পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন : টেকসই উন্নয়ন ও করণীয়

মো: সহিদুল ইসলাম সুমন

জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO) ঘোষিত ২০২৫ সালের পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘টেকসই উন্নয়নে পর্যটন’ (Tourism & Sustainable Transformation)। এই প্রতিপাদ্যটি কেবল ভ্রমণ ও বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং পর্যটনকে এমন একটি শক্তি হিসেবে তুলে ধরে, যা কোনো অঞ্চলের সমাজ, অর্থনীতি ও পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। এই উন্নয়ন ভাবনা সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য। আর পর্যটন এবং টেকসই উন্নয়ন মানে হলো এমন পর্যটন ব্যবস্থার প্রচলন করা যা পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির ওপর দীর্ঘস্থায়ী ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণ হয়। এর মাধ্যমে গন্তব্য এলাকার পরিবেশ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটানো হয়। টেকসই পর্যটনের লক্ষ্য হলো প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায্য অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করা। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, স্থানীয়দের অংশগ্রহণে পর্যটন ব্যবস্থা পরিচালনা এবং পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম : ভূপ্রকৃতি ও জনবৈচিত্র্যের অনন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের প্রায় এক-দশমাংশ জুড়ে বিস্তৃত রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত। প্রতিটি জেলারই রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

রাঙ্গামাটি বাংলাদেশের বৃহত্তম জেলা, যার আয়তন ছয় হাজার ১১৬.১৩ বর্গকিলোমিটার। এই জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় সাত লাখ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০৬ জন। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬২তম অবস্থানে রয়েছে। এই জেলায় বেশ কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করে, যার মধ্যে চাকমা (৪২.৬ শতাংশ), মারমা (৭.৯৪ শতাংশ), তঞ্চঙ্গ্যা (৪.৩২ শতাংশ) এবং ত্রিপুরা (১.৯০ শতাংশ) প্রধান। এ ছাড়াও জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বাঙালি (৪২.৪২ শতাংশ)। এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ভাষা, রীতিনীতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে। এখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (৫৭.৩ শতাংশ), এরপর মুসলিম (৩৬.৩ শতাংশ), হিন্দু (৫.১১ শতাংশ) এবং খ্রিষ্টান (১.৩২ শতাংশ)।

খাগড়াছড়ি জেলার মোট আয়তন দুই হাজার ৬৯৯.৫৫ বর্গকিলোমিটার। এর জনসংখ্যা প্রায় সাত লাখ ১৫ হাজার। এখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৯২ জন। এই জেলায় বসবাসকারী প্রধান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো হলো- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও সাওতাল। সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, খাগড়াছড়িতে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫১.০৭ শতাংশ) এবং চাকমা জনগোষ্ঠী দ্বিতীয় বৃহত্তম (২৪.৫৩ শতাংশ)।

মেঘ ও পাহাড়ের সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত বান্দরবান জেলার আয়তন চার হাজার ৪৭৯.০৩ বর্গকিলোমিটার, যা চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এই জেলাটি মারমা, মুরং, ত্রিপুরা, বম, খিয়াং এবং খুমির মতো বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃজনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। বান্দরবানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৮.৮৫ শতাংশ)।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি জেলাতেই লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। রাঙ্গামাটি দেশের বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদকে কেন্দ্র করে রাঙ্গামাটির পর্যটন বিকশিত হয়েছে। হ্রদের বুকে নৌভ্রমণ, ঝুলন্ত সেতু এবং সুবলং ঝরনা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। এ ছাড়া বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান রাজবন বিহার ও ঐতিহ্যবাহী চাকমা রাজার রাজবাড়ি এখানকার সাংস্কৃতিক আকর্ষণের মূল কেন্দ্র। সম্ভাবনাময় নতুন গন্তব্যের মধ্যে রয়েছে- বড়াধাম, ধুপপানি ও মুপ্পোছড়া ঝরনা, যেখানে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন হয় দুঃসাহসিক ট্রেকিং। কাপ্তাই হ্রদের দ্বীপগুলোতে গড়ে ওঠা পেদা টিংটিং ও টুকটুক ইকো-ভিলেজ প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার অনন্য সুযোগ দেয়।

খাগড়াছড়ি জেলা তার গুহা, ঝরনা ও পাহাড়ের স্বতন্ত্র সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। জনপ্রিয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে আলুটিলা গুহা ও পর্যটন কেন্দ্র, রিছাং ঝরনা, দেবতারা পুকুর এবং মায়াবিনী লেক। নতুন ও সম্ভাবনাময় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে- তৈদুছড়া ঝরনা, যাকে ত্রিপুরা ভাষায় পানির দরজা বলা হয়। এটি অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য উপযুক্ত এক রোমাঞ্চকর ট্রেকিং রুট। শতবর্ষী বটবৃক্ষ ও নিউজিল্যান্ড পাড়ার মতো স্থানগুলোও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

বান্দরবান আকাশছোঁয়া পাহাড়ের এই জেলাটি দুঃসাহসিক পর্যটকদের জন্য। নীলগিরি ও নীলাচলের চূড়া থেকে মেঘ ও পাহাড়ের মাখামাখি ভিউ দেখা যায়। মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, বগালেক ও শৈলপ্রপাত ভ্রমণের আদর্শ স্থান। সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মারায়ন তং পাহাড়টি ক্যাম্পিং ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্যের জন্য সুপরিচিত, যার উচ্চতা প্রায় এক হাজার ৬৪০ থেকে দুই হাজার ফুট। এ ছাড়া অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য নতুন গন্তব্য হিসেবে উন্মুক্ত হয়েছে দেবতাখুম ও লিক্ষ্যং ঝরনা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপরিকল্পিত বিস্তার নানা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে পরিবেশগত অবক্ষয়, আর্থসামাজিক বৈষম্য। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্র, হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণের ফলে বনভূমি উজাড় হচ্ছে, যা ভূমিধস এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবং বৃক্ষনিধনের কারণে পাহাড়ি ঝরনাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকায় সঙ্কট সৃষ্টি করছে। পর্যটন থেকে অর্জিত বিপুল আয়ের সুফল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ক্ষমতাধর গোষ্ঠী ও বিনিয়োগকারীরাই এর প্রধান সুবিধাভোগী। এর ফলে স্থানীয়রা তাদের সংস্কৃতি ও জীবিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।

টেকসই পর্যটনের জন্য প্রয়োজনীয় সমন্বিত নীতিমালা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতির অভাব রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি টেকসই পর্যটন মডেল প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (BPC) ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (BTB) পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এই দুই সংস্থার নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করা উচিত। এর মধ্যে পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনকে একটি ওয়ান-স্টপ পর্যটন উন্নয়ন সংস্থায় রূপান্তর করা এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করা জরুরি।

পর্যটনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা জেলা পরিষদগুলোর হাতে থাকা উচিত। ভূমি বিরোধ দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি করতে হবে। পর্যটনকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের হাতিয়ারে পরিণত করতে কমিউনিটি-বেজড ট্যুরিজম (CBT) মডেল বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এতে পর্যটকরা স্থানীয়দের মাচাং ঘরে থাকার সুযোগ পাবে এবং তাদের হাতে তৈরি হস্তশিল্প ও ঐতিহ্যবাহী খাবার কেনা যাবে, যা সরাসরি স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।

প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে ট্রেকিং ও বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণের মতো কার্যক্রমের মাধ্যমে স্থানীয় গাইডদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী উৎসব (বৈসাবি, সাংগ্রাই), পোশাক (পিনন, হাদি), নৃত্য, সঙ্গীত এবং জীবনধারাকে পর্যটনের মূল আকর্ষণ হিসেবে তুলে ধরলে তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণেও সহায়তা করবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা ও স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিয়ে একটি নীতি তৈরি করতে হবে। এই নীতিমালায় সামরিক ও বেসরকারি খাতের পর্যটন প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্থানীয় যুবকদের গাইড, দোভাষী এবং স্থানীয় উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে হবে।

সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ধারাবাহিক বিনিয়োগ করতে হবে। পর্যটন স্থানগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তা এমনভাবে করতে হবে যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার ও চলাফেরার স্বাধীনতা ব্যাহত না হয়।

লেখক : কলামিস্ট, সদস্য, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ