বিপন্ন অভিযাত্রা

জুলাই ছাত্র-গণবিপ্লবকে রাজনীতির মুখ্য নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য ঘোষণা এবং বাস্তবায়ন, পরিকল্পনা ও দায়বদ্ধতার নিশ্চয়তা ছাড়া এটি সম্ভব নয়। কোনো একক রাজনৈতিক দলের পক্ষে এটি সম্ভব না হওয়াই স্বাভাবিক। বিকল্প হতে পারে জাতীয় সরকার, নতুবা ১৯৭০ সালের খবমধষ ভৎধসবড়িৎশ (খঋঙ) এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

৩৬ জুলাইয়ের ছাত্র-গণবিপ্লব এ দেশের আপামর জনতাকে মুক্তি দিয়েছে, এনে দিয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তবে এর শেষটা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় ঘনীভূত হচ্ছে। সম্ভাব্য নির্বাচন নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে আশা-নিরাশার দোলাচল, যা নিঃসন্দেহে পতিত শক্তিকে সংঘটিত হওয়ার, প্রকাশ্যে আসার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। ছাত্র গণবিপ্লবকে অস্বীকার করার, ষড়যন্ত্রের ফসল বলা, বিপ্লবের সাথে সম্পৃক্তদের রাজাকারের বংশধর বলার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাটা ইঙ্গিত দিচ্ছে- সব ঠিক নেই। জুলাই বিপ্লবের চেতনা পাশ কাটিয়ে জুলাই ঘোষণাও একই ইঙ্গিতবহ। আহত নিহতদের বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় মনে হচ্ছে ‘দিল্লি দূর অস্ত’।

ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পতিত শক্তির সহযোগীদের পুনর্বাসন জুলাই বিপ্লবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এসব ব্যাপারে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই; না সরকারের, না জাতীয় নেতাদের। রাজনৈতিক অঙ্গন এখন রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্র। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও বৈরী আচরণ দেখার জন্য জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। প্রাজ্ঞ নেতারা ভুলে গেছেন, বিপ্লবপূর্ব বারবার উচ্চারিত জাতীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি। জাতীয় সরকার এখন বিস্মৃত একটি শব্দ। অপাঙক্তেয় উচ্চারণ। অথচ জাতিকে আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়েছিল দই বছরের জন্য একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠিত হবে; যারা পরামর্শ ও পর্যালোচনার আলোকে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও আইন সংস্কার করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। অন্যায়-অত্যাচার, গুম, অর্থপাচারের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচারের ব্যবস্থা করবেন। ছাত্র গণহত্যা ও পঙ্গু করে দেয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দ্রুততম সময়ে বিচারের মুখোমুখি করবেন। সংস্কারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে ঢেলে সাজাবেন নতুন বাংলাদেশ গড়ার আলোকে। অথচ এখন সব কিছু ভুলে দলীয়-নির্বাচন, দলীয় সরকারের চিন্তায় একে অপরের সাথে অসহিষ্ণু আচরণে জড়িয়ে পড়ছেন, যা জাতিকে হতাশ করছে। রাজনীতিতে মতবিরোধ থাকবে- এটিই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তা শালীনতা ও শ্রদ্ধার সীমা পেরোবে না- এটিই প্রত্যাশিত। রাজনীতির এই দ্বিচারিতা ও অস্থিরতার সুযোগে কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব হয়ে যাচ্ছে আমলাকেন্দ্রিক।

রাজনৈতিক নেত্বত্বের ভূমিকা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এরই জেরে জুলাই বিপ্লবের বিরোধী আমলারা সদর্পে অবস্থান করছেন সচিবালয়ে আরো অধিক ক্ষমতা ও দাপটে। পুলিশ বাহিনীতেও একই অবস্থা। তারা ঠেকিয়ে দিচ্ছেন জুলাই বিপ্লবের বাস্তবতাকে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকেন্দ্রিক ভূমিকা এর উদাহরণ। মনে হচ্ছে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের নয়া সমীকরণ মেনে নিতে পারছেন না। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর সাধারণ শিষ্টাচারও তিনি ভুলে গেছেন।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। অথচ তার দায় সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা- রাজনৈতিক বিতর্কে জড়ানো নয়। আবার হুমকিও দিয়েছেন পদত্যাগের। আসলে এসব আচরণে বোঝা মুশকিল- সরকার কে চালাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন নাকি অন্য কেউ? নির্বাচন কমিশন একটি স্বশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার তাদের কাজের জন্য সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ। এর বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করা তাদের পক্ষে অনুচিত। রাজনৈতিক চাপ, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, অসহযোগিতা ও জটিলতার ঘেরাটোপে এখন অসহায়ভাবে বন্দী প্রধান উপদেষ্টা ক্ষমতায় থাকবেন কি না ভাবছেন। বিশেষ মহল থেকে প্রচ্ছন্ন হুমকির ব্যাপারটি তো সর্বজনবিদিত।

জুলাই বিপ্লব অস্বীকার, এর নেতাদের অশালীন গালিগালাজ রাজনৈতিক জটিল মারপ্যাঁচ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা, আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি বা অসহযোগিতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপর্যাপ্ততা সর্বোপরি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের রাজনৈতিক বিতর্কে জড়ানো সব কিছু দেখে জাতি ও জনগণ স্পষ্টই হতাশ, শঙ্কিত। এ ক্ষেত্রে জাতীয় সরকার একটি বিকল্প হতে পারে। দুই বছরের জন্য সর্বসম্মত সীমিত সংখ্যক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে হতে পারে এই সরকার। তারা প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়ন, জুলাই বিপ্লবের ক্ষতিগ্রস্তদের সামাজিক আইনি সুরক্ষা প্রদান, অপরাধীদের যথোপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থাসহ জুলাই ঘোষণাপত্রকে সার্বিক চরিত্র প্রদান করবেন। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে নির্বাচনের আয়োজন করবেন। মনে রাখা দরকার- লুটপাট, দখলদারি, চাঁদাবাজি, মববাজি করার সুযোগ দেয়ার জন্য বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছে সুখী সুন্দর উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়ার জন্য। জনতার আকাঙ্ক্ষাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ করতে না পারলে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ব্যর্থ হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। জুলাই ছাত্র-গণবিপ্লবকে রাজনীতির মুখ্য নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য ঘোষণা এবং বাস্তবায়ন, পরিকল্পনা ও দায়বদ্ধতার নিশ্চয়তা ছাড়া এটি সম্ভব নয়। কোনো একক রাজনৈতিক দলের পক্ষে এটি সম্ভব না হওয়াই স্বাভাবিক। বিকল্প হতে পারে জাতীয় সরকার, নতুবা ১৯৭০ সালের খবমধষ ভৎধসবড়িৎশ (খঋঙ) এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ