ইনসাফভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্রের একটি রূপকল্প

একটি ইনসাফপূর্ণ কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আরো বহু পদক্ষেপ নিতে হবে যা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা কঠিন কাজ। তবু একটি কাঙ্ক্ষিত ইনসাফভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক রূপকল্প এখানে তুলে ধরা হলো।

বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি যে একটি ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে তা আগের দু’টি পর্বে আলোচনা করেছি। এমনকি এর বিকল্প হিসেবে যে কল্যাণরাষ্ট্র ও উন্নয়ন অর্থনীতির কথা বলা হয় তার সীমাবদ্ধতা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের অর্থনৈতিক বা উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ করা দরকার আজকে তার ওপর আলোকপাত করা হবে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারণা অষ্টাদশ শতকে শিল্পবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে বিকশিত হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারণা আরো পরে বাস্তবতা পায়। কল্যাণরাষ্ট্র বা উন্নয়ন অর্থনীতির মডেল হচ্ছে সবচেয়ে নবীন। আমরা আগেই বলেছি, আলোচ্য অর্থনীতির তত্ত¡¡গুলো ছিল নিছক বস্তুবাদী ও তথাকথিত বৈজ্ঞানিক দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রায়োগিকভাবে এর প্রতিটি মডেল অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে পারেনি। বিভিন্ন দেশে ব্যাপক অবকাঠামো এবং প্রবৃদ্ধি ঘটলেও নৈতিকতা ও ন্যায়পরতার নীতি সব ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে। মানুষের আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে নৈতিকতার যে গুরুত্ব তা অনেক দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ যথার্থ উপলব্ধি করেছেন।

অর্থনীতিবিদ শুমপেটার দুঃখ করে বলেছেন, ‘পুঁজিবাদ এমন একপ্রকার যুক্তিবাদী কাঠামো তৈরি করে যা অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের নৈতিক কর্তৃত্ব ধ্বংস করার পর অবশেষে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানকেও সমর্থন করে না’। বাজার অর্থনীতির করুণ পরিস্থিতি দেখে একদল পাশ্চাত্য অর্থনীতিবিদ ‘ইকোনমিক্স ইন দ্য ফিউচার : টুওয়ার্ডস অ্যা নিউ প্যারাডাইম’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মানব জাতির এক বিরাট অংশের মধ্যে বণ্টন-সংক্রান্ত ন্যায়বিচার, স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি, ভারসাম্যপূর্ণ মানবিক উন্নয়ন, সামাজিক শান্তি ও আঞ্চলিক সমতা নিশ্চিত করতে আধুনিক অর্থনীতি ব্যর্থ হয়েছে। সেই সাথে দেশে দেশে দীর্ঘকালীন মন্দা, লাগামহীন বেকারত্ব, স্থবিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রা সরবরাহ, দেশী ও বিদেশী ঋণের বিশাল পাহাড়, প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরে এবং জাতিগুলোর মধ্যে অতি প্রাচুর্য ও অতি দারিদ্র্যের মুখোমুখি বিপজ্জনক অবস্থানের মোকাবেলা করছে আধুনিক অর্থশাস্ত্র। ব্যক্তিগত ও সরকারি- উভয় পর্যায়ে নৈতিক মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক বিচার বিবেচনা ও আচরণের মধ্যস্থিত সম্পর্ক যা হাজার বছর ধরে মানবতা টিকিয়ে রেখেছিল, ইহজাগতিক পুঁজিবাদী উত্থানের যুগে তা ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ উভয়ে এখন সেই হারানো নৈতিক সম্পর্ক খুঁজে পেতে চেষ্টা করছেন’।

‘ফিউচার ওয়েলথ : অ্যা নিউ ইকোনমিক্স ফর দ্য টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি’ গ্রন্থে জেমস রবার্টসন বলেছেন, ‘পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক- উভয় ক্ষেত্রে প্রচলিত অর্থশাস্ত্রের বিপরীতক্রমে, একবিংশ শতকের অর্থশাস্ত্রের ভিত্তি অবশ্যই হবে এরূপ স্বীকৃতির ওপর যে, মানুষ হলো একটি নৈতিক জীব যার স্বাধীনতা বাজারব্যবস্থা ও রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠি দ্বারা সঙ্কীর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত হবে না। স্বনির্ভরতার একটি দিকরূপে একবিংশ শতাব্দীর অর্থনীতিকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, অর্থনৈতিক জীবনে নৈতিক দায়িত্ব ও পছন্দ-অপছন্দ বেছে নিতে মানুষকে তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নতুন অর্থশাস্ত্রকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, মানুষ যেহেতু একটি নৈতিক জীব, সেহেতু অর্থশাস্ত্রের মৌলিক প্রশ্নগুলো হচ্ছে নৈতিক প্রশ্ন।’

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন কৌশল যেহেতু বাজার অর্থনীতির ওপর চলছে, সেহেতু সেখানেও নৈতিক প্রশ্নটি উপেক্ষিত রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নৈতিকতার সংজ্ঞা কী? সেক্যুলার পণ্ডিতরা বলেন, নৈতিকতা তো একটি আপেক্ষিক বিষয়। একজনের কাছে যা নৈতিক, আরেকজনের কাছে তা অনৈতিক বলে গণ্য হয়ে থাকে। সুতরাং প্রশ্নের মীমাংসা কিভাবে হবে? এর জবাব দিয়েছেন আরনল্ড টয়েনবি ও ডুরান্ট। তারা ইতিহাসের ব্যাপক অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, ‘ধর্মীয় অনুশাসন ছাড়া নৈতিক উচ্চমান ও সামাজিক সংহতি অর্জন সম্ভব নয়।’ টয়েনবি মনে করেন, ‘ধর্ম মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়িত্বানুভূতিকে ধ্বংসের পরিবর্তে বৃদ্ধি করে। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধের পূর্বশর্ত হচ্ছে সব মানুষের স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বরের ধারণা।’ ডুরান্ট জোর দিয়ে বলেছেন, ‘ধর্মের সাহায্য ছাড়া কোনো সমাজ উচ্চ নৈতিক মান বজায় রেখেছে, ইতিহাসে এর কোনো উদাহরণ নেই।’ অন্য দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন প্রশাসনের অ্যাটর্নি জেনারেল রামজে ক্ল¬ার্ক যথার্থ বলেছেন, ‘ইসলাম হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণকারী আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তি।’

উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট হয়েছে, কোনো অর্থনীতিতে নৈতিকতার বিষয়টি উপেক্ষিত হলে সেখানে ইনসাফ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ কায়েম করা যায় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্যটি প্রযোজ্য। আমাদের দেশটি যে বারবার দুর্নীতির অন্যতম একটি শীর্ষ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রীয় ও জনগণের সম্পদ লুটপাটের যে মহোৎসব চলেছে তার প্রধান কারণ, দুর্নীতি তথা নৈতিকতার অভাব- এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করতে হলে পুরো জনগোষ্ঠীর নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। নৈতিকতাসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব তথা রাজনীতিবিদ, বিচারক, প্রশাসক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৈরি করা গেলে দুর্নীতি দূর করা সহজ হয়ে যাবে।

ইসলাম যে নৈতিকতা শিক্ষা দেয় তা কিছু বিশ্ববীক্ষণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর তিনটি মৌলিক কথা হচ্ছে- তাওহিদ, খিলাফত ও আদল (ন্যায়বিচার)। মহান আল্লাহ হচ্ছেন একটি সর্বশক্তিমান সত্তা, যিনি একক ও অদ্বিতীয়। তিনি বিশ্বকে পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করেছেন; তা হঠাৎ করে বা দুর্ঘটনাবশত সৃষ্টি হয়নি। তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার পেছনে একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। মানুষ তার একটি অংশ। মানবসত্তা পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি। মানুষ যাতে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে সে জন্য তাকে আধ্যাত্মিক, মানসিক ও বস্তুগত সম্পদে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়েছে। মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

আল্লাহ এ বিশ্বকে যেসব সম্পদে সমৃদ্ধ করেছেন তা সীমাহীন। দক্ষতা ও ন্যায়পরতার সাথে ব্যবহার করা হলে সবার কল্যাণ ও প্রয়োজন মেটাতে তা যথেষ্ট। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ইসলাম যে বিশ্ববীক্ষণের কথা বলেছে তা বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রাধান্য দিয়ে বিরাজ করছে না। এ দর্শন ভুলে গিয়ে তারা ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণায় প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হয়ে আছে। তারা পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী দর্শন আঁকড়ে ধরে আছে। পাশ্চাত্যের মোহ থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মেধা-মনন স্বাধীনভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থা সবার আগে সংস্কার করতে হবে। দুর্নীতি দূর করতে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে নৈতিকতাবোধ তথা পরকালীন জীবনে জবাবদিহির বোধ জাগ্রত করতে হবে। প্রত্যেক উৎপাদনশীল ব্যক্তির কর্মদক্ষতা ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে।

সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে নীতি, আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করতে হবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করার উদ্দেশ্যে সম্পদ বণ্টনের নীতি হতে হবে ন্যায়সঙ্গত। এ বিষয়ে প্রথমে আসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিটি ধাপে প্রফেসর উমার চাপড়ার ভাষায়- ‘নৈতিক ছাঁকনি’ (মরাল ফিল্টার) নিশ্চিত করতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যেসব কাজ হালাল, রাষ্ট্র কেবল সেগুলো উৎসাহিত ও সমর্থন করবে। মানুষের জন্য কল্যাণজনক নয়, এমন সব বিষয় ধাপে ধাপে নিষিদ্ধ করতে হবে। যেমন- সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টির অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে সুদ। যদিও বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা সুদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং তা পুঁজিবাদের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ এবং তাকে হঠাৎ করেই দূর করা সহজ নয়; তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক সহায়তায় সুদের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। করজে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণদানের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কৃষকদের বিনা সুদে কৃষিঋণ দিতে হবে।

প্রত্যেক বিত্তশালী মুসলিমের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাধ্যতামূলকভাবে জাকাত আদায় করতে হবে। শরিয়াহ নির্ধারিত খাতে তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিতরণ করতে হবে। বলাই বাহুল্য, জাকাত হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার অন্যতম একটি কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ। ইসলাম ধনীদের কাছ থেকে দরিদ্রদের কাছে বাধ্যতামূলকভাবে সম্পদ স্থানান্তরের ব্যবস্থা রেখেছে। এক গবেষণা মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর আদায়যোগ্য জাকাতের পরিমাণ হচ্ছে এক লাখ কোটি টাকা। দ্রুততর গতিতে দারিদ্র্যবিমোচন তথা সুবিধাবঞ্চিতদের মৌলিক চাহিদা পূরণে জাকাতব্যবস্থা হতে পারে একটি কার্যকর ব্যবস্থা।

ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া একটি নিয়ামত ও আমানত। এর সুষ্ঠু ও সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য। সে জন্য ব্যয় নীতিমালা তথা বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রজ্ঞার সাথে অগ্রাধিকার নির্ণয় করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাসহ সবাইকে সাদাসিধে বা অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হবে। ভোগ-বিলাসিতা পরিহারের নীতি অনুসরণ করতে হবে। প্রত্যেকের জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রত্যেক কর্মক্ষম নাগরিক যাতে সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত হতে পারে তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে জনবল খাতে ব্যয় না বাড়িয়ে এমন পরিবেশ, নীতি ও সুযোগ তৈরি করতে হবে যাতে বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতে অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে পল্লী এলাকায় কর্মসংস্থানের বহুমুখী সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী বিশেষ করে প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, বিধবা ও শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ইউরোপীয় কল্যাণরাষ্ট্রের আদলে বিভিন্ন ভাতা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এ জন্য যে অর্থের সংস্থান করতে হবে তা জাকাত, সাদাকা ও ওয়াক্ফ বা ট্রাস্টের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হবে। এ মানবকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয় করে তুলতে এবং সরকারের সহযোগী হিসেবে নিতে হবে। এসব কথা শুধু নীতিকথা নয়; মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে তা কার্যকরভাবে চালু রয়েছে। মালয়েশিয়ার কেদাহ রাজ্যের রাজা বিগত তিন শ’ বছর ধরে সেখানকার জাকাত প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যা সেখানকার দারিদ্র্যবিমোচনে টেকসই অবদান রাখছে।

জাতীয় সম্পদ যাতে কোনোভাবে অপচয় না হয় সে দিকে রাষ্ট্রকে সচেষ্ট হতে হবে। সবধরনের অনিয়ম ও অপচয় বন্ধ করতে হবে। এমনকি কৃষি খাতে শস্য প্রক্রিয়াকরণে যে অপচয় হয় তা কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগাতে হবে।

বৈষম্য হ্রাসের অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে বিভিন্ন খাতে সরকারি ভর্তুকি দেয়া। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দরিদ্রদের সুবিধার্থে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি খাতে বিশাল ভর্তুকি দেয়া হলেও দুর্নীতির কারণে তার সুফল লক্ষ্যিত জনগোষ্ঠী পায় না; বরং একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তা লুণ্ঠন করে। এ ক্ষেত্রে একটি ন্যায়ানুগ ও নৈতিকতাসম্পন্ন সরকারের ন্যায়নীতি ও দক্ষতা প্রয়োগের বিকল্প নেই। সরকারি খাতে মৌলিক চাহিদাসংশ্লিষ্ট কিছু সেক্টর করপোরেশন থাকতে হবে, যাতে জরুরি পরিষেবা সরবরাহ সচল রাখা যায়। যেমন- পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি।

প্রোগ্রেসিভ কর-ব্যবস্থা বর্তমানে একটি জনপ্রিয় ধারণা। এ ক্ষেত্রে কর আদায়কারী ও কর প্রদানকারী উভয়কে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নাগরিকরা যাতে কর ফাঁকি না দেয় এবং একইভাবে কর আদায়ের নামে নাগরিকরা যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এক কথায়, একটি ন্যায়ানুগ কর-ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে নাগরিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর দেয়।

আমদানি-রফতানি নীতি হতে হবে অগ্রাধিকারভিত্তিক। বিলাসী ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করতে হবে। যেমন- সিগারেট বা মাদকদ্রব্য। বিলাসী হালাল পণ্যের ওপর উচ্চমাত্রায় করারোপ করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা-সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওপর কর কমাতে হবে। স্থানীয় বাজারে অনৈতিক ব্যবসায় বন্ধ করতে হবে। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও জনগণের সহযোগিতা নিতে হবে। বিভিন্ন কৃষিপণ্যেও বাজারজাত করতে সমবায় গড়ে তুলতে হবে।

সামাজিক বৈষম্য দূর করতে উত্তরাধিকার আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম মৃত ব্যক্তির সম্পদ বণ্টনের যে নীতিমালা দিয়েছে তা ধর্মীয় ও নৈতিক বিবেচনায় অনুসরণ করতে সবাইকে বাধ্য করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের সমাজে নারীরা এক দিকে বিয়ের মোহর থেকে বঞ্চিত হয় এবং অন্য দিকে পিতার সম্পত্তিও ঠিকমতো পায় না। তাই রাষ্ট্রকে নারীর সম্পত্তির অধিকার পাওয়া নিশ্চিত করতে কঠোর আইন করতে হবে।

একটি ইনসাফপূর্ণ কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আরো বহু পদক্ষেপ নিতে হবে যা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা কঠিন কাজ। তবু একটি কাঙ্ক্ষিত ইনসাফভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক রূপকল্প এখানে তুলে ধরা হলো।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব