২০২৫ সালের ৫ আগস্ট, জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় দাঁড়িয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে বক্তব্য পাঠ করেন, তা-ই ‘জুলাই ঘোষণা’ নামে পরিচিত। এটি ছিল গত বছরের বিপ্লবের কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিবৃতি। অগণিত মানুষ এই ঘোষণার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, এই বিশ্বাস ধারণ করেছিলেন যে, এটি সেই আদর্শকে ধারণ করবে, যা লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামতে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েছিল; কিন্তু যখন ঘোষণাটি প্রকাশিত হলো, তখন তা আশানুরূপ প্রভাব ফেলতে পারল না। এটি সেই জন-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হলো, যা বিপ্লবের ভিত্তি গড়েছিল। যে দলিলে অতীত থেকে বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দিয়ে বিপ্লবের চেতনা ও গতিশীলতার প্রতিফলন ঘটার কথা ছিল, দুঃখজনকভাবে সেটি সংস্কারের এক দুর্বল প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত জুলাই সনদের খসড়াও একইভাবে হতাশাজনক। এই দু’টি দলিল থেকেই স্পষ্ট যে, অন্তর্বর্তী সরকার শুধু তার বৈধতার ভিত্তিকে ভুলভাবে অনুধাবন করেছে তা-ই নয়; বরং তার ম্যান্ডেটকেও যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি।
আমরা এখানে যুক্তি উপস্থাপন করব যে, জুলাই ঘোষণা সংবিধানের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের অস্তিত্বকে যে যুক্তিতে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে, তা প্রকৃতপক্ষে বিভ্রান্তিকর ও ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে। বাস্তবিক অর্থে, অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা সংবিধানের বিধিতে নয়; বরং জনগণের সেই প্রত্যক্ষ অনুমোদনে নিহিত, যার ভিত্তিতে তারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে।
জুলাই ঘোষণায় অন্তর্বর্তী সরকার ও তার উপদেষ্টামণ্ডলীর বৈধতা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির দু’টি দিক স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। প্রথমত, সেখানে বলা হয়েছে যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, আমরা সবাই জানি এটি সত্য নয়। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের রচিত একটি কল্পকাহিনী। কারণ ‘পদত্যাগ’ শব্দটি ব্যবহার করলে সংবিধানের আলোকে তাদের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের ভিত্তি মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত করা উচিত নয়। জুলাই ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার ‘সংবিধানসম্মতভাবে’ গঠিত হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৬ এবং সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে। এই দাবিও সঠিক নয়। অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান অনুযায়ী গঠিত হয়নি। সংবিধানে ‘অন্তর্বর্তী সরকার’-এর কোনো বিধান নেই। ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকার’ বলে একটি ব্যবস্থা একসময় ছিল; কিন্তু তা সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়ে বাতিল হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১০৬ কেবল রাষ্ট্রপতিকে আইনগত প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার সুযোগ দেয়। এটি কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ক্ষমতা দেয় না এবং আদালতও কোনো অসাংবিধানিক ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়ার এখতিয়ার রাখে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যে আগ্রহভরে নিজেকে সাংবিধানিক বাতাবরণে ঢাকতে চায়, তা বোধগম্য হলেও ভুল স্থানে প্রয়োগ করা হয়েছে। সংবিধানের বিধিকে টেনে-হিঁচড়ে বিকৃত করার মাধ্যমে তারা নিজেদের কর্তৃত্বের দাবি শক্তিশালী না করে বরং দুর্বল করে ফেলেছে। সত্য হলো এই, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান থেকে নয় জন্ম নিয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া এক অভ‚তপূর্ব রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে। এই সরকারের প্রকৃত বৈধতা ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদে, কিংবা শেখ হাসিনার কল্পিত পদত্যাগে নিহিত নয়; বরং সেই জনগণের ইচ্ছায়, যা পুরনো শাসনব্যবস্থা উপড়ে ফেলেছে। জনগণের ইচ্ছাই এ সরকারের প্রকৃত ভিত্তি। তাদেরকে সেই সত্যই ধারণ করতে হবে।
জুলাই ঘোষণায় যদি সত্যনিষ্ঠ ও সাহসী অবস্থান নেয়া হতো, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার স্পষ্টভাবে স্বীকার করত, তাদের ভিত্তি সংবিধানের টানা-হেঁচড়া ব্যাখ্যায় নয়; বরং জনগণের ম্যান্ডেটে প্রতিষ্ঠিত। সংবিধানতত্তে¡ এই ম্যান্ডেটকে বলা হয় ‘জনগণের সংবিধান-প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা’। সংবিধান-প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা হলো সেই অসাধারণ কর্তৃত্ব, যা বিপ্লব বা গণজাগরণের পর জনগণের মধ্য থেকে উদ্ভূত হয়। এই ক্ষমতার মাধ্যমে জনগণ পুরনো শাসনব্যবস্থা ভেঙে নতুন এক সামাজিক চুক্তি নির্মাণ করতে পারে, প্রয়োজনে একটি নতুন সংবিধানও রচনা করতে পারে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে যা ঘটেছে সত্যিকার অর্থে এটা তা-ই। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে পুরনো সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। কেউ তা ‘সংবিধান বাতিল’ বলুক বা ‘স্থগিত’ বলুক- বাস্তবতা হলো, সংবিধানের বহু অংশ কার্যকর ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো লিখিত সংবিধান থেকে জন্ম নেয়নি; এটি জন্ম নিয়েছে জনগণের সেই অসাধারণ ক্ষমতা থেকে, যা তারা বিপ্লবের মাধ্যমে প্রয়োগ করেছে এবং যার ভিত্তিতে তারা এই সরকার ও তার উপদেষ্টামণ্ডলীর নিয়োগ দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, জুলাই ঘোষণা নিজেই তার দুর্বলতা স্বীকার করেছে। দলিলে বলা হয়েছে, ‘এই ঘোষণা যথাযথ রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবে।’ অর্থাৎ, বর্তমানে এর কোনো স্বীকৃতি নেই- এটি ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি মাত্র। এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়, ঘোষণাটি বাস্তব ক্ষমতা বা আইনগত বলবত্তা নয়; বরং কেবল একটি কাগজের টুকরো। সবচেয়ে দুর্বল অংশটি হলো সেই দাবি, যেখানে বলা হয়েছে, জুলাই ঘোষণা ‘ভবিষ্যতে সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিল অংশে অন্তর্ভুক্ত হবে।’ কিন্তু সংবিধানের তফসিলে কোনো দলিল যুক্ত করলেই তা সংবিধানের অংশ হয়ে যায় না। সংযোজনী একটি তালিকা মাত্র, যা সংবিধানের মূল কাঠামো নয় এবং এর মাধ্যমে কোনো দলিলের সাংবিধানিক বৈধতা নিশ্চিত হয় না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি বিপজ্জনক সাংবিধানিক দ্ব›েদ্ব আবদ্ধ। তারা যেন উপলব্ধিই করতে পারছে না যে, তাদের অস্তিত্ব বর্তমান সংবিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। পুরনো সাংবিধানিক কাঠামো আঁকড়ে ধরে থাকার মাধ্যমে, তারা আসলে নিজেদের অস্তিত্বকেই দুর্বল করে তুলছে। সরল সত্য হলো, এই সরকারের কর্তৃত্ব বর্তমান সংবিধান থেকে আসেনি, আসতে পারে না। কারণ সেই সংবিধান জনগণের কাছে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে এবং তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারের তৎকালীন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবরেই এই বাস্তবতা তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন : ‘রাষ্ট্রপতি ও সংবিধান আসলে অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে অকার্যকর হয়ে গেছে।’ নাহিদ ইসলামের এই ঘোষণা কোনো বিপ্লবী তত্ত¡ ছিল না; বরং তা ছিল একটি স্পষ্ট বাস্তবতা। যদি বিদ্যমান সংবিধানের মানদণ্ডে বিচার করা হয়, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। সাংবিধানিক পরিভাষায় এটি একটি অবৈধ কর্তৃত্ব। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায়, এই সরকার বৈধতা পেয়েছে, ব্যর্থ সংবিধানের পাঠ্যাংশ থেকে নয়; বরং সেই জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা থেকে, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং এই সরকারকে বৈধতা দিয়েছে।
এবার আসা যাক জুলাই সনদের খসড়া প্রসঙ্গে। এতে বেশকিছু সংস্কারপ্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরে সীমিত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন এবং সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাবগুলো- প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে গৃহীত হয়েছে। তবে এই সংশোধনীগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’তে পরিবর্তন ঘটবে। আর যদি তা-ই ঘটে, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনীগুলোকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট ইতোমধ্যে ১৯৮৯ সালের অষ্টম সংশোধনী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাবও বিতর্কিত। কারণ বর্তমান সংবিধান একটি এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাঠামোকে অনুমোদন করে। তাই যুক্তি দেয়া যায় যে, এই প্রস্তাবটিও সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক। তবু বাস্তবতা হলো, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক হোক বা না-হোক, এই পরিবর্তনগুলোর প্রতি আজ ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
তবে যদি আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে, তাহলে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের মতো আওয়ামীপন্থী প্রধান বিচারপতি নিঃসন্দেহে এমন সব সংশোধনী পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে। এর পাশাপাশি, তিনি সংবিধানের ৭এ অনুচ্ছেদও পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন, যা আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার সাথে জড়িত সব ব্যক্তির (অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যসহ) মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখে। এই সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়ানোর একমাত্র পথ হলো একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা (নতুন মৌলিক কাঠামোসহ) এবং একটি নতুন আইনি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সব সাংবিধানিক পদাধিকারী নতুন সংবিধান রক্ষার শপথ গ্রহণ করবেন। পুরনো শাসনব্যবস্থার এই প্রত্যাখ্যানই ছিল জুলাই বিপ্লবের অন্তর্নিহিত চেতনা; কিন্তু জুলাই বিপ্লবের চেতনা আজ প্রশ্নবিদ্ধ, একটি অদক্ষ আইন মন্ত্রণালয়ের কারণে, যাদের সাংবিধানিক বোধ দুর্বল, আর বিপ্লবের প্রতি আনুগত্য রাজনৈতিক সুবিধাবাদের ছায়ায় ঢাকা।
অতএব, বাংলাদেশ যদি সত্যিই অগ্রগতির পথে এগোতে চায়, তবে তার পথ রচিত হতে হবে একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে। এমন একটি সংবিধান, যা রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে, যার অন্তর্ভুক্ত থাকবে সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট বিধান। এই সংস্কারগুলো যদি নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রোথিত হয়, তবে ভবিষ্যতের কোনো আদালতই এগুলোকে সহজে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। এভাবেই জুলাই ঘোষণাপত্র ও খসড়া জুলাই সনদের প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো স্থায়িত্ব ও বৈধতা লাভ করবে এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঢেউয়ে বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকবে; কিন্তু এই কাজের জন্য প্রয়োজন এমন একটি অন্তর্বর্তী সরকার, যারা নিজেদের ক্ষমতার উৎস ও দায়িত্বের পরিসর সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন। যদি সেই বোধের দীপ্তি অনুপস্থিত থাকে, আর যদি ব্যর্থ সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস না জাগে, তবে জুলাই বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি ধীরে ধীরে ইতিহাসের ধূলিকণায় বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি