হত্যা, গুম আর নির্বাচনের নামে অবিরাম তামাশাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেছিল ভারত। এসবে মোটেও উদ্বিগ্ন হয়নি দেশটি। এখন আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করায় ভারত উদ্বিগ্ন। এখন বলছে না, আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অবস্থাদৃষ্টে এটি এখন তাদের বিষয় হয়ে গেছে। তার চেয়েও বড় কথা আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে বিষয়টি কেমন?
এ প্রশ্নে জবাবের অপেক্ষা তিনি রাখেননি। নৌকাডুবি হয়-হচ্ছে অবস্থাতে বাই-বাই, টাটা দিয়ে মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়েছেন তিনি। নামও আংশিক বদলে ফেলেছেন। নমুনায় মনে হয় তার জ্ঞান ও পড়াশোনার ব্যাপক প্রচারণা বা এর বিপরীতে যত সমালোচনা হোক, রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি উপন্যাসটি তার জন্য বেশ মানানসই। এটি রবীন্দ্রনাথ রচিত একটি সামাজিক উপন্যাস। এটি লেখা হয়েছে জটিল পারিবারিক কিছু সমস্যা ঘিরে। পাঠকপ্রিয় উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপ দেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ।
হাসিনাপুত্র জয়ের দশা একটু ভিন্ন। মা-বোন যে যেখানে থাক, তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব পেরেছেন এটা তার আপাতত প্রাপ্তি। ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। শীর্ষ নেতারাও প্রায় সবাই ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছেন। অনেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে অন্তরীণ। এর মধ্য দিয়ে দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। সারা দেশের নেতাকর্মীরাও দিগ্ভ্রান্ত। এ অবস্থায় দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার ক্ষীণ সম্ভাবনা শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং ভুল সিদ্ধান্তে শেষ হয়ে গেছে।
১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ তছনছ হয়ে যায়। দলেও ভাঙন দেখা দেয়। প্রশ্ন উঠেছিল আদর্শের উত্তরাধিকার নাকি রক্তের উত্তরাধিকার দলের নেতৃত্বে আসবে। এমন বাস্তবতায় ১৯৮১ সালের ১৭ মার্চ দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। দায়িত্ব নিয়ে সারা দেশে দল পুনর্গঠনে কাজ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে অর্থাৎ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০১-০৬ ক্ষমতার বাইরে থাকলেও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন নেতাকর্মীরা।
ছাত্র-জনতার দাবি ও আন্দোলনের মুখে দলটির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদি ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেস-সহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’
এক দিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, আরেক দিকে জয়ের মার্কিন নাগরিকত্ব। বেশ জমে উঠেছে। শেখ হাসিনার পরে যাকে দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি মনে করা হতো। জয় স্থায়ীভাবে দেশের বাইরে বসবাস করলেও সব সময় তাকে দেশ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির ‘ফ্রন্টলাইনে’ রাখার চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাকে নিজের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা করেছিলেন। দেওয়া হয়েছিল দলের সদস্য পদও। বক্তৃতা-বিবৃতিতে সরকার ও দলে জয়ের মেধা, শিক্ষা তথা ‘অবদানের’ কথা প্রায়ই জানানোর মাধ্যমে তাকে মূলত দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো।
বিগত বছরগুলোতে দল ও সরকারে জয়ের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। নির্বাচনের আগে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী দিতেন আওয়ামী লীগ শতকরা কত শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করবে। পাশাপাশি ‘জয়ের কোটা’য় ক্যাবিনেটে মন্ত্রী এবং সংসদে এমপি থাকার আলোচনা ছিল দলের ভেতর-বাইরে ওপেন সিক্রেট। বিশেষ করে আইসিটি সেক্টরসহ আরো বেশ কয়েকটি সেক্টর পুরোটাই ছিল জয় ও তার পছন্দের লোকদের ‘নিয়ন্ত্রণে’। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনেও ছিল একই অবস্থা। পুরনো আওয়ামী লীগারদের পাশাপাশি সজীব ওয়াজেদ জয়ের অনুসারী হিসেবে পরিচিত একটি গ্রুপকেও সব সময় লাইম লাইটে রাখা হতো। এর মধ্য দিয়ে মূলত সব পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঝে এ বার্তাই দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে জয়ই দলের হাল ধরবেন। অথচ ঠিক যে দিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করল সেই দিনই কাকতালীয় নাকি পূর্বপ্রস্তুতি তা জানা যায়নি ওয়াশিংটন ডিসির ইউএস সিটিজেনশিপ সেন্টারে আয়োজিত এক নাগরিকত্ব শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন সজীব ওয়াজেদ জয়। শপথ অনুষ্ঠান শেষে তাকে নাগরিকত্ব সনদপত্র দেয়া হয়। এর পরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। ওই শপথ অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ২২ ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। এদের মধ্যে তিনজন ছিলেন বাংলাদেশী, যাদের একজন জয়। বাংলাদেশের নাম ঘোষণা হওয়ার পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে তিনি শপথ পাঠ করেন।
দলের চরম দুঃসময়ে জয়ের ‘দেশ ত্যাগ’ আওয়ামী লীগের নৌকাকে পুরোপুরি ডুবাল। দলের নেতাকর্মীদের কাছে কষ্টের হলেও এটিই বাস্তব। নিয়তির খেলাও বলছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের হাতেই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু হয়। এখন ওই দলই নিষিদ্ধ হল। সেই সাথে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও স্থগিত। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার মতো তিনটি আইন রয়েছে বাংলাদেশে। এর দু’টিই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন পাস করা হয়েছে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯। আওয়ামী লীগ প্রণীত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলো। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার মতো আরেকটি আইন হলো পলিটিক্যাল প্র্যাকটিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে ক্ষমতাসীন হয়ে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের তিনটি অংশ, পিডিপিসহ সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের নামে এসব দল নিষিদ্ধ করা হয়।
স্বাধীনতার পর মতিন আলাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি ও আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টিসহ সব চীনপন্থী কমিউনিস্ট নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একদলীয় শাসন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) কায়েম করেন শেখ মুজিব। আওয়ামী লীগের শাসনামলে, ২০১৩ সালে হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেন। ২০১৮ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। যেসব অভিযোগে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সরকারের আমলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি অপরাধ করেছে আওয়ামী লীগ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সেই দলটিকে নিষিদ্ধ করায় এখন ভারতের উদ্বেগ। এটি এখন আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; কারণ ভারত মনে করে, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে যে পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার তা অনুসরণ করেনি। নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে এ মন্তব্য করেন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল।
ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিং কিছু দিন বন্ধ ছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তা আবার শুরু হয়। আর এ শুরুটাতেই আওয়ামী লীগের প্রতি দরদ প্রকাশ। বাংলাদেশে বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা এখানে একক কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। একই সাথে সবার ক্ষেত্রে মুক্ত ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে। পাশাপাশি সবার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়া সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে অংশীদারত্ব গভীর করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এভাবে বলার পর আর বুঝতে বাকি থাকে না আওয়ামী লীগের ‘যে নৌকা ডুবে গেছে তা আর সহসাই ভাসবে না’ আর তা অন্য অনেকের চেয়ে বেশি জানেন-বোঝেন হাসিনাপুত্র জয়। বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ অবহিত বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রিন্সিপাল ডেপুটি মুখপাত্র থমাস টমি পিগোট। জয়েরও কি তা জানার বাইরে? অবস্থারদৃষ্টে নৌকা ডুবল না ভাসল, তা দেখার সময় কই তার?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]