এশিয়া মহাদেশ আন্তঃসীমান্ত নদ-নদীতে জালের মতো জড়িয়ে আছে। এই নদীগুলো শুধু পানি পরিবহন করে না এগুলো বহন করে ইতিহাস, রাজনীতি, অস্তিত্ব ও ভূকৌশলগত উত্তেজনা। এই নদীগুলোর ওপর নির্ভর করে কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং খাদ্যনিরাপত্তা। এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও আলোচিত পানিবণ্টন চুক্তি হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি (ওহফঁং ডধঃবৎং ঞৎবধঃু) যা যুদ্ধের মধেও টিকে থাকার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক পহেলগাম হামলা ও তার জেরে সংঘটিত ছয় দিনের যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আমূল বদলে দেয়। এর পরপরই ভারত ঘোষণা করে যে তারা সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিল করছে। পাকিস্তান সাথে সাথে কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে হুঁশিয়ারি দেয় এই চুক্তি বাতিল হলে, নদীতে আর পানি নয়, রক্ত বইবে। এই প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় এই চুক্তি পাকিস্তানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রেক্ষাপটে সিন্ধু পানি চুক্তির ইতিবৃত্ত, সুবিধা-অসুবিধা, সম্ভাব্য প্রভাব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অন্যান্য নদীকেন্দ্রিক সম্পর্ক (বিশেষত বাংলাদেশ ও চীনের সাথে) পর্যালোচনা করা জরুরি।
ইতিহাস : সিন্ধু চুক্তির জন্মকথা
সিন্ধু নদীব্যবস্থা ছয়টি প্রধান নদী নিয়ে গঠিত সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব, রাভি, বিয়াস ও শতদ্রু। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর, এই নদীগুলোর উৎস ও প্রবাহ উভয় দেশেই ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে পানির ওপর নির্ভরশীলতা এবং উত্তেজনা দুই-ই বাড়ে।
এই সঙ্কট সমাধানে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত পানির পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি নদীর (রাভি, বিয়াস, শতদ্রু) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায়। পাকিস্তান পায় পশ্চিমাঞ্চলীয় তিনটি নদীর (সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
ভারতকে শুধু সীমিত পরিমাণে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর পানি কৃষি, ঘরোয়া এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। এই চুক্তির ফলে প্রায় ৮০ শতাংশ ইন্দুস পানিসমূহ পাকিস্তানের দখলে যায় এবং ভারতের ভাগে পড়ে মাত্র ২০ শতাংশ। তবুও ভারত শান্তি বজায় রাখতে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
সিন্ধু চুক্তির সুফল ও অসুবিধা
সুবিধা
১. যুদ্ধকালেও শান্তি রক্ষা : সিন্ধু পানি চুক্তির অন্যতম বড় অর্জন হলো এটি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ঘটে যাওয়া তিনটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ (১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালের কারগিল) এবং বহু সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যেও চিরস্থায়ী একটি কূটনৈতিক চুক্তি হিসেবে অটুট থেকেছে। যখন উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং যুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থায় ছিল, তখনো কোনো পক্ষ এই চুক্তি ভঙ্গ করেনি। এটি আন্তর্জাতিকভাবে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত, যেখানে শত্রুপ্রবণ দুই দেশের মধ্যে পানিসম্পদ নিয়ে কোনো সামরিক সংঘর্ষ হয়নি।
২. পরিষ্কার পানিবণ্টন কাঠামো : চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে নদীর পানির ব্যবহারসংক্রান্ত একটি নির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ কাঠামো প্রদান করেছে। ভারত ও পাকিস্তান কে কোন নদীর কতটা ও কিভাবে ব্যবহার করতে পারবে এটি স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষত পাকিস্তান এর ফলে তার সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা পেয়েছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ এই পানির ওপর নির্ভর করেই ধান, গম, তুলা ও আখ চাষ করে থাকে। চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান প্রায় ৮০ শতাংশ সিন্ধু নদী ব্যবস্থার পানি নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায়, যা তাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. আন্তর্জাতিক সুনাম ও দৃষ্টান্ত : এই চুক্তিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে উত্তর-উপমহাদেশে দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক পরিপক্বতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বব্যাংক-সমর্থিত এ চুক্তি বহুল প্রশংসিত হয় কারণ এটি যুদ্ধ ও বৈরিতার মধ্যেও স্থায়ী শান্তির ক্ষেত্র তৈরি করেছে। অনেক আন্তর্জাতিক গবেষক ও হাইড্রোপলিটিক্স বিশেষজ্ঞ এটিকে ট্রান্সবাউন্ডারি পানি ব্যবস্থাপনার মডেল হিসেবে তুলে ধরেন।
অসুবিধা
১. ভারতের জন্য কৌশলগত সীমাবদ্ধতা : যদিও ভারত ইন্দুস নদীর আপার রিপারিয়ান (উৎসস্থল নিয়ন্ত্রণকারী) দেশ, তবুও পশ্চিমাঞ্চলীয় তিনটি বড় নদী ঝিলাম, চেনাব ও সিন্ধুর পানি ব্যবহারে ভারতের অধিকার অত্যন্ত সীমিত। ভারত শুধু কৃষি ও হাইড্রো-পাওয়ারের জন্য হড়হ-পড়হংঁসঢ়ঃরাব ঁংব করতে পারে। অর্থাৎ, সে পানি ব্যবহার করে আবার ছেড়ে দিতে হয়। কোনো পানি সংরক্ষণ, রুখে রাখা বা ডাইভারশন করা যাবে না। এই সীমাবদ্ধতা ভারতের জম্মু ও কাশ্মির, হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যগুলোর কৃষি, সেচ ও পানিবিদ্যুৎ উন্নয়নের জন্য বড় বাধা হিসেবে দেখা হয়।
২. পাকিস্তানের রাজনৈতিক অপব্যবহার : চুক্তির পরেও প্রায়ই পাকিস্তান রাজনৈতিক কারণে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে যে, ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে পানি আটকে দিচ্ছে বা নিয়ম লঙ্ঘন করছে। বহু সময় দেখা গেছে, ভারতের বৈধ প্রকল্প, যেমন বাগলিহার বা কিশাংগাঙ্গা পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প, যেগুলো চুক্তির সীমার মধ্যেই পড়ে পাকিস্তান সেগুলোকে আন্তর্জাতিক ফোরামে চ্যালেঞ্জ করেছে। এ ধরনের অভিযোগ-রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিচার চাওয়া চুক্তির আস্থাকে নষ্ট করেছে এবং ভারতের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করেছে।
৩. পুরনো কাঠামো ও জলবায়ু পরিবর্তনের উপেক্ষা : ১৯৬০ সালের এই চুক্তি স্বাক্ষরের সময় জলবায়ু পরিবর্তন, গ্লেসিয়ার গলন, নদীর দিক পরিবর্তন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস ইত্যাদি বিষয়গুলো চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বর্তমানে হিমালয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বরফ গলার কারণে সিন্ধু নদীর প্রবাহে বড় রকম পরিবর্তন এসেছে। চুক্তিতে পরিবেশগত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বা জলবায়ুগত প্রভাব মোকাবেলার কোনো ব্যবস্থা নেই, যা এই অঞ্চলের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
৪. নতুন আলোচনা বা পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ নেই : চুক্তির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো এটিতে কোনো পুনর্বিবেচনা, সংশোধন বা বাতিলের ধারা নেই। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট সময় পরপর পুনর্মূল্যায়নের বাধ্যবাধকতাও রাখা হয়নি। ফলে আধুনিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা প্রযুক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী ভারতের নতুন দাবি বা ন্যায্য সংশোধন চাইলেও সেটি সম্ভব নয়। ভারতে এই কারণেই ক্রমেই জনমত তৈরি হচ্ছে যে, এই চুক্তি ভারতের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না এবং এটি ‘অপ্রাসঙ্গিক ও একতরফাভাবে প্রতিকূল’।
চুক্তি বাতিলের প্রভাব : রাজনৈতিক ও কৌশলগত অর্থ
ভারতের সাম্প্রতিক ঁহরষধঃবৎধষ ঘোষণা ছিল সামরিক প্রতিক্রিয়ার অংশ পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিশোধ। পহেলগাম হামলার পর এই পদক্ষেপ ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানের আমূল পরিবর্তন নির্দেশ করে।
পাকিস্তানের জন্য : এক অস্তিত্বসঙ্কট
পাকিস্তানের ৯০ শতাংশের বেশি কৃষি পানি সিন্ধু নদীর ওপর নির্ভরশীল। যদি ভারত পানি আটকে দেয় বা বিলম্বিত করে, তাহলে ভয়াবহ খরা, খাদ্যসঙ্কট ও জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারতের জন্য : পানিকে কৌশলগত সম্পদে রূপান্তর
ভারত স্পষ্টভাবে বার্তা দিয়েছে পানি এখন জাতীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত। ভারত এখন তার আপার রিপারিয়ান অধিকার প্রয়োগ করছে, বিশেষ করে যখন প্রতিবেশী দেশ থেকে নিরাপত্তা হুমকি আসে। তবে, এই পদক্ষেপে ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ : ফারাক্কা ও তিস্তা সঙ্কট
ভারত ও বাংলাদেশ ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী ভাগ করে, যার মধ্যে গঙ্গা (পদ্মা) ও তিস্তা সবচেয়ে সংবেদনশীল। ফারাক্কা বাঁধ দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কের বিষয়। বাংলাদেশ অভিযোগ করে যে, শুষ্ক মৌসুমে ভারত পানি আটকে রাখে, যার ফলে খরা, লবণাক্ততা এবং নদীভাঙন বৃদ্ধি পায়। তিস্তা চুক্তি এখনো স্বাক্ষর হয়নি মূলত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আপত্তির কারণে। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পানি একটি স্নায়ুবহুল ইস্যু হিসেবে রয়ে গেছে।
চীন : ব্রহ্মপুত্র নিয়ে উদ্বেগ
ভারত ব্রহ্মপুত্র (চীনে ইয়ারলুং সাংপো) নদীর নিম্ন প্রবাহে অবস্থিত। চীনের সাথে ভারতের কোনো চুক্তি নেই, শুধু সীমিত মাত্রায় তথ্য বিনিময় হয়। চীনের মেদোগ সুপার ড্যাম-সহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প ভারতের জন্য নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করছে। এখানে ভারত নিজে যেমন বাংলাদেশের জন্য আপার রিপারিয়ান, তেমনি চীনের জন্য লোয়ার রিপারিয়ান এক জটিল কৌশলগত অবস্থান।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা : হাইড্রোপলিটিক্স বনাম মানবতা
ইন্দুস পানি চুক্তি বাতিল নদী কূটনীতির এক বিপজ্জনক নজির স্থাপন করেছে। পানি, যা মানবিক সম্পদ হওয়া উচিত, এখন পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক অস্ত্রে। পাকিস্তানের জন্য এটি হতে পারে অস্তিত্বসঙ্কট, আর ভারতের জন্য এটি হতে পারে কৌশলগত বিজয় কিন্তু তার মূল্য খুব চড়া হতে পারে। এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ এশিয়ায় ডেকে আনতে পারে নতুন বাঁধ নির্মাণ ও পানি নিয়ন্ত্রণ প্রতিযোগিতা, সীমান্ত উত্তেজনা ও যুদ্ধের ঝুঁকি, প্রাকৃতিক পরিবেশে বিশৃঙ্খলা ও জনগণের দুর্দশা বহিঃশক্তির (চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক) হস্তক্ষেপ।
নদী যেন রণক্ষেত্র না হয়
পানি কখনোই অস্ত্রে পরিণত হওয়া উচিত নয়; কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা উপেক্ষা করাও চলে না। কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে ভারত আজ তার পানিসম্পদকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি শান্তি নিশ্চিত করতে হলে, দরকার একটি নতুন ও সময়োপযোগী কাঠামো যেখানে ন্যায়সঙ্গত ও সমবায়ভিত্তিক বণ্টন হবে মূলনীতি।
সিন্ধু পানি চুক্তি কেবল একটি কাগজ নয় এটি উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতার পরীক্ষাগুলো। তার পতন দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন পানিযুদ্ধের সূচনা ঘটাতে পারে। এখন নেতৃত্বের ওপর দায়িত্ব বিশেষ করে ভারতের এটি নিশ্চিত করা যে নদী যেন রক্তের নয়, সহযোগিতার প্রতীক হয়।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক