সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশ তো আর আমরা তৈরি করিনি, আমাদের ভাষা যদি এক হয় তাতে আমরা কী করব? বরং ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের নামে তোমরা আসলে ভাগ করেছ বাংলা এবং পাঞ্জাবকে।’ লড়াই জানা সাহসী দুশমন থেকে ভয়ঙ্কর কিছু যদি থেকে থাকে সে হলো এমন দূরদর্শী কেউ যে অন্যদের পরিকল্পনার মধ্যে পরিণতি দেখতে পায়। কথাটি চিরন্তন সত্য। বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে হিন্দুদের তীব্র বিরোধিতা ও আন্দোলনের প্রকৃতি দেখে তৎকালীন ঢাকার দূরদর্শী নবাব সলিমুল্লাহ বলেছিলেন, ‘হিন্দুগণ কালক্রমে বুঝতে পারবে যে, পূর্ব বাংলা প্রদেশ স্থাপিত হওয়ায় বাংলা ভাষাভাষী জনগণের বিভক্তি হয়নি; বরং দু’টি সহোদর প্রদেশের শাসন, শিক্ষা প্রভৃতির উন্নতির সুব্যবস্থা হবে এবং বাঙালি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।’ (তথ্যসূত্র : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পৃষ্ঠা : ৭৫)। ১৯৪০-১৯৪৫ পর্যন্ত সর্বত্র এক অরাজক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। অবশেষে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ভারতের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে সোপর্দ করতে চায়। গান্ধী প্রথমদিকে ভারত ভাগে রাজি ছিলেন না। তবে ১৯৪৬ সালের রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গভীর সঙ্কটে পড়ে। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে তারা দ্রুত বুঝতে পারে, ভারতের ওপর আর দীর্ঘ দিন শাসন কায়েম রাখা সম্ভব নয়। এর পরপর ব্রিটিশরা স্বাধীনতা দেয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
এমন প্রেক্ষাপটে মাত্র এক মাসের মাথায় ঘোষণা করা হয় ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা। এর অধীনে ব্রিটিশ ভারতের জন্য একটি তিন স্তরবিশিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছিল। শীর্ষ স্তরে থাকত ফেডারেল ইউনিয়ন, নিচের স্তরে পৃথক প্রদেশ এবং মধ্যবর্তী স্তরে থাকত প্রদেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত আঞ্চলিক গোষ্ঠী। উত্তর-পশ্চিম ভারত,পূর্ব ভারত এবং ভারতের অবশিষ্ট কেন্দ্রীয় অংশের জন্য যথাক্রমে গ্রুপ এ, বি এবং সি নামে তিনটি গোষ্ঠী প্রস্তাব করা হয়েছিল; কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় গ্রুপ ‘বি’-কে ঘিরে। এখানে মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, ফলে এটি মুসলিম লীগের জন্য একটি শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠতে পারত। কংগ্রেস, যা মূলত হিন্দু প্রভাবিত রাজনৈতিক দল ছিল, এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। ফলত পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। এরপর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পুনরায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মুসলমানদের সমান রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব সামনে আনেন।
ব্রিটিশদের কাছে কংগ্রেস বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগের প্রস্তাব করে। অন্য দিকে মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম সবাই যুক্তবাংলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন, জিন্নাহও তাতে আপত্তি জানাননি। কংগ্রেসের বেশির ভাগ নেতা যুক্তবাংলার ঘোর বিরোধিতা করেন। তারা ভেবেছিলেন, বাংলা আর পাঞ্জাবকে ভাগ করা ভালো হবে। তারা বাংলা ভাগের দাবিতে হিন্দু মহাজোটের নেতাদেরও পাশে পেয়েছিলেন। (তথ্যসূত্র : আবুল হাশেম রচিত আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি)।
জিন্নাহর সতর্কবার্তা ও র্যাডক্লিফের কলমে বিভাজন :
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতের শেষ ভাইসরয় অ্যাডমিরাল লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন, ‘ইওর এক্সেলেন্সি বোধ হয় জানেন না যে একজন মানুষ আগে একজন পাঞ্জাবি বা বাঙালি, পরে সে হিন্দু বা মুসলমান। ধর্ম যা-ই হোক তার পরিচয় সে বাঙালি বা পাঞ্জাবি। তার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, তার অর্থনীতি সবই এক। সে ক্ষেত্রে পাঞ্জাব বা বাংলা ভাগ করা মানে পাঞ্জাবি বা বাঙালিকে ভাগ করা। এর ফলে নতুন করে রক্তপাত হবে দাঙ্গা হবে।’ (ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়ের : ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট পৃষ্ঠা ১২৩) কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস নেতা জওয়াহেরলাল নেহরু, প্যাটেল এবং অ্যাডমিরাল মাউন্টব্যাটেনের যোগসাজশে বাংলাকে অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হয়নি। কথা ছিল, কলকাতার অর্ধেক অংশ পাবে পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ; কিন্তু দিল্লিতে র্যাডক্লিফ কংগ্রেস নেতাদের সাথে যোগসাজশ করে পূর্ববঙ্গকে বঞ্চিত করে।
যারা ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ হলো বলে রক্তের পথ বেছে নিয়েছিল। হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত করেছিল। তারাই ১৯৪৭ সালে নিজেদের স্বার্থে পুনরায় বাঙালি জাতীয়তার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। দেশভাগের নামে বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত তথা বঙ্গভঙ্গ করার মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদের স্বার্থে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাথে মিশে যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলে কোনো কিছুই তারা স্বীকার করল না। তারা নিজেদের পরিচয় দিল বাঙালি নয় হিন্দু বলে, শনাক্ত করল ভারতীয় হিসেবে। দেশভাগের নামে এভাবে তারা করল বঙ্গভঙ্গ। শেষ পর্যন্ত বাংলার অস্তিত্ব রক্ষা করতে ঢাকাকেই এগিয়ে আসতে হয়েছিল, যার ধারাবাহিকতার ফল ভৌগোলিকভাবে সত্য আমাদের দেশ বাংলাদেশ।
এপার বাংলা-ওপার বাংলার স্লোগান : স্বাধীনতা নাকি আত্মসমর্পণ
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমাদের বর্তমান সব সমস্যার গোড়াপত্তন ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া, তারা তাদের রাজত্ব শেষে চলে গেছে ঠিক; কিন্তু সর্বত্র রেখে গেছে সঙ্ঘাত। স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পরপর খণ্ডিত বাংলার একাংশ পশ্চিম বাংলার সাথে মিশে যাওয়ার জন্য নতুন স্লোগান তোলে ‘এপার বাংলা-ওপার বাংলা এক হও।’ একটি স্বাধীন দেশ এপার বাংলার সাথে পরাধীন ওপার বাংলা (পশ্চিম বাংলা) কিভাবে এক হয়? বাংলাকে যদি এক হতে হয় তাহলে অবশ্যই আগে ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বাংলাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম হতে হবে। পশ্চিম বাংলাকে পরাধীন রেখে বাংলাদেশকে পশ্চিম বাংলার সাথে মিশে যাওয়া মানে হলো স্বাধীনতা হারিয়ে ভারতের সাথে যুক্ত হওয়া। নেহরু-গান্ধীরা তাই চেয়েছিলেন। এমনকি নেহরু স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, যুক্ত বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হোক তাতে তিনি একমত নন; বরং যুক্ত বাংলা ভেঙে যাক। তার মতে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের জন্য চরম বিব্রতকর হবে। আজ হোক কাল হোক পূর্ব বাংলা ভারতে পুনঃসংযুক্ত হবে। (তথ্য সূত্র : মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন রচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড টার্গেট বাংলাদেশ পৃষ্ঠা : ৩৯)
আজও ভারতের সব ষড়যন্ত্রের ধারা একই নদীর মতো, একই সাগরে গিয়ে মিশছে; সেই সাগরের নাম ‘অখণ্ডতার স্বপ্ন’। সাতচল্লিশের বিভাজন থেকে আজ পর্যন্ত টানা ৭৮ বছর কেটে গেলেও তাদের সেই স্বপ্ন মরীচিকার মতো অধরা রয়ে গেছে। কিন্তু মরীচিকা যেমন মরুভূমির তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিকে থামাতে পারে না, তেমনি ভারতও তাদের চিরন্তন আকাক্সক্ষার পেছনে এ দেশের কিছু মুখোশধারী বুদ্ধিজীবী, স্পাইমাস্টার ও রাজনীতিবিদ ভারতের সেই বাঁশির সুরে নেচে ওঠে। অথচ বিশ্বায়ন নামের এ রঙিন আবরণে কোথাও বৃহৎ প্রতিবেশী ক্ষুদ্র প্রতিবেশীকে এভাবে রক্তশূন্য করে না, যেমনটা ভারত করেছে এবং করছে অবিরাম।
কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ জনগণ। ভারত বাংলাদেশ গ্রাসে যত বেপরোয়া হবে, তাদের চররা যত লজ্জাহীন হবে, দেশ রক্ষায় আমাদের অঙ্গীকার তত শাণিত ও দৃঢ় হবে। আজকের পশ্চিমবঙ্গ দিল্লির কাছে অবহেলিত একটি প্রদেশ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, তারা সম্মান পেতে চান, আজ তাদের লড়াই নিজেদের বাঙালি জাতিসত্তার লড়াই, বাংলার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।
ইতিহাস আমাদের মধ্যে সীমানা তৈরি করেছে ঠিকই; কিন্তু সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন আজও টিকে আছে, অটুট ও চিরস্থায়ীভাবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ সম্ভবত পরোক্ষ স্বাধীনতার প্রতিফলন। এখন তাদের জনগণের ওপর নির্ভর করে তারা আসলে কী চায়, হয়তো সামনের দিনগুলো তা বলে দেবে বাংলা কি ফিরে পাবে নতুন করে তার হারানো ঐতিহ্য, হাজার বছরের পুরনো সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌ বাহিনী প্রধান ও প্রোভিসি বিইউপি



