১৯২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের উত্তর প্রদেশের লখনৌ শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের। সংগঠনটির এখন শতবর্ষ পূর্তি। হিটলারের নাৎসিবাদ এই দলের যেমন প্রধান অস্ত্র, তেমনি হিটলারের আর্যতত্ত¡¡ হলো তার প্রধান অনুসরণীয় দিক। যা আরএসএসএসের মনুবাদ বা ব্রাহ্মণ্যবাদ। এক কথায় উচ্চ বর্ণবাদ। আরএসএসের আগে ১৯২০ সালে হিটলার জার্মানিতে প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (নাৎসি বা নাজি পার্টি) আর্য শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়েই।
আরএসএস ঘোষণা দিয়েছিল তাদের শত্রু তিনটি। এরা হলো যথাক্রমে, কমিউনিস্ট বা বামপন্থী, ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমান ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী খ্রিষ্টান। হিন্দুরাষ্ট্র গঠন তার প্রধান উদ্দেশ্য। ১৯৩১ সালে আরএসএস নেতা বি এস মুঞ্জে ইতালিতে মুসোলিনির সাথে দেখা করে সেখানকার ফ্যাসিস্ট যুব সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির বা ‘বালিল্লা’ দেখে এসে ১৯৩৫ সালে মহারাষ্ট্রের নাসিকে হিন্দু যুব প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলেন। ১৯৪০ সালে হিটলারের অনুসরণে আরএসএস নেতা এম এস গোলওয়ালকার বলেন, আরএসএস এক পতাকা, এক নেতা, এক আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের প্রতিটি কোণায় হিন্দুত্বের মশাল জ্বালাবে।...গণ-নিধনযজ্ঞের বিষয়টি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য বেশ কার্যকর।
এখানে আরো একটি কথা বলে নেয়া দরকার। তা হলো, কলকাতা যেমন প্রগতিশীল মুভমেন্ট, নবজাগরণ, স্বাধীনতা আন্দোলন বা ‘সিটি অব জয়’-এর ক্ষেত্রভূমি তেমনি এই কলকাতা হিন্দুত্ববাদেরও ক্ষেত্রভূমি। কলকাতা যেমন রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কাজী ইসলামের শহর, তেমনি এই শহর ইংরেজ বেনিয়া ও জমিদার-সামন্ত প্রভুদের। এই শহরেই অনেক ব্রিটিশ দালাল, সাম্রাজ্যবাদ ও ব্রিটিশভক্ত ও লেখকদের জন্ম দিয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকে যারা আকুণ্ঠ সমর্থন করেছে তারাই তো আমাদের দেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদের জন্ম দিয়েছে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, তারাই আমাদের দেশের মৌলবাদের জনক। তাই দেখা যায়, পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজের পরাজয়ের পর খুশিতে টগবগ কলকাতার জমিদার সামন্ত-প্রভুরা দুর্গা উৎসব করেন লর্ড ক্লাইভকে সন্তুষ্ট করার জন্য। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করে ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করে কলকাতা থেকে প্রকাশিত অনেক সংবাদপত্র। তাদের অন্যতম হলেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকরের ভূমিকা কি আমরা ভুলে যেতে পারি? গুরু ঈশ্বর গুপ্তের পথকেই সেদিন অবলম্বন করেছিলেন সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্যে হিন্দুত্ববাদকে তিনি এক অনন্য মাত্রা দেন। এই কলকাতার বুকেই গড়ে উঠেছিল আর্যসমাজ, হিন্দু আত্মরক্ষা সমিতিসহ আরো কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। ১৮৭২ সালে গড়ে ওঠা হিন্দু মেলা হলো হিন্দুত্ববাদের প্রধান উৎসভূমি। সেই হিন্দু মেলা থেকেই একের পর এক জন্ম নিয়েছে হিন্দু মহাসভা, হিন্দু পরিষদ তথা আরো অনেক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, আমরা হিন্দু, আমরা বাঙালি হিন্দু, হিন্দু সংহতি, বঙ্গ সেনা, লিবারেশন টাইগার অব বাংলাদেশ, দুর্গা বাহিনীসহ ৩৫৩টি অঙ্গ সংগঠন হলো আরএসএসের। হিন্দু মহাসভার নেতাই তো শ্যামাপ্রসাদ। একসময় হিন্দু মহাসভা আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে কাজ করত। পরে আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা হয় জনসঙ্ঘ। ১৯৮০ সাল থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা।
এই বিজেপি নব্বইয়ের দশকে রামমন্দির-বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করেই রথযাত্রা করে তার শিকড় বিস্তার করে। ১৯৯২ সালে উন্মত্ত করসেবকরা সে দিন বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সামনেই ৫০০ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছে। আজ সেটি রামমন্দিরে পরিণত। ১৯৯৬ সালে বিজেপি ১৩ দিনের সরকার চালায়। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত অটলবিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ও প্রধানমন্ত্রিত্বে দেশ চালায় বিজেপি। ২০১৪ সাল থেকে এ যাবৎ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ও প্রধানমন্ত্রিত্বে বিজেপি ক্ষমতায়। তবে ২০২৪ সালে বিজেপি যে ৪০০ আসনের স্বপ্ন দেখেছিল তা চুরমার হয়ে গেছে। বিজেপির প্রধান কাজ হলো, এক দেশ এক ধর্ম, এক দেশ এক ভাষা, হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান। আরএসএসের মনুবাদী দর্শনকে সে কার্যকর করতে চায়।
নিজের দর্শন চ্যালেঞ্জে যে কাউকে আরএসএস বা ক্ষমতাসীন বিজেপি দেশদ্রোহী তকমা দিচ্ছে। অথচ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে শহীদদের তালিকায় আরএসএসের কোনো নাম নেই। আরএসএস নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার ১৯১১-২৪ সাল পর্যন্ত আন্দামান সেলুলার জেলে ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঁচবার ক্ষমা প্রার্থনা করে আবেদন করেছিলেন। সালগুলো হলো, ১৯১১, ১৯১৩, ১৯১৪, ১৯১৮ ও ১৯২০। বিনায়ক দামোদর সাভারকার বলেছিলেন, ও ধস ৎবধফু ঃড় ংবৎাব এড়াবৎহসবহঃ (ইৎরঃরংয) রহ ধহু পধঢ়ধপরঃু ঃযবু ষরশব, ভড়ৎ ধং সু পড়হাবৎংরড়হ রং পড়হংপরবহঃরড়ঁং ংড় ও ঐড়ঢ়ব সু ভঁঃঁৎব পড়হফঁপঃ ড়িঁষফ নব.
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক এক পর্যায়ে কাকড়ি ষড়যন্ত্র ১৯২৭, লাহোর ষড়যন্ত্র ১৯২৮, দিল্লি বিধানসভা বোমা মামলায় ১৯২৯ বন্দী দেশপ্রেমিক বিপ্লবী ভগৎ সিং ক্ষমা প্রার্থনার একাধিক ব্রিটিশ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। আর পাঞ্জাব হিন্দু মহাসভার সাক্ষ্যদানে ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি হয় ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ। একদিকে ব্রিটিশদের চরবৃত্তি, অন্যদিকে ব্রিটিশদের দালালি ও দোসরগিরি করেই ক্ষান্ত হয়নি আরএসএস, তার শতবর্ষের ইতিহাসটিও দাঙ্গা ও দাঙ্গাবাজের ইতিহাস। আসুন, সে দিকেও আমরা নজর দিই।
আরএসএস জন্মলগ্ন থেকে ব্রিটিশবিরোধী কোনো আন্দোলন করেছে? কোনো নথি রয়েছে? কেবল দাঙ্গা করেছে। জব্বলপুর দাঙ্গা-১৯৬১ (নিহত দুই শতাধিক), গুজরাট দাঙ্গা-১৯৬৯ (নিহতের সংখ্যা ৬৬০), ভাগলপুর দাঙ্গা-১৯৮৯ (নিহত এক হাজার ৭০, আহত ৫২৪), ১৯৯০ সালে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির রথযাত্রা (নিহত সহস্রাধিক), ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর আরএসএস-বিজেপির মদদে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস উন্মত্ত করসেবকদের হাতে (নিহত তিন হাজার), বাবরি মসজিদ ধ্বংস-পরবর্তী সময়ে ৩০০-এর কাছাকাছি মসজিদ-মাজার ধ্বংস, ১৯৯২-৯৩ সালে মুম্বাই দাঙ্গা (যেখানে ৯ শতাধিক মানুষ খুন), ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যা (দুই সহস্রাধিক মানুষ নিহত), ২০১৩-তে মুজফফরনগর দাঙ্গার ১৬২ জন নিহত ও ৫০ হাজার ঘরছাড়া হন। ১৯৮২ সালের আসামের নেলি গণহত্যা। এটিও সেই হিন্দুত্ববাদীদের আরেকটি সফল ষড়যন্ত্র। ১৯২৫-২০২৫ পর্যন্ত আরএসএসের দাঙ্গার ইতিহাস। ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গার পেছনে শুধু মুসলিম লীগের একার হাত ছিল না, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের খলনায়ক বলা হলেও এই দাঙ্গার পেছনে ব্রিটিশ, হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদীদের ষড়যন্ত্রের কথা অস্বীকার করা যায় না। এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাট গণহত্যা কার্যকর করেন; গুজরাটের সাতবারের জাতীয় কংগ্রেসের সংসদ সদস্য গান্ধীবাদী নেতা এহেসান জাফরিকে সপরিবারে আগুনে পুড়িয়ে খুন করে আরএসএস-বিজেপি। তার পরিবার আজো বিচার পায়নি। বিচার পাননি বিলকিস বানু ও জাহিরা শেখরাও।
১৯৩৯ সালের ২২ মার্চ ব্রিটিশ আমলেই এই বাংলার বুকে আরএসএস তাদের শাখা সম্প্রসারিত করে ও সাংগঠনিক ভিত্তি স্থাপন করে। ব্রিটিশ জমানায় কলকাতায় আরএসএসের দুই বিখ্যাত মারাঠি নেতা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর ও বিঠল রাও পাটকি কলকাতার মানিকতলা এলাকার তেলকল মাঠে হিন্দু নববর্ষের প্রথম দিনে এটি হয়। এটি ছিল হিন্দু নববর্ষ বিক্রম-সংবতের চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের প্রথম দিন। বিক্রম সংবত হলো হিন্দু চান্দ্র-সৌর পঞ্জিকা। নেপাল ও ভারতের কিছু অংশে চালু রয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭ অব্দে শুরু হয়। রাজা বিক্রমাদিত্য এই সনের প্রতিষ্ঠাতা। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা নববর্ষের পাল্টা এই সন। যাই হোক, এই বাংলার মাটিতে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তাদের অনুকূল ও প্রতিকূল দুটো পরিস্থিতিই তৈরি হয়। এরই মধ্যে বাংলা ভাগ ও ভারত ভাগ। ১৯৫৩ সাল থেকে কমিউনিস্ট তথা বামপন্থী সংগঠনগুলোর প্রসার ঘটতে থাকলে আরএসএস খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গে সে রকম সুবিধা করতে পারেনি। ১৯৬৭, ১৯৬৯, ১৯৭১ বামপন্থীদের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার, ১৯৭৭-২০১১ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে আরএসএস খুব সুবিধা করতে পারেনি। ২০১১ সাল থেকে এই ২০২৫ পর্যন্ত শতবর্ষে আরএসএস খোদ পশ্চিমবঙ্গে ১০ হাজার শাখা খুলেছে। কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে এই আরএসএস প্যারেড করেছে। কলকাতার শহীদ মিনার ময়দানে কয়েকবার সমাবেশও করেছে। এই আরএসএসকে বিজেপি সরকার সিলেবাসভুক্ত করে তাদের দেশপ্রেমকে বড় করে দেখাচ্ছে। কত মাজার, কত মসজিদ বা গির্জা নিধন করেছে তার হিসাব নেই। মবলিঞ্চিং এখন একটি সাধারণ ব্যাপার। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেসের ভূমিকাকেও তারা লঘু করে দেখছে বা কোথাও কোথাও সিলেবাস থেকে বাদ দিচ্ছে। এ যেন একবারেই হিটলারি নৃশংসতা। হিটলারের নাৎসিবাদের বর্বরতা। আজ ক্ষমতার বলে খোদ বাংলাদেশেও তারা আরএসএসের সংগঠন প্রসারিত করেছে। ওখান থেকে ভারতে অনেক কল্পকাহিনীও আমদানি করা হচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি



