ইউরোপীয় ইউনিয়নে নেতৃত্ব-সঙ্কট

এদিকে, সার্বভৌমত্ববাদী দলগুলো ইউরোপজুড়ে প্রভাব বিস্তার করছে, কারণ সঙ্কটের মধ্যে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য তাদের আহ্বান অনুরণিত হচ্ছে। অনেকের মতে, তার পদত্যাগ কেন্দ্রীয়বাদী ইইউ মডেলের ব্যর্থতার প্রতীক। অর্থবহ সংস্কার সম্ভব কি না অথবা সংস্থাটি গভীর ভাঙনের মুখে পড়বে কি না আগামী মাসগুলোতে তা প্রকাশ পাবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রায়ই উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত স্থিতিশীলতার কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয়। সেটি এখন নেতৃত্ব-সঙ্কটের মুখোমুখি, যা তার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে তছনছ করে দিতে পারে। অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য ফ্রান্সের প্রভাবশালী কমিশনার থিয়েরি ব্রেটনের আকস্মিক পদত্যাগ এবং কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডার লিয়েনের প্রস্থান ব্রাসেলসে নাটকীয় মোড় সৃষ্টি করেছে। এটি কেবল আমলাতান্ত্রিক রদবদল নয়- তার শাসন, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং ইউরোপীয় একীকরণের ভবিষ্যৎ নিয়েও গভীর উত্তেজনার প্রতিফলন।

ব্রেটনের প্রস্থান শান্ত ছিল না। ‘সন্দেহজনক শাসন’ এবং কমিশনের মধ্যে সহযোগিতার অভাবের প্রকাশ্য অভিযোগগুলো ভন ডার লিয়েনের ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বের শৈলী সম্পর্কে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি দেখা দেয়। মহামারীর সময় কূটনৈতিক সূ²তা এবং সঙ্কট ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশংসিত ভন ডার লিয়েন এখন সহকর্মী কমিশনারদের কোণঠাসা করার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সংহত করার জন্য সমালোচনার মুখোমুখি। তার পদত্যাগ, তা স্বেচ্ছায় হোক বা রাজনৈতিকভাবে বাধ্য হয়ে হোক না কেন, ইইউর নির্বাহী শাখার অনৈক্য বৈশ্বিকভাবে তুলে ধরেছে। এই নেতৃত্ব-শূন্যতার প্রভাব বহুমুখী। প্রথমত, এটি মূল নীতিগত উদ্যোগগুলো ব্যাহত করার হুমকি সৃষ্টি করবে, বিশেষত ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্প কৌশলের মতো ক্ষেত্রগুলোতে, যেখানে ব্রেটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার প্রস্থান প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণে ইইউর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা স্তব্ধ করে একটি শূন্যতা সৃষ্টি করতে পারে, যা দ্রুত পূরণ করা কঠিন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই সঙ্কট ইউনিয়নের নীতিনির্ধারণের ঐতিহ্যবাহী ইঞ্জিন ‘ফ্রাঙ্কো-জার্মান অক্ষ’কে চাপে ফেলেছে। ব্রেটনের প্রতিস্থাপন এবং তার প্রভাব জোরদার করার জন্য ফ্রান্সের দ্রুত পদক্ষেপকে জার্মানির আধিপত্যের জন্য চ্যালেঞ্জ, যা ক্ষমতার ভারসাম্যকে অস্থির করে তুলছে। অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ এখন প্রকাশ্যে। এটি নাগরিকদের আস্থা হ্রাস করে ইউরো সংশয়বাদী আখ্যানকে ইন্ধন জোগাচ্ছে।

উরসুলা ভন ডার লিয়েন, বলতে গেলে তার সাম্রাজ্যের শেষ সময়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ইউরোপের অন্যতম ক্ষমতাধর এই নারী, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। এর পেছনে কোন শক্তি সক্রিয় তা কেউ বলতে পারছে না। তবে এটা পরিষ্কার, সংস্থাটি অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে।

গুজব, পাওয়ার গেম এবং অনিশ্চয়তা এখন ব্রাসেলসের ক্ষমতাযন্ত্রের প্রতিটি কোণ ছাপিয়ে গেছে। পলিটিকোর মতে, লিয়েনের অপ্রত্যাশিত প্রস্থান ইউরোপীয় ইউনিয়নকে গভীর প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কটে ডুবিয়েছে। বৈদেশিক নীতি, জ্বালানি সরবরাহ, বাজেট নিয়ম এবং কৌশলগত জোট সম্পর্কে ভিন্ন মতামত নতুন তীব্রতা নিয়ে উঠে আসছে। ইউরোপীয় কাউন্সিল বিভক্ত এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক লাইনটি নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে লড়াই করছে।

লা ফিগারো বলেছে, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা বিরক্ত এবং বিভ্রান্ত। পদত্যাগের কারণগুলো রহস্যাবৃত থাকলেও ক্ষমতার করিডোরে ফাঁস হওয়া ছবিগুলো সরকারি বক্তব্যের চেয়েও জোরালো। জর্জিয়ার মেলোনি এবং ভিক্টর অরবানের নেতৃত্বাধীন ইতালি ও হাঙ্গেরির প্রতিনিধিরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে ভন ডার লিয়েন একটি উত্তপ্ত বৈঠকের সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন বলে জানা গেছে। অফিসিয়াল নিশ্চিতকরণ হয়তো কখনোই আসবে না। তবে রাজনীতিতে, উপলব্ধি প্রায়ই বাস্তবে পরিণত হয়।

২২ আগস্ট, ২০২৫ কমিশনকে গুজব অস্বীকার করতে হয়েছিল যে ভ্যান ডার লিয়েনকে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে বৈঠক থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। মুখপাত্র এটি প্রত্যাখ্যান করলেও ইতোমধ্যে অবিশ্বাসের বীজ বোনা হয়ে গেছে। ইতালি ও হাঙ্গেরির জন্য অভিবাসী-জলবায়ু তহবিল ছিল একটি উসকানি। রোম দেড় লাখ অতিরিক্ত আশ্রয়ের আবেদনপ্রক্রিয়া করবে বলে আশা করা হয়েছিল, বুদাপেস্ট এক বিকল্পের মুখোমুখি হয় ৫০ হাজার অভিবাসীকে গ্রহণ করা বা বিলিয়ন বিলিয়ন জরিমানা প্রদান করা নিয়ে। একটি শক্তি সংহতি প্রক্রিয়া হাঙ্গেরিকে জ্বালানিনীতির ওপর সরাসরি আক্রমণ। মেলোনি এবং অরবানের জন্য, এটি কেবল আলোচনা ছিল না- এটি ব্রাসেলসের কেন্দ্রীয়তাবাদী অ্যাজেন্ডার একটি মৌলিক প্রত্যাখ্যান। তাদের ওয়াকআউট জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং ফেডারালিস্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে সংঘর্ষের চূড়ান্ত পর্যায়ে চিহ্নিত হয়।

এদিকে ইউরোপজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমা নিউজে লিড নেই। ব্রাসেলসে বিতর্ক চলার সাথে সাথে জার্মানি, ফ্রান্স ও পোল্যান্ডের কৃষকরা গ্রিন ডিলের প্রয়োজনীয়তা, নাইট্রোজেনের সীমা, পতিত জমির বাধ্যবাধকতা এবং শুল্কমুক্ত ইউক্রেনীয় শস্যব্যবস্থার প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ করে।

২৮ আগস্ট, প্যারিসে এক বৈঠকে বার্লিন এবং প্যারিসের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব প্রকাশ পায়। জার্মানি স্থিতিশীল ভূমিকা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। চ্যান্সেলর সমঝোতার আহ্বান জানালেও বিভক্ত ইউরোপকে একত্রিত করার শক্তি বার্লিনের ছিল না।

ফ্রান্সে সঙ্কট আরো গভীর। প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বেরু ব্রাসেলস-আরোপিত ৪৪ বিলিয়ন ইউরোর কৃচ্ছ্রসাধন পরিকল্পনায় সৃষ্ট অনাস্থা ভোটের ঘোষণা দেয়, যার লক্ষ্য ফ্রান্সের বাজেট ঘাটতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৩ শতাংশ সীমার নিচে কমিয়ে আনা। মার্সেইতে রাস্তায় নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীগুলোর বিক্ষোভ উত্তেজনা দেখার মতো। রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রোঁ কাটছাঁটের পক্ষ সমর্থন করেন তবে একই সাথে সামরিক বাজেট সাড়ে ছয় বিলিয়ন ইউরো বাড়িয়ে দেন। এটি একটি পরস্পরবিরোধী বার্তা যা অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে এবং ম্যাক্রোঁর ইমেজে ভাটা পড়ে। আগস্টের শেষ সপ্তাহে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ইউরোপের চিত্র বিম্বিত হচ্ছিল। অনাস্থা ভোট, রাস্তায় বিক্ষোভ এবং জাতীয় রাজধানী থেকে পরস্পরবিরোধী বিবৃতি বিভক্ত ইউনিয়নকে প্রকাশ্যে আনে। লিয়েনের কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ে। ২০১৯ সালে, তিনি জনগণের মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচিত না হলেও মার্কেল এবং ম্যাক্রোঁর মধ্যে একটি সমঝোতার মাধ্যমে উঠে এসেছিলেন। তার ক্ষমতা রাষ্ট্রপ্রধানদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছিল, যারা এখন তাকে ত্যাগ করছেন।

সদস্য রাষ্ট্রের নীতি উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে তোলে। জর্জিয়া মেলোনি ব্রাসেলসের সীমালঙ্ঘন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, যখন পেদ্রো সানচেজ সংহতির আহ্বান জানান। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে অনেক সরকার উল্লেখ করেছে যে কমিশন এখন বিদ্রোহের মুখোমুখি। ২৬ আগস্টের জরিপে ইইউ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থার তীব্রতা হ্রাস দেখা গেছে, বিশেষত দক্ষিণ ও মধ্য ইউরোপে।

স্পিগেলের মতে, সাইবার নিরাপত্তা এবং জ্বালানির কৌশলগত চুক্তিগুলো সদস্য রাষ্ট্রের তত্ত¡াবধান ছাড়াই রুদ্ধদ্বার আলোচনার মাধ্যমে করা হয়েছিল। বিশ্লেষকরা এটিকে বলেন নজিরবিহীন স্বচ্ছতার সঙ্কট। আরো বিস্ফোরক, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস রিপোর্ট করেছে, লিয়েন সদস্য দেশগুলোর সাথে পরামর্শ ছাড়াই ডাটা ম্যানেজমেন্ট এবং এআই সম্পর্কিত প্রযুক্তি করপোরেশনগুলোর সাথে বহু বিলিয়ন ইউরোর চুক্তি অনুমোদন করেন। ইউরোপীয় সংসদ সদস্যরা তার বিরুদ্ধে গোপন কূটনীতির অভিযোগ করেন। রয়টার্স ১০ জুলাই ২০২৫-এ রিপোর্ট করে, প্রস্থানের কিছুক্ষণ আগে লিয়েন সাইবার সিকিউরিটি এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির জন্য একটি বেসরকারি তহবিল সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে গোপন আলোচনা করেন। অনেকের সন্দেহ, তিনি দর্শনীয়ভাবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ফেরার পরিকল্পনা করছেন। অর্থনৈতিকভাবে, তার পদত্যাগের মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। ব্লুমবার্গের মতে, ইউরো হ্রাস পেয়েছে এবং সরকারি বন্ডগুলো চাপে পড়েছে। ব্রাসেলসে তার উত্তরসূরি নিয়ে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছে। কিছু রাষ্ট্র একজন টেকনোক্র্যাটের পক্ষে, অন্যরা ইইউর রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস চায়। ইউরোপ ওয়াচের মতো অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপগুলো দাবি করেছে, ভন ডার লিয়েন ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থায় শীর্ষ পদের প্রস্তাব পেয়েছেন। এদিকে, সার্বভৌমত্ববাদী দলগুলো ইউরোপজুড়ে প্রভাব বিস্তার করছে, কারণ সঙ্কটের মধ্যে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য তাদের আহ্বান অনুরণিত হচ্ছে। অনেকের মতে, তার পদত্যাগ কেন্দ্রীয়বাদী ইইউ মডেলের ব্যর্থতার প্রতীক। অর্থবহ সংস্কার সম্ভব কি না অথবা সংস্থাটি গভীর ভাঙনের মুখে পড়বে কি না আগামী মাসগুলোতে তা প্রকাশ পাবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার