ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় এবং প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায়, ফলে ডলার-প্রবাহ বাড়ে।
৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক আস্থা ফেরত আসা : রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলনামূলক স্থিতিশীল হওয়ায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও দাতা সংস্থাগুলোর আস্থা ধীরে ধীরে ফিরে আসে।
শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতার আলোকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ অর্থনীতির পতন ও উত্থানের বিষয় নিয়ে যখন ভাবতে যাচ্ছি, ঠিক সে সময় পাইলট ঘোষণা দিলেন, কেবিন ক্রুরা সতর্ক থাকুন- আমরা নামতে যাচ্ছি।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান



