নির্বাচন নিয়ে এখনো কেন এত সংশয়

এ নির্বাচন শুধুই একটি নির্বাচন নয়, এটি বাংলাদেশের পরবর্তী দশকের রাষ্ট্র-রাজনৈতিক দিকনির্দেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে নিয়ে এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যখন রাষ্ট্রে তিনটি বৃহৎ রূপান্তর একই সাথে ঘটছে; রাষ্ট্রের কাঠামোগত পুনর্নির্মাণ, রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাস এবং নাগরিক আস্থার পুনরুদ্ধার। জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর অভ্যুত্থান, এর পরবর্তী রাজনৈতিক পতন এবং ‘জুলাই চার্টার’ভিত্তিক অন্তর্বর্তী পুনর্গঠন প্রক্রিয়া- সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন যেমন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, তেমনি রেখে গেছে সংশয়, ভীতি ও অনিশ্চয়তার ছাপ।

এই অবস্থায় প্রশ্ন একটাই, ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন কি স্থিতিশীল, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক হতে পারবে?

এই সংশয়ের মূলে রয়েছে কয়েকটি কঠিন বাস্তবতা, যেগুলো উপেক্ষা করা যায় না।

১. ভেঙেচুরে যাওয়া নিরাপত্তা কাঠামো এখনো স্থিতিশীল হয়নি।

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যন্ত্রের মধ্যে যেভাবে দ্ব›দ্ব ও বিভাজন প্রকাশ্যে আসে, তা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার প্রভাবাধীন ছিল। অভ্যুত্থানের পর তাদের পুনর্গঠন শুরু হলেও আজো স্পষ্টভাবে বলা যায় না, এই নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো কি নির্বাচনের সময় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবে?

বিশ্লেষকরা বলছেন :

-নিরাপত্তা বাহিনীর টপ-টিয়ার সংস্কার হলেও মধ্য ও নিম্নপর্যায়ে পুরনো আনুগত্যের ঘোর এখনো কাটেনি;

-গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় এখনো অসম্পূর্ণ;

-সীমান্ত-নিরাপত্তায় ভারত, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা-ইস্যু ঘিরে বহুমুখী চাপ রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সহিংসতা, সঙ্ঘবদ্ধ নাশকতা বা প্ররোচিত অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না। নিরাপত্তা যন্ত্রের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে সংশয় তৈরি হয়েছে, তার ফলে নির্বাচন ঘিরে জাতির মনোভাবও দোলাচলে আছে।

২. রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক অস্থিরতা এবং অসম প্রস্তুতি

জুলাই অভ্যুত্থান রাজনৈতিক দলগুলোকে পুরোপুরি নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে।

বিএনপি- যে দল বহু বছর দমন-পীড়ন, মামলা, বন্দিত্ব ও বিভক্তির ভেতর দিয়ে গেছে- এখনো নেতৃত্ব পুনর্গঠন, সাংগঠনিক পুনরুজ্জীবন এবং তৃণমূল পুনর্গঠনের কাজ করছে। নির্বাচনের মুখে তাদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি সুস্পষ্ট নয়।

ইসলামী দলগুলো অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিবেশে নতুন কৌশলী জোটবিন্যাসে রয়েছে। কারা কার সাথে থাকবে, কোন প্ল্যাটফর্মে লড়বে এবং কোনটি রাষ্ট্রনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে- এসব প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত।

বাম দলগুলো তুলনামূলক ছোট হলেও সমাজে তাদের নৈতিক অবস্থান আছে। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের প্রভাব কতটা হবে বা তারা বৃহত্তর জোটে যুক্ত হবে কি না- এখনো অনিশ্চিত।

অন্য দিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ কঠিন বাস্তবতার মুখে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তদন্ত, নিষেধাজ্ঞা, আইনি প্রক্রিয়া; তৃণমূলে হতাশা ও বিভক্তি, সবমিলিয়ে নির্বাচন নিয়ে তাদের কৌশল সম্পূর্ণ অস্পষ্ট।

এমন অবস্থায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কতটা শক্তিশালী ও ভারসাম্যপূর্ণ হবে- এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সংশয় তৈরি হয়।

৩. ট্রানজিশনাল প্রশাসন- যেখানে স্থিতিশীলতা এখনো দূরের লক্ষ্য

দলের নিয়ন্ত্রণমুক্ত প্রশাসন গড়াই ছিল জুলাই-পরবর্তী রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সবচেয়ে জরুরি কাজ। কিন্তু ১৫ বছর ধরে গড়ে ওঠা আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক রাতারাতি ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও দেখা যাচ্ছে-

-জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনে পুরনো প্রভাব এখনো কার্যকর;

-মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার নতুন আচরণবিধিতে অভ্যস্ত হতে সময় নিচ্ছেন;

-অনেক এলাকায় পুলিশ প্রশাসন এখনো ‘ট্রানজিশনাল শক’-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

ফলে নির্বাচনকালীন পরিচালনা, প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের ভূমিকা, ফল গণনা, ফলাফল ঘোষণা- সবক্ষেত্রেই প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন উঠছে।

রাষ্ট্রযন্ত্র যখন নিজেই পরিবর্তনের পথে থাকে, তখন নির্বাচন একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।

৪. নির্বাচন কমিশনের টেকনিক্যাল সীমাবদ্ধতা অব্যাহত

নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিলেও তাদের কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি শক্তিশালী বলে প্রমাণিত নয়।

একাধিক সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ছে :

-ভোটার তালিকার ডিজিটাল সিস্টেম এখনো অসামঞ্জস্যপূর্ণ;

-উপজেলা পর্যায়ে পুরনো রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক সক্রিয়;

-পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং ও দ্রুত বিচার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা;

-নির্বাচনকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও রোলআউট প্রক্রিয়া এখনো অসম্পূর্ণ।

একটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে ইসির প্রতি জনগণের আস্থার ওপর। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন প্রক্রিয়ার পর নাগরিক আস্থা এক ধাক্কায় ফিরে আসা কঠিন।

৫. ত্রিমুখী আন্তর্জাতিক চাপ : ‘ডুয়াল ম্যান্ডেট’ অবস্থা

বাংলাদেশের নির্বাচন এখন কেবল অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের অংশ।

ঢাকা বর্তমানে তিন দিক থেকে চাপের মুখে-

-যুক্তরাষ্ট্র চায় গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট নিশ্চিত হোক; একই সাথে রক্ষিত হোক তার কৌশলগত স্বার্থ।

-ভারত চায় সীমান্ত-নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকুক; সেইসাথে আগের সময়ের কানেকটিভিটি ও অন্যান্য চুক্তির পরিপালন অব্যাহত থাকুক। আর সহানুভূতিশীল রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসুক।

-চীন চায় নিজেদের অর্থনৈতিক উপস্থিতি ও বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখতে। একই সাথে প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় থাকুক।

এই তিন শক্তির নীতি, স্বার্থ ও প্রয়োজন এক নয়। ফলে নির্বাচনকে ঘিরে কূটনৈতিক বার্তা, বিবৃতি, শর্ত এবং লবিং সবই রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত ও সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করছে।

প্রশ্নগুলো তাই তীব্র হচ্ছে-

-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা কোনো ম্যান্ডেট নিয়ে বাংলাদেশে আসবে?

-আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে নির্বাচনকে কতটা ‘গণতান্ত্রিক স্ট্যান্ডার্ড’ মেনে চলতে হবে?

-কৌশলগত জোট-রাজনীতির কারণে কোনো বাহ্যিক চাপ কি নির্বাচনের গতিপথ বদলে দিতে পারে?

এই অনিশ্চয়তা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও অস্থির করে তুলেছে।

৬. অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা নির্বাচনকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে

২০২৪-২৫ সালের আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি তদন্ত ও প্রশাসনিক পুনর্গঠনের কারণে অর্থনীতি এক কঠিন পর্যায়ে আছে।

যা দেখা যাচ্ছে-

-ব্যাংকিং খাত এখনো উচ্চ ঝুঁকিতে;

-আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা পুরোপুরি হয়নি;

-বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এখনো কিছুটা চাপ রয়ে গেছে;

-নতুন বিনিয়োগ প্রায় থেমে গেছে;

-রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছে।

আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলো পরিষ্কার করেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর না হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু করতে পারবে না।

অর্থনীতি যখন দুর্বল থাকে, তখন ভোটারদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও অস্থির হয়ে ওঠে এবং নির্বাচনী ফলাফলেও তার প্রতিফলন ঘটে।

৭. নাগরিক আস্থাহীনতা- সবচেয়ে বড় অদৃশ্য সঙ্কট

সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে নাগরিক আস্থা, যা এখনো পুরোপুরি পুনর্গঠিত হয়নি।

কেন সেটি হয়নি?

১. একতরফা ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা মানুষকে সন্দিহান করে তুলেছে।

২. রাজনীতিতে আস্থার সঙ্কট এত গভীর যে দল বদল, নেতৃত্ব বদল, এমনকি শাসন পরিবর্তনও এখন আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে আস্থা জন্মাতে পারে না।

৩. সমাজে এখনো রাজনৈতিক বিভাজন তীব্র, যা নির্বাচনকালীন উত্তেজনা বাড়াতে পারে। বাংলাদেশ এখন মূলত একটি ‘ভঙ্গুর ভারসাম্যের রাষ্ট্র’ যেখানে রাজনৈতিক সিস্টেম বদলেছে, কিন্তু জনমনে সেই পরিবর্তনের স্থায়িত্ব এখনো প্রতিফলিত হয়নি।

নির্বাচনের মান নির্ধারণ করবে তিনটি মৌলিক প্রশ্ন-

১. প্রশাসন, নিরাপত্তা যন্ত্র ও নির্বাচন কমিশন- এরা কি পুরোপুরি নিরপেক্ষ থাকতে পারবে?

২. জুলাই-পরবর্তী সব বড় রাজনৈতিক দল কি অংশ নেবে- নাকি কেউ বয়কটের পথে যাবে?

৩. নাগরিক আস্থা কি যথেষ্ট পুনরুদ্ধার হবে যাতে ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে উদ্বুদ্ধ হয়?

এই তিন প্রশ্নের যেকোনো একটিতে ব্যর্থতা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কটে ফেলতে পারে।

সমাপনী কথা : সংশয়- একটি স্বাভাবিক কিন্তু চ্যালেঞ্জিং পরিণতি

বাংলাদেশ এখনো স্পষ্টভাবে ট্রানজিশনাল ডেমোক্র্যাসির ভেতরে রয়েছে। রূপান্তরের এই পর্যায়ে সংশয় থাকা স্বাভাবিক, এমনকি অবশ্যম্ভাবী। এই সংশয় কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা নয়- বরং পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার দীর্ঘদিনের অস্থিরতা, বিভাজন ও ভুলনীতির প্রাকৃতিক প্রতিফলন।

যদি ২০২৬ সালের নির্বাচন-

-শান্তিপূর্ণ হয়,

-অংশগ্রহণমূলক হয়,

-আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়,

-এবং সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ যদি মনে করে- ‘এই ভোট আমার ভবিষ্যৎ বদলাতে পারে,’

তাহলে সেটিই হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনর্জন্মের সূচনা।

কারণ এ নির্বাচন শুধুই একটি নির্বাচন নয়, এটি বাংলাদেশের পরবর্তী দশকের রাষ্ট্র-রাজনৈতিক দিকনির্দেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আর এর মূলে ঝুঁকি হয়ে রয়েছে- কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি এবং পূর্ববর্তী দেড় দশকের প্রতিবেশী আধিপত্যের নিয়ন্ত্রক কাঠামোতে বাংলাদেশকে আবার ফিরিয়ে নেয়ার সন্তর্পণ প্রচেষ্টা।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত