সবকিছু বদলে যাবে

আফগান তালেবানের সাথে মতবিরোধ, আর আফগান জাতির সম্মান দু’টি ভিন্ন বিষয়। খাইবারপাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানের পাকিস্তানিদের অধিকাংশই আফগানিস্তানের সাথে লড়াই চায় না। তবে আফগান তালেবান যেন শান্তির এই আকাঙ্ক্ষাকে কারো দুর্বলতা না ভাবে এবং পাকিস্তানের শত্রুদের হাতিয়ার না হয়ে যায়।

মাত্র পাঁচ বছরে কী থেকে কী হয়ে গেল। পাঁচ বছর আগে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আশরাফ ঘানি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া এবং আইএসআইয়ের প্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ আফগান তালেবানকে আমেরিকার সাথে আলোচনায় রাজি করান। আশরাফ ঘানি ওই আলোচনার বিরোধী ছিলেন। তারপরেও ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ কাতারের রাজধানী দোহায় আমেরিকা ও আফগান তালেবান একটি শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তি মোতাবেক ১০ মার্চ, ২০২০ থেকে অস্ত্রবিরতি শুরু হয়। আমেরিকাসহ ন্যাটো দেশগুলোর বাহিনী আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনে রাজি হয়। তালেবান ওয়াদা করে, তারা সামরিক শক্তি দিয়ে কাবুল দখল করবে না।

দোহা শান্তিচুক্তির পর পাকিস্তানের অভিজাত শাসকগোষ্ঠী বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করেছিল এবং এটিকে পাকিস্তানের এক বিশাল সফলতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। ২২ জুলাই, ২০২১ আমি ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছিলাম, আফগান তালেবানরা কাবুল ঘিরে ফেলেছে এবং পশ্চিমা বাহিনীর প্রত্যাহারের পর তারা কেবল কাবুলই দখল করবে না; বরং পাকিস্তানকেও কঠিন সময় দেবে। তৎকালীন সেনা নেতৃত্ব যথারীতি আমাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করেছিল এবং তখনকার সরকারের তথ্যমন্ত্রীও আমার দাবির প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর ১৫ আগস্ট, ২০২১ তালেবানরা কাবুল দখল করে নেয়। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কাবুল পতনে বললেন, তালেবানরা দাসত্বের শিকল ভেঙে ফেলেছে। আশরাফ ঘানি কাবুল থেকে পালিয়ে যান। জেনারেল ফয়েজ কাবুল পতনের কৃতিত্ব নেয়ার জন্য বিনা ডাকেই কাবুল পৌঁছেন।

দোহা শান্তিচুক্তি লঙ্ঘনের কারণে পাকিস্তানকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এমন পরিস্তিতিতে জেনারেল বাজওয়া চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির চক্করে আটকে গেলেন এবং জেনারেল ফয়েজ নতুন সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিলেন। বাজওয়া ও ফয়েজের এই টানাপড়েনের মধ্যে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং তাকেও সরকার থেকে বিদায় করা হয়। শাহবাজ শরিফ নতুন প্রধানমন্ত্রী হন এবং বাজওয়া তাকে আফগান তালেবানের মাধ্যমে নামসর্বস্ব তেহরিকে তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেন। পেশোয়ার কোর কমান্ডার জেনারেল ফয়েজ আবারো কাবুল যান এবং তিনি পাকিস্তানি তালেবানদের মূল্যবান উপহারও দেন। কিন্তু বিষয়টি আগে বাড়েনি। এরপর বাজওয়া ও ফয়েজও দৃশ্যপট থেকে সরে যান। পাঁচ বছর পর দোহায় পাকিস্তান ও আফগান তালেবানের মধ্যে আবার সাক্ষাৎ হলো। পাকিস্তান তালেবানকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, যদি আপনারা আফগানিস্তানের পথ ধরে পাকিস্তানে সন্ত্রাস চালানো সংগঠনগুলোকে বাধা না দেন, তাহলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই পাকিস্তানে নয়, আফগানিস্তানে হবে।

দোহায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। তবে সেটি বাস্তবায়ন করতে বেশ বাধা রয়েছে। আফগান তালেবান ও পাকিস্তানের সরকারের মধ্যে অনাস্থা চরমে পৌঁছে। পাকিস্তানে আফগানদের ভালো-মন্দ বলা হচ্ছে, আর আফগানিস্তানে পাকিস্তানিদের গালি দেয়া হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে- যে নরেন্দ্র মোদি অখণ্ড ভারতে শুধু পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, নেপাল ও মালদ্বীপকেই নয়; বরং আফগানিস্তানকেও অন্তর্ভুক্ত করতে চান, তিনি এখন আফগান তালেবানকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছেন। বিদ্বেষ, ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহার এ পরিবেশে আমাদের এটি ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, আমাদের অভিযোগ আফগান তালেবানদের প্রতি, পুরো আফগান জাতির প্রতি নয়।

আফগানদের অকৃতজ্ঞ বলে পুরো আফগান জাতিকে অপমান করা মোটেও সঙ্গত নয়। অনুরূপভাবে আফগান ভাইদেরও নিজেদের সীমান্ত আটক পর্যন্ত বিস্তৃত করার দাবিও সঠিক নয়। আপনারা তো কখনো দিল্লি পুনরায় দখল করার দাবি করেননি। অথচ ১২০৬ থেকে নিয়ে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আফগান আক্রমণকারী দিল্লি শাসন করেছেন। আগ্রা শহর তো আফগান শাসক সেকান্দার লোদিই গড়ে তুলেছিলেন। মাহমুদ গজনবি, ঘুরি, শেরশাহ সুরি ও আহমদ শাহ আবদালিও আফগানিস্তান থেকে এসেছিলেন। আহমদ শাহ আবদালি ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে হিন্দু মারাঠিদের পরাজিত করেন। তাদের বিরুদ্ধে আজও ভারতে অপমানজনক সিনেমা তৈরি করা হয়। এ বিষয়ে আফগান তালেবানরা কখনো প্রতিবাদ করেনি। আজকের ভারতে যুক্ত কয়েকটি রাজ্য একসময় আফগানদের উপনিবেশ ছিল। মালেরকোটলার শাসকরা ছিলেন শেরওয়ানি গোত্রের। পাতৌদি রাজ্যের শাসকরা ছিলেন ইউসুফরায় (ইউসুফজাই) গোত্রের। জুনাগড়, রামপুর, পালনপুর এবং ভুপালও আফগানরা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ড. আবদুল কাদের খান ভুপাল থেকে হিজরত করে পাকিস্তান এসেছিলেন; কিন্তু তিনি গর্বের সাথে বলতেন, তিনি ইউসুফজাই পাঠান এবং তার পূর্বপুরুষরা তিরাহ থেকে ভুপাল গিয়েছিলেন। আফগান তালেবান কি কখনো ভুপালের ওপর তাদের দাবি উত্থাপন করেছে? মানলাম, আহমদ শাহ আবদালি লাহোর ও মুলতান দখল করেছিলেন।

দক্ষিণ পাঞ্জাবের শহর মোজাফফরগড় নওয়াব মোজাফফর খান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যিনি আফগান ছিলেন এবং শিখদের সাথে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন। খানগড়ের নাম খান বিবির নামে রাখা হয়েছে, যিনি মোজাফফর খানের বোন। পরবর্তী সময়ে রণজিত সিংও তো কাবুল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। কখনো কি কোনো পাকিস্তানি নিজের পছন্দের ইতিহাসের দোহাই দিয়ে কাবুলকে পাকিস্তানে যুক্ত করার দাবি করেছে? পাকিস্তানি ও আফগানদের একটি নিষ্ফল লড়াই ও তর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আজ যদি আমাদের এ অভিযোগ থাকে, আফগানিস্তানের পথ হয়ে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে, তাহলে আফগানদের আমাদের পক্ষ থেকে এ কথাও বলা উচিত, আগে আপনাদের গজনি এলাকা থেকে হজরত আলি হাজবেরি (রহ:) এবং চিশত শরিফ থেকে হজরত মুঈনুদ্দীন চিশতি (রহ:) এসেছেন, যারা উপমহাদেশে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন। কিন্তু এখন আসে আত্মঘাতী হামলাকারী। আফগানিস্তানকে আমাদের ইকবালের দৃষ্টিতে দেখা উচিত। ইকবাল জাভেদনামাতে বলেছেন, অসিয়া এক পেইকারে আবো গেলাস্ত/মিল্লাতে আফগান দারান পেইকারে দেলাস্ত/আয ফাসাদে উ ফাসাদে অসিয়া/দার কুশাদে উ কুশাদে অসিয়া- এশিয়া একটি কাদা-পানির দেহ/আফগান জাতি সেই দেহে হৃৎপিণ্ডসম/তার ধ্বংসে এশিয়ার ধ্বংস/তার আনন্দে এশিয়ার আনন্দ।

আল্লামা ইকবাল আফগানিস্তানকে এশিয়ার হৃৎপিণ্ড অভিহিত করে বলেন, যদি সেই হৃৎপিণ্ডে বিপর্যয় নেমে আসে, তাহলে পুরো এশিয়াতে বিপর্যয় নেমে আসবে। আর যদি আফগানিস্তানে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে, তাহলে পুরো এশিয়াতে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে। ‘বালে জিবরাইল’-এ খুশহাল খান খাট্টাকের ওসিয়ত শিরোনামে বলেন, কাবায়েল হুঁ মিল্লাত কি ওয়াহদাত মেঁ গুম/কে হো নাম আফগানিয়ুঁ কা বুলান্দ/মুহাব্বাত মুঝে উন জাওয়ানুঁ সে হ্যায়/সেতারুঁ পে জো ডালতে হেঁ কামান্দ- উম্মতের ঐক্যে গোত্র যাবে হারিয়ে/শুধু আফগানদের নাম থাকবে সমুচ্চ/ওই যুবকদের প্রতি আমার ভালোবাসা/যারা তারকারাজিকে ফাঁদে আটকায়। পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবাল আফগানদের যে ভালোবাসা ও সম্মান দিয়েছেন, আফগানদের সে সম্মান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় পাওয়া যাবে না।

আফগান তালেবানের সাথে মতবিরোধ, আর আফগান জাতির সম্মান দু’টি ভিন্ন বিষয়। খাইবারপাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানের পাকিস্তানিদের অধিকাংশই আফগানিস্তানের সাথে লড়াই চায় না। তবে আফগান তালেবান যেন শান্তির এই আকাক্সক্ষাকে কারো দুর্বলতা না ভাবে এবং পাকিস্তানের শত্রুদের হাতিয়ার না হয়ে যায়। পাকিস্তান রাশিয়ান ও আমেরিকান বাহিনীর মতো আফগানিস্তানে ঢুকে কোনো সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করবে না; বরং সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করবে। ২০২০ সালের দোহা শান্তিচুক্তি ভেঙে তালেবানের বেশ লাভ হয়েছে। ২০২৫ সালের দোহা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করলে সব উপকারিতা শেষ হয়ে যাবে। গত পাঁচ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। আগামী পাঁচ বছরে সবকিছু বদলে যাবে।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২২ অক্টোবর, ২০২৫-এর উর্দু থেকে ভাষান্তর

ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট