দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট, বাংলাদেশ কি প্রস্তুত

যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার কাঠামো আরো বিকশিত হয়, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা পায় বা সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব অধিক প্রয়োজনীয় হয়; সেক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ বিবেচনা উপযুক্ত হতে পারে। এখন পর্যন্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির শক্তিশালীকরণ, দলীয় হুইপ সংস্কার, বিরোধী দলের কার্যকর উপস্থিতি ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এককক্ষীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি।

ড. মো: মিজানুর রহমান
ড. মো: মিজানুর রহমান

সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন, কার্যকর প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান এবং নাগরিক প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনায় পার্লামেন্টের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সংসদীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন দেশের সাংবিধানিক কাঠামো ও রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুসারে পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছে এককক্ষ অথবা দ্বিকক্ষ হিসেবে। এ দু’টি পদ্ধতির লক্ষ্য জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, আইন প্রণয়ন ও শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করা। জাতিসঙ্ঘের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে ১৯০টি সংসদের মধ্যে ১১১টি এককক্ষ, অর্থাৎ প্রায় ৫৮ শতাংশ এককক্ষব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে এককক্ষবিশিষ্ট সংসদপদ্ধতি অনুসরণ করছে, যা ১৯৭২ সালের সংবিধানের মাধ্যমে প্রবর্তিত হয়। যদিও সময় সময় কিছু মহলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ কি এখন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের জন্য প্রস্তুত?

এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণা ও কার্যকারিতা

এককক্ষবিশিষ্ট সংসদে আইন প্রণয়নের সব দায়িত্ব একটি মাত্র কক্ষ বা পরিষদের হাতে ন্যস্ত থাকে। এ কাঠামো সাধারণত অপেক্ষাকৃত ছোট এবং ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোতে দেখা যায়, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার মূল প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ধারণ করে। এতে সর্বোচ্চ কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা থাকার সম্ভাবনা থাকে, তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দ্রুততা বজায় থাকে। বাংলাদেশ ছাড়াও বর্তমানে যেসব দেশে এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের মধ্যে ডেনমার্ক, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যান্ড, গ্রিস, ইসরাইল এবং সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত রাষ্ট্রসমূহ।

এককক্ষবিশিষ্ট সংসদে আইন প্রণয়নের কার্যকারিতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতি থাকে, বিশেষত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে দ্রুত আইন পাসের প্রয়োজনে এটি কার্যকর হতে পারে। সাথে প্রশাসনিক খরচের সাশ্রয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা ও দ্ব›দ্ব কম হয়। নিউজিল্যান্ড ১৯৫১ সালে উচ্চকক্ষ বাতিল করে এককক্ষ সংসদ চালু করে। দেশটি বর্তমানে ওয়ার্ল্ড গুড গভর্ন্যান্স ইনডেক্সে শীর্ষ দশে অবস্থান করছে। ডেনমার্ক ও সুইডেনে উভয় দ্বিকক্ষ কাঠামো ছেড়ে এককক্ষ পদ্ধতিতে রূপান্তর করেছে (যথাক্রমে ১৯৫৩ ও ১৯৭১ সালে), যার ফলে সরকার পরিচালনায় সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জনগণের আস্থা বেড়েছে। নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে এককক্ষীয় ব্যবস্থা কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশও, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও, এককক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থায় ৫২ বছরেরও বেশি সময় পার করে দিয়েছে, যার মধ্যে ১২টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণা ও কার্যকারিতা

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদব্যবস্থায় সাধারণত একটি হয় নি¤œকক্ষ যা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। অন্যটি হয় উচ্চকক্ষ যা নিয়োগকৃত, পরোক্ষভাবে নির্বাচিত বা বিভিন্ন উপরাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস (সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস), যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট (হাউজ অব কমন্স ও হাউজ অব লর্ডস), ভারতের সংসদ (লোকসভা ও রাজ্যসভা) এবং অস্ট্রেলিয়ার সংসদ (সিনেট ও হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের দৃষ্টান্ত।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে রাজনৈতিক পক্ষপাত ও আইন প্রণয়নে অকার্যকরতা তৈরি করে। যদিও দ্বিতীয় কক্ষ চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের ভূমিকা রাখে, তবে এটি কার্যকর নয় ফেডারেল কাঠামো ছাড়া। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিকক্ষ সংবিধানের ক্লাসিক উদাহরণ যেখানে নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষ কঠোর পর্যালোচনাসহ বিল নিতে পারে। এসব কাঠামো তীব্র জট, বিলম্ব এবং অনির্বাচিত উচ্চকক্ষের কারণে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা সংশয় সৃষ্টি করেছে। তবে দ্বিকক্ষ দেশগুলোর ক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্ব কিছুটা বেশি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও দ্বিকক্ষের যৌক্তিকতা আলোচনা করতে বলতে হয়, বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে একটি এককক্ষ সংসদ চালু করে। বর্তমানে ৩০০টি আসনে সরাসরি ভোটে সদস্য নির্বাচিত হয়। আরো ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এমপিরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না, যার ফলে সংসদীয় স্বাধীনতার ঘাটতি থেকে যায় অর্থাৎ সংসদীয় কার্যকারিতা ও পর্যালোচনায় বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে (আহমেদ, ২০০২)। এ প্রসঙ্গে মনোনীত উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা, সাংবিধানিক পরিবর্তন, বাজেট, প্রশাসনিক কাঠামো ও বাস্তবায়ন দৃঢ় করার প্রয়োজন পড়ে।

প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশে একটি একক প্রশাসনিক কাঠামো, যেখানে এখনো স্থানীয় সরকারকাঠামো, সুশাসন, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা পর্যাপ্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেখানে একটি উচ্চকক্ষ তৈরি করলে তা কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে কি না। তাছাড়াও উচ্চকক্ষ গঠনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ, নতুন ভবন, নির্বাচনব্যবস্থা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা দরকার। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো ফেডারেল রাষ্ট্রে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন থাকলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন কোনো অঙ্গরাজ্য বা প্রাদেশিক সরকার নেই যাদের প্রতিনিধিত্ব উচ্চকক্ষে প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশে এমন বাজেট বরাদ্দ দেয়া অর্থনৈতিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য নয়।

দ্বিকক্ষীয় সংসদ চালুর পক্ষে যে যুক্তিগুলো মাঝে মাঝে ওঠে, তার মধ্যে রয়েছে, নির্বাচিত সংসদের একচ্ছত্র আধিপত্য কমানো, সংসদে পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা এবং সংখ্যালঘু ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর তুলে ধরা। তবে এই সমস্যাগুলোর সমাধান উচ্চকক্ষ ছাড়া এককক্ষীয় সংসদেও সম্ভব, যদি সংবিধানে কোটা, সংরক্ষিত আসন, পেশাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব ও সুশাসনের নিশ্চয়তা দেয়া যায়। বহু সংসদীয় দেশ গঠনতন্ত্রের কাঠামোয় দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পূর্বে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর এককক্ষ সংসদ প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে এবং সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বও কিছুটা হলেও রয়েছে। আরও কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কার, দলীয় গণতন্ত্র, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার এবং সংসদীয় কমিটির কার্যকারিতা বাড়ানোর মাধ্যমে এককক্ষীয় ব্যবস্থা আরও কার্যকর করে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশে এখনো দলীয় একচ্ছত্র আধিপত্য, সংসদে বিরোধী দলের সুশৃঙ্খল ভূমিকার অভাব, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অকার্যকারিতা এবং আইন পাসে সাধারণত বিতর্কের ঘাটতি লক্ষ করা যায় (আহমেদ, ২০০২; প্রথম আলো আর্কাইভ, ২০২৩)। এ পরিস্থিতিতে দ্বিকক্ষীয় ব্যবস্থা কেবল প্রশাসনিক জটিলতা ও ব্যয় বাড়াবে, কার্যকারিতা নয়।

দ্বিকক্ষীয় সংসদ চালু করতে নতুন কক্ষ গঠনে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে সংশ্লিষ্ট ভবন, প্রশাসন, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেতন-ভাতা, নিরাপত্তা, নির্বাচন ইত্যাদিতে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রকে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। দ্বিকক্ষব্যবস্থা বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন, নতুন আসন পুনর্বিন্যাস, সাংবিধানিক সংশোধনী, প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার, অধিক জনবল ও বাজেটের প্রয়োজন পড়বে যা এখনকার অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দ্বিকক্ষীয় সংসদ গঠনের প্রয়োজনীয়তা এখনো সময়োপযোগী নয়। অতএব, দ্বিকক্ষীয় সংসদের চিন্তা আপাতত বিলম্বিত রেখে বিদ্যমান কাঠামো আরো শক্তিশালী, প্রশাসনিকভাবে দক্ষ, আইন প্রণয়নে স্বচ্ছ, প্রতিনিধিত্বশীলতা বাড়ানো ও গণমুখী করা বাঞ্ছনীয়; যেমন : বাজেট তত্ত্বাবধান, আইন পর্যালোচনা, সরকারের ওপর নজরদারি ইত্যাদি। তা ছাড়াও সুনির্দিষ্ট জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ছাড়া সিনেটের ক্ষমতা দেখানোর ভিত্তিও নেই বরং এটি হবে উদ্দেশ্যহীন ও বেশি ব্যয়সাধ্য। বরং দেশীয় আইন প্রণয়ন ও সরকারের ওপর সংসদের তত্ত্বাবধান নিশ্চিতকরণে পার্লামেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দেশের জরুরি সেবা যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, সামাজিক সুরক্ষা খাতের উন্নয়নের আগে উচ্চকক্ষের প্রশাসনিক ব্যয় যুক্তিযুক্ত নয়; বর্তমানব্যবস্থার সংস্কারেই ভালো ফল আনবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, এককক্ষ সংসদ যথার্থভাবে আরো স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও কার্যকর করা যেতে পারে, যার মধ্যে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মানোন্নয়ন সম্ভব। বিশ্বব্যাপী ও বাংলাদেশের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুসারে দেখা যায়, যেসব দেশ সুশাসন, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে উচ্চকক্ষ বাতিল করেছে, তারা উভয় কাঠামোতে উন্নতি ও স্থিতিশীলতা পেয়ে থাকে। তাত্তি¡ক গবেষণা, আন্তর্জাতিক উদাহরণ, বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা সবাই দেখাচ্ছে যে বর্তমানে দ্বিকক্ষ সংসদের প্রয়োজনীয়তা এখনই নয়।

যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার কাঠামো আরো বিকশিত হয়, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা পায় বা সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব অধিক প্রয়োজনীয় হয়; সেক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ বিবেচনা উপযুক্ত হতে পারে। এখন পর্যন্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির শক্তিশালীকরণ, দলীয় হুইপ সংস্কার, বিরোধী দলের কার্যকর উপস্থিতি ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এককক্ষীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট