বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা রাজনীতি পরিহার করে চলা। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি থেকে নিজেকে বিরত রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি হওয়া উচিত মাত্র একটি বিষয়ে। আর তা হলো শিক্ষা ও গবেষণায় তৎপর হওয়া।

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম বা প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হলো ‘আল-কারাউইন’। এটি ৮৫৯ সালে মরক্কোর ফেজে স্থাপিত হয়। মুসলিম শাসক ফাতিমা আল-ফিহরি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রাচীনতম দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলো মিসরের আল আজহার। ৯৭০ সালে ফাতেমীয় শাসনামলে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ফাতেমী সেনানায়ক জাওহর সিসিলি। আর ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হলো অক্সফোর্ড। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৯৬ সালে।

প্রাচীন এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে। ধর্ম ও ধর্মতত্ত¡ চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রতিষ্ঠাকালীন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল চার্চের নিয়ন্ত্রণাধীন। কালক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ধর্মচর্চাকে নির্দয়ভাবে নির্বাসনে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। আধুনিক যুগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হলো, বিশ্বমানের পাঠদান ও গবেষণার মাধ্যমে দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি বৃদ্ধি করা; ঔৎকর্ষ, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে সারা দুনিয়াকে আকৃষ্ট করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্তব্য হলো, পাণ্ডিত্য ও গবেষণা দ্বারা নিত্যনতুন জ্ঞান আবিষ্কার করা। সময়োপযোগী শিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞানের আলো চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া। জনসেবার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটানো। চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। সব ধরনের বৈষম্যহীন পরিবেশ তৈরি ও সংরক্ষণ করা। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মৌলিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমন এক পরিবেশ যেখানে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে মানুষ আগমন করবেন। তারা এক জায়গায় থাকবেন। ব্যাপকভাবে ভাবের আদান-প্রদান করবেন। তাদের একে অপরের জ্ঞান ও মনের সাথে মতান্তর সৃষ্টি হবে। আর এ মতান্তরের মাধ্যমে সৃষ্টি হবে নতুন জ্ঞান। এখানে পুরনো জ্ঞানের ব্যাপক বিশ্লেষণ হবে; হবে চুলচেরা বিশ্লেষণ, পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন। এখানে অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীর যৌথ পাণ্ডিত্য মিলে আবিষ্কার হবে নতুন জ্ঞান। সৃষ্টি হবে নতুন গবেষণা। আর পুরনো জ্ঞান ঘষে মেজে করবেন পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন। এসব কিছুর নেপথ্যের কারিগর হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

সংক্ষেপে বর্ণিত এসব লক্ষ্য এটাই প্রমাণ করে, বিশ্ববিদ্যালয় হলো উন্নত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজকে বদলে দেয়ার নাম বিশ্ববিদ্যালয়। যোগ্য মানুষ তৈরির এক উন্নত কারখানার নাম বিশ্ববিদ্যালয়। নিজ দেশের মান ও গৌরব বৃদ্ধির অবিরাম সাধনার নাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব শুধু পাঠদান নয়। আর শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব শুধু পাঠ গ্রহণ নয়। যুগ সন্ধিক্ষণের চাহিদা পূরণের উপায় বের করাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন সাধনই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মৌলিক দায়িত্ব। জাতি গঠনে তাদের ভূমিকা হবে অনবদ্য ও অনন্য।

বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি দেশের নয়, বিশ্বসমাজের জন্য আলোকবর্তিকা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হলেন সমাজ, দেশ, জাতির জন্য আলোর দিশারি। উদ্ভাবনী ক্ষমতার মাধ্যমে তারা দেশ ও জাতিকে আলোকিত করবেন। নিত্যসমস্যার সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। যুগের দাবি পূরণে তারা নাবিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সে পথে হাঁটতে ব্যর্থ হয়েছেন। গত দীর্ঘ ১৫ বছরে শিক্ষকরা রাজনীতির বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের ফ্যাসিবাদী প্রতিষ্ঠানে রূপ পেয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একেবারেই শেষ হয়ে গেছে গত দেড় যুগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য রাজনৈতিক পরিচয়েই তার পদ অলঙ্কৃত করতেন। এ পদে নিয়োগ পেতে একজন উপাচার্যকে সর্বপ্রথম দলীয় আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হতো। ফলে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি আর একাডেমিশিয়ান থাকতে পারতেন না। তিনি একজন ঝানু পলিটিশিয়ানের ভূমিকা পালন করতেন। শিক্ষা ও গবেষণায় তিনি আর মনোযোগী হতে পারতেন না। তার মাথা থেকে শিক্ষা ও গবেষণা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যেতো। গত ১৫ বছরে দেশে ঠিক এমনটাই ঘটেছে।

উপাচার্য একজন পলিটিশিয়ান হওয়ায় তার অনুসারী শিক্ষকরাও ছিলেন অতিমাত্রায় দলবাজ। গবেষণা বাদ দিয়ে অধ্যাপকরা অনৈতিক দলবাজিতে লিপ্ত থাকতেন। এ দলবাজির মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি করা। অর্থ ইনকাম, স্বার্থোদ্ধার আর ক্ষমতার অপব্যবহার ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার লোভে তারা সঙ্কীর্ণ দলীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এ বন্দিত্ব থেকে তারা আর বের হয়ে আসেননি। এসব কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাক্সিক্ষত একাডেমিক পরিবেশ ছিল না। সামগ্রিকভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে একাডেমিক পরিবেশ বিলীন হয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে আমার প্রিয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকতার বয়স প্রায় ২৪ বছর। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ দেখে আমি হতাশ না হয়ে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি যে, শ্রেণিকক্ষে পড়ায় তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এটেনডেন্সের নম্বর পেতেই তারা ক্লাসে উপস্থিত হয়। তাদের বক্তব্য হলো, শিক্ষকরা ক্লাসে গবেষণাধর্মী ও জীবনমুখী কথা বলেন না। তারা গৎবাঁধা কিছু লেকচার দেন। ক্লাস রুমে শিক্ষকরা নিজের ক্ষমতাই বেশি জাহির করেন। তিনি একাডেমিক মনোভাব বাদ দিয়ে রাজনৈতিক মনোভাবই বেশি প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীরা আরো বলেন, আমরা অধিকাংশই গরিবের সন্তান। আমাদের প্রয়োজন কর্মমুখী শিক্ষা। কিন্তু আমাদের একাডেমিক পড়ালেখার সাথে চাকরি জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। পাঁচ-ছয় বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার পর চাকরির জন্য আবার আলাদা লেখাপড়া করতে হয়। এতে আমাদের দীর্ঘ পাঁচ-ছয় বছরের লেখাপড়া অনর্থক ও আনপ্রোডাক্টিভ হিসেবেই ব্যয় হয়! এসব কারণে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়া বাদ দিয়ে এখন চাকরির পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাদের হাতে থাকে বিসিএস গাইড আর নানা ধরনের শিট। এতে সচেতন একজন শিক্ষক হিসেবে আমি হতাশ না হয়ে পারি না। শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু সেই মেরুদণ্ড আমাদের দেশে আজ মৃত্যুদণ্ডে রূপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে সব স্তরের শিক্ষার্থীর একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে ভালো রেজাল্ট করা। মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য একটাই, বড় চাকরি করা, বড়লোক হওয়া ইত্যাদি। তাদের কেউই ভালো লাগার জন্য পড়ে না। লেখাপড়া করে কেউই সুনাগরিক হতে চায় না। এ কারণে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে দেশপ্রেম, সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শের ছিটেফোঁটাও নেই। শিক্ষকরা তাদের দেশপ্রেম ও সততায় উদ্বুদ্ধ করেননি। ফলে তারা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠেননি। এটি একটি জাতির জন্য অশনিসঙ্কেত। এটি সচেতন একজন শিক্ষকের জন্য লজ্জা ছাড়া আর কী হতে পারে!

জুলাই বিপ্লবের পর ভেবেছিলাম অন্তত দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আমি হতাশ। আগের নিয়মেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা বাদ দিয়ে আগের মতোই প্রশাসনিক কাজে বেশি ব্যস্ত। পদ পদবি পেতে তারা মরিয়া। হলের একজন প্রভোস্ট লেখাপড়া বাদ দিয়ে হলের বাথ রুমের সরঞ্জামাদি কিনতে মহাব্যস্ত। বাথ রুমের বদনা, পাপোশ, পাইপ, শাওয়ার ও অন্যান্য জিনিসপত্র কেনাকাটা নিয়েই দিন-রাত কাটিয়ে দেন। ডাইনিংয়ের খাবারের মান উন্নয়ন ও থালাবাটি কেনাকাটাও তাদের মৌলিক কাজ। প্রভোস্টের মতো প্রক্টর সাহেবও সারাক্ষণ দৌড়ের ওপর থাকেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্ট নানান জটিলতা নিরসনে তিনি ব্যস্ত থাকেন দিনের অধিকাংশ সময়। যত দিন তিনি বা তারা এই পোস্টে থাকেন লেখাপড়া ও গবেষণা শিকেয় তুলে রাখতে হয়। আবার এই পদের জন্যই তারা জোর লবিং করেন। হাই কমান্ড ও মন্ত্রী সাহেবের পক্ষ থেকে ফোনও আসে! এই হলো বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ও গবেষণার হাল হকিকত। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, গবেষক ও আবিষ্কারক জন্ম নেয়নি। প্রতি বছর এখানে জন্ম নেন কিছু বিসিএস ক্যাডার। এ ক্যাডাররাই পরবর্তীকালে ক্ষমতাধর আমলায় পরিণত হন। আর তাদেরই ডিরেকশনে পরিচালিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বিষয়াদি। এসব কারণেই বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিতে পারেনি। এ তালিকায় স্থান হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটেরও। এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও জায়গা পায়নি বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও।

বর্তমানে সাফল্যের ক্রমানুসারে পৃথিবীর সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো : ১. এমআইটি (ইউএসএ) ২. অক্সফোর্ড (ইউকে) ৩. স্ট্যানফোর্ড (ইউএসএ) ৪. কেমব্রিজ (ইউকে) ৫. হার্ভার্ড (ইউএসএ) ৬. ক্যাল-টেক (ইউএসএ), ৭. ইম্পিরিয়াল কলেজ (ইউকে) ৮. সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (সুইজারল্যান্ড) ৯. ইউনিভার্সিটি কলেজ (ইউকে) ও ১০. ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো (ইউএসএ)।

এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সময়োপযোগী উন্নত জ্ঞান চর্চার শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় না। সেখানে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতির কোনো নাম-গন্ধও নেই। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে দিনরাত পৃথিবীকে নতুন জ্ঞান উপহার দিতে ব্যস্ত। সেখানে ভিসি ও অন্যান্য পদ নির্ধারিত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যোগ্যতার ভিত্তিতে। এমতাবস্থায় আমাদের কর্তৃপক্ষের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাক্সিক্ষত গবেষণার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা! কর্তৃপক্ষের উচিত উন্নত বিশ্বের যেকোনো একটিকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা রাজনীতি পরিহার করে চলা। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি থেকে নিজেকে বিরত রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি হওয়া উচিত মাত্র একটি বিষয়ে। আর তা হলো শিক্ষা ও গবেষণায় তৎপর হওয়া।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া