গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। যুদ্ধ আরো কয়েক সপ্তাহ চললে উপত্যকায় গণমৃত্যু শুরু হতে পারে। এ অবস্থায় গাজা সঙ্কটের নিরসন না হলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখতে হতে পারে বিশ্বকে। প্রশ্ন হলো, ইসরাইল ও হামাস এই সঙ্কটের পরিসমাপ্তি কতটা কীভাবে চায়। আর এর সম্ভাবনা কতটা।
ইসরাইলের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা
ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় মূলত পাঁচটি প্রধান উপায়ে। তারা সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
গুণগত সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন ইসরাইলের প্রধান লক্ষ্য। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র পায়, যাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে তার সামরিক সক্ষমতা সবসময় বেশি থাকে। ইসরাইল তার বিমানবাহিনী, আয়রন ডোম, অ্যারো, ডেভিড স্লিং এবং সাইবার যুদ্ধ সক্ষমতা দিয়ে সম্ভাব্য হুমকি যাতে দ্রুত নিষ্ক্রিয় করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে চায়। লেবাননের হিজবুল্লাহ, হামাস ও সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়ে ইসরাইল নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করে। এ জন্য তারা তালমুদের একটি উদ্ধৃতি দেয় যেখানে বলা হয়েছে, ‘শত্রু তোমাকে আঘাত করবে বলে ধারণা করলে আগেই তাকে ধ্বংস করো।’
নরম শক্তি ও প্রযুক্তিনির্ভর কূটনীতি : ইসরাইল এ লক্ষ্যে নিজের জন্য স্টার্টআপ নেশন-এর ইমেজ তৈরি করতে চায়। এর অংশ হিসাবে পানি, কৃষি, সাইবার, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রযুক্তি রফতানি করে মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকা ও এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করছে।
কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও স্বার্থভিত্তিক সম্পর্ক : ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ চুক্তির মাধ্যমে আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদানসহ মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিজের বৈধতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে ইসরাইল। ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখিয়ে সৌদি আরব, জর্দান, আমিরাতসহ সুন্নি আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইল নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করে ইরানের বিরুদ্ধে একটি অলিখিত জোট গড়ার চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে সিরিয়ায় ধারাবাহিক বিমান হামলার মাধ্যমে ইরানের অস্ত্র সরবরাহ চেন ভাঙার চেষ্টা করছে। আসাদ সরকারের পতনের পরও তেলআবিব এই কৌশল অনুসরণ করছে।
ফিলিস্তিনি প্রশ্ন বিভক্ত রাখা : ফিলিস্তিন ফ্রন্টে বিভাজন রাখার রাজনীতি ইসরাইলের অন্যতম কৌশল। গাজায় হামাস ও পশ্চিম তীরে ফাতাহর মধ্যে বিভক্তি ইসরাইলের কৌশলগত সুবিধা বাড়ায়। এছাড়া ফিলিস্তিন ইস্যুতে মার্কিন কংগ্রেস ও পশ্চিমা মিডিয়ার প্রভাব কাজে লাগিয়ে বিশ্বমঞ্চে ফিলিস্তিনের দুর্বল অবস্থান অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে ইসরাইল।
বহুমুখী জোট ও চুক্তির কৌশল : ভারত, গ্রিস, সাইপ্রাস, ইউরোপীয় দেশ ও আফ্রিকার সাথে নিরাপত্তা ও জ্বালানি চুক্তি করে ইসরাইল তার ভূ-কৌশলগত পরিসর বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল-আমিরাত-ভারতের জোটের মাধ্যমে বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
বস্তুত ইসরাইল সিকিউরিটি ফার্স্ট মতবাদের ভিত্তিতে অস্ত্র, প্রযুক্তি, কূটনীতি, আন্তর্জাতিক জনমত ও জোট গঠনের মাধ্যমে এই অঞ্চলে একটি ‘ছায়া নিয়ন্ত্রণ’ কায়েম রাখতে চায়, যাতে সরাসরি দখল না করেও কৌশলগত প্রভাব ও প্রতিরোধের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর ভূখণ্ড দখল করতে চাইলেও বড় কোনো প্রতিরোধ না থাকে।
ইসরাইলের গাজা যুদ্ধ সমাপ্তি পরিকল্পনা
ইসরাইলের গাজা যুদ্ধ সমাপ্তি পরিকল্পনা বা এই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের লক্ষ্য কতগুলো বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এর মূল লক্ষ্য ও দিকনির্দেশনার মধ্যে রয়েছে :
হামাসকে সম্পূর্ণ অক্ষম করা
ইসরাইলের প্রধান লক্ষ্য হামাসের সামরিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতা ধ্বংস করে তাদের অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করা। মার্কিন ও ইসরাইলি সরকারি বর্ণনা অনুসারে হামাস প্রশাসনিক বা সামরিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকবে না। এর মাধ্যমে ইসরাইল পুরো গাজাকে ফিলিস্তিনশূন্য করতে চায়।
গাজায় রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ : গত ১৫ জুন থেকে ইসরাইল যে অপারেশন গাইডিয়ন’স চ্যারিয়টস শুরু করেছে তার লক্ষ্য গাজার ৭৫ শতাংশ এলাকা দখলে নেয়া এবং তা সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। বাকি অংশে ফিলিস্তিনিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতো বন্দী পরিবেশে থাকতে দেয়া। ফিলিস্তিনিদের উত্তর বা কেন্দ্রের কাছ থেকে সরিয়ে গাজার দক্ষিণে ছোট ভূখণ্ডে ঘেরা নিরাপত্তা (মোরগ) করিডরে স্থায়ীভাবে আলাদা করে রাখা। একই সাথে এর লক্ষ্য রাফাহর কাছে মিসর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে রাখা, যাতে অস্ত্র বা মানুষ প্রবেশ করতে না পারে। এর ফলে গাজার ভূগোল ও সামাজিক গঠন চিরতরে পরিবর্তিত হতে পারে।
‘হিউম্যানিটারিয়ান শহর’
এটি হলো ইসরাইলের রাফায় একটি বন্দী ভূখণ্ড তৈরির ধারণা, যা হবে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত, যেখানে গেলে কেউ বের হতে পারবে না। তথাকথিত ‘হিউম্যানিটারিয়ান শহরে গাজা থেকে বিতাড়িত লাখ লাখ মানুষ থাকবে। এর উদ্দেশ্য হলো, বেসামরিক মানুষদের একটি ছোট এলাকায় গাদাগাদি করে রাখা যাতে তাদের আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকে। মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসঙ্ঘ এটিকে ‘ডি-ফ্যাক্টো বন্দিশিবির’ বলছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনে এথনিক ক্লিয়ারেন্স বা ‘জাতিগত বিতাড়ন’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
শাসন কাঠামো পুনর্গঠন
ইসরাইল গাজায় শাসন কাঠামো পুনর্গঠন করে সিলেক্টিভ নিরাপত্তাব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর মাধ্যমে পশ্চিম তীরের মতো ব্রড-সেক্টর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চায়। যেখানে গাজার নিয়ন্ত্রকরা ইসরাইলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই কেবল সহায়তা করবে।
পরবর্তী অবস্থা ও চ্যালেঞ্জ
ইসরাইলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সামরিক সাফল্য সামান্য। যদিও ৬০০ দিনের বেশি সময় ধরে চলছে যুদ্ধ। এতে বেসামরিক লোকজন উত্তরোত্তর বিপর্যস্ত হয়েছে, তবে হামাস এখনো টিকে আছে। আন্তর্জাতিক আদালত, ইউরোপীয় দেশসমূহ ও জাতিসঙ্ঘের চাপ রয়েছে, যা মানবাধিকার, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার উদ্বেগ জাগাচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য খাতে অবস্থা নাজুক, শিশু ও নারীসহ হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ইসরাইলের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে গাজা স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন, নিয়ন্ত্রিত ও নীরব হবে।
ইসরাইলের এই গাজা সমাপ্তি পরিকল্পনা একটি ডিভাইড, কনটেইন ও কন্ট্রোল কৌশলের অংশ। এর মাধ্যমে করিডোর দিয়ে গাজাকে দুই ভাগে ভাগ করো, ফিলিস্তিনিদের ছোট জায়গায় বন্দী করো এবং শাসন কাঠামো নিজের ইচ্ছায় গড়ে নিয়ন্ত্রণ করো, নীতির বাস্তবায়ন করো।
হামাস কীভাবে গাজা সঙ্কটের পরিসমাপ্তি চায়
হামাস কীভাবে গাজা সঙ্কটের পরিসমাপ্তি চায় এবং তা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য- এই প্রশ্নটি আজকের মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের কেন্দ্রে রয়েছে।
হামাসের চাওয়া : গাজা সঙ্কটের পরিসমাপ্তির জন্য হামাস একাধিক পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এতে পাঁচটি মূল দাবি রয়েছে : যুদ্ধ স্থায়ীভাবে থামাতে হবে, ইসরাইলের আক্রমণ ও অবরোধ বন্ধ করতে হবে; গাজা থেকে ইসরাইলি বাহিনীকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিতে হবে; গাজায় ত্রাণ, ওষুধ, খাদ্য ও পুনর্গঠনের উপকরণ আনতে দিতে হবে অবাধে। অবরোধ সম্পূর্ণ তুলে নিতে হবে; ইসরাইলি কারাগারে থাকা রাজনৈতিক বন্দী ও নারী-শিশুসহ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিতে হবে; গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসনে হামাসের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। ‘বিকল্প শাসক’ বসানোর পরিকল্পনা তারা প্রত্যাখ্যান করে।
এটি কি বাস্তবায়নযোগ্য
বাস্তবায়নের পক্ষে যুক্তি হলো, এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক আদালত যুদ্ধবিরতির পক্ষে। মানবিক বিপর্যয় নিয়ে রয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ। গাজায় খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এ অঞ্চলের প্রধান রাষ্ট্র কাতার, মিসর ও তুরস্কের মধ্যস্থতার প্রস্তাবে হামাসকে ছাড় দিয়ে চুক্তি করতে বলছে না, বরং বাস্তবভিত্তিক চুক্তি খুঁজছে। ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ চাপও ক্রমেই বাড়ছে। দীর্ঘ যুদ্ধ ইসরাইলি জনমত ও রাজনীতিতে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
বাস্তবায়নে অন্তরায় : এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ইসরাইলের ‘হামাস নির্মূল’ নীতি। নেতানিয়াহু সরকার বলছে, হামাসকে ধ্বংস না করে শান্তি অসম্ভব। আরেকটি বাধা হলো যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি। মার্কিন প্রশাসন যুদ্ধ থামাতে চাইলেও ইসরাইলকে পুরোপুরি চাপ দিচ্ছে না। অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্র হামাসকে রাজনৈতিক পক্ষ নয়, নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। আর ইসরাইল চায়, গাজায় হামাসের পরিবর্তে ‘নিরপেক্ষ প্রশাসন’ থাকুক।
হামাসের পরবর্তী পরিকল্পনা
হামাসের পরবর্তী পরিকল্পনা নির্ভর করছে যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক কাঠামোর ওপর। হামাস এখনো সামরিকভাবে সক্রিয়, কিন্তু তারা ভবিষ্যতের জন্য কিছু সুস্পষ্ট কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনার ৫টি স্তম্ভ
হামাস এখনো নিজেকে ‘জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলন’ হিসেবে উপস্থাপন করছে। যুদ্ধ শেষ হলেও ইসরাইলকে পুরোপুরি স্বীকৃতি না দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। তাদের মতে, ‘যুদ্ধ সাময়িক থামলেও, মুক্তি সংগ্রাম থামেনি।’ এ অবস্থান তাদের জনগণের বড় অংশের কাছে জনপ্রিয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে অন্তরায়।
গাজা পুনর্গঠন ও জনসম্পৃক্ততা পুনরুদ্ধার : মানবিক সহায়তা এবং অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ তাদের প্রধান লক্ষ্য। তারা আন্তর্জাতিক সাহায্য (বিশেষ করে কাতার, ইরান, তুরস্ক) ব্যবহার করে নিজেদের ‘দুর্দশার ত্রাতা’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়। যুদ্ধের পর উন্নয়ন কাজ, স্কুল, হাসপাতাল নির্মাণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে জনমত ঘুরিয়ে আনার চেষ্টা থাকবে তাদের।
রাজনৈতিক ফ্রন্টে পুনরায় সংগঠিত হওয়া : যুদ্ধের পর হামাস ফাতাহ বা পিএ-র সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির সমঝোতায় যেতে পারে (অন্তত কাগজে)। তারা চাইবে ফিলিস্তিনি নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়ার, পশ্চিম তীরেও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানো, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর সাথে সংহতি বাড়াবে।
আন্তর্জাতিক বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা : হামাস এখন ‘দ্বিমুখী কৌশল’ নিচ্ছে : একদিকে প্রতিরোধ ও অস্ত্রধারী গোষ্ঠী হিসেবে থাকা, অন্যদিকে নিজেকে ‘শোষিত জাতির বৈধ প্রতিনিধি’ হিসেবে তুলে ধরা।
তাদের লক্ষ্য হলো- কাতার, ইরান, মালয়েশিয়া, তুরস্কের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে সমর্থন বজায় রাখা, জাতিসঙ্ঘ বা ওআইসি পর্যায়ে স্বীকৃতির জন্য এক ধরনের ‘নরম কূটনীতি’ চালানো।
গোপন ও বিকেন্দ্রীভূত প্রতিরোধ মডেল : হামাসের ভবিষ্যতের যুদ্ধ পরিকল্পনা হবে ছায়া যুদ্ধ মডেলে: সুরঙ্গ ব্যবস্থা, ড্রোন, ক্ষুদ্র স্কোয়াডভিত্তিক গেরিলা হামলা, প্রযুক্তি ও সাইবার প্রতিরোধে বিনিয়োগ, ইসরাইলের অভ্যন্তরে আরব জনগোষ্ঠীর সংহতি কাজে লাগানো।
সম্ভাব্য বাস্তবচিত্র
হামাসের সব শর্ত মেনে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম। ইসরাইল সম্ভবত এই শর্তগুলোকে ‘আত্মসমর্পণের বিপরীত’ বলবে। আংশিক শর্তে চুক্তি (যেমন : যুদ্ধবিরতি + বন্দিবিনিময়) হওয়ার সম্ভাবনা মাঝারি। আন্তর্জাতিক চাপ বাড়লে এটি সম্ভব। তৃতীয় পক্ষ দ্বারা গাজা শাসন (হামাসের অংশগ্রহণ ছাড়া) হবে ঝুঁকিপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে হামাস আবার সঙ্ঘাত ফিরে আসতে পারে। এর অর্থ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও ধ্বংস, যেটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতা তৈরি করবে।
হামাসের যুদ্ধ পরিসমাপ্তির রূপরেখা রাজনৈতিকভাবে সম্ভব। এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ত্রিপক্ষীয় চুক্তি (ইসরাইল-হামাস-মধ্যস্থপক্ষ), গাজার পরবর্তী প্রশাসনের ওপর সমঝোতা (হয়তো একটি অন্তর্বর্তী সরকার) এবং যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নে সমঝোতা বা দায়িত্ব নিরূপণের সময়ক্ষেপণ।
হামাসের সামনে এখন তিনটি পথচিত্র রয়েছে। প্রথমটি হলো : রাজনৈতিক পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন। এর আওতায় যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে হামাস রাজনৈতিক বাস্তবতায় ফিরে আসতে পারে। নিজেদের ‘গাজার প্রশাসক’ না বলে ‘জাতীয় ঐক্যের অংশ’ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। ফিলিস্তিনি নির্বাচন বা অন্তর্বর্তী সরকারে অংশগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে।
এটি বাস্তবায়নের শর্ত হবে যুদ্ধবিরতি ও ইসরাইলের আংশিক সেনা প্রত্যাহার করে। মিসর, কাতার ও তুরস্ক কূটনৈতিকভাবে হামাসকে ‘কঠিন থেকে নমনীয়’ মনোভাব দেখাতে সাহায্য করে। গাজার পুনর্গঠন হামাসকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়।
এর ইতিবাচক পরিণতি হবে, গাজায় স্থিতিশীলতা ও সহায়তার প্রবাহ বাড়বে, পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সীমিত সংলাপ শুরু হতে পারে, আন্তর্জাতিক বৈধতার পথে আংশিক অগ্রগতি হবে। আর নেতিবাচক দিক হলো, হামাসের অস্ত্র জমা দিতে হবে, যা তাদের প্রভাব কমাতে পারে, ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বাড়তে পারে।
দ্বিতীয় পথচিত্র হলো, গোপন গেরিলা প্রতিরোধ ও ‘স্মার্ট জিহাদ’ মডেল। এর মূল কৌশল হবে : গাজায় হামাস প্রশাসনিক দখল হারালেও সামরিকভাবে ছায়া প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। ‘সাইবার, ড্রোন, টানেল ওয়ারফেয়ার, স্মল সেল ডেটাভিত্তিক যুদ্ধ’ চালাবে। ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তুতে নির্বাচিত, হাই-প্রোফাইল হামলা চালিয়ে নিজেকে সক্রিয় রাখবে।
এটি বাস্তবায়নের শর্ত হবে ইসরাইলের গাজার ওপর দীর্ঘমেয়াদি সামরিক উপস্থিতি রেখে প্রশাসন চালাতে চাওয়া। হামাস জনসাধারণের ওপর প্রকাশ্যে শাসন আর না চালিয়ে গোপন ও বিকেন্দ্রীভূত সংগঠন গড়ে তুলতে পারে।
এর ইতিবাচক পরিণতি হলো : হামাস ‘মুক্তিযোদ্ধা ভাবমূর্তি’ ধরে রাখতে পারবে, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি ধরে রাখতে সক্ষম হবে, কাতার/ইরান থেকে গোপন অর্থায়ন অব্যাহত থাকবে। আর নেতিবাচক দিক হলো, গাজায় স্থায়ী অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে, ইসরাইল প্রতিনিয়ত গাজা চষে বেড়াবে, মানবিক বিপর্যয় চলবে।
তৃতীয় পথচিত্র হলো আঞ্চলিক সঙ্ঘাতে একীভূত হওয়া। এর আওতায় হামাস নিজেকে শুধু গাজার নয়, বরং ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। ইরান, হিজবুল্লাহ, হুথি ও ইরাকি মিলিশিয়াদের সাথে একত্রিত সামরিক ফ্রন্ট গড়ে তুলতে পারবে। ভবিষ্যতের যেকোনো ইসরাইল-ইরান সঙ্ঘাতে গাজা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।
এটি বাস্তবায়নের শর্ত হলো গাজায় যুদ্ধ শেষ না হয়ে ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা চূড়ায় পৌঁছানো। লেবানন বা পশ্চিম তীরে বড় সঙ্ঘাত হওয়া, যেখানে হামাস সহ-আক্রমণ চালাতে সক্ষম হবে।
এর ইতিবাচক দিক হলো, হামাস আঞ্চলিক শক্তির অংশ হিসেবে নিজেদের মর্যাদা তুলে ধরতে পারবে, গাজার বাইরেও প্রতিরোধী ভাবমূর্তি বাড়াতে পারবে, হুথি বা হিজবুল্লাহর সহযোগিতা সরাসরি যুদ্ধসক্ষমতা বাড়াবে। এর নেতিবাচক দিক হলো, এটি হামাসকে আরো বেশি পশ্চিমা ‘সন্ত্রাসী’ তালিকাভুক্ত করবে, ইসরাইল চূড়ান্তভাবে গাজায় পূর্ণ দখল ও জনবসতি উচ্ছেদ করতে পারে, ফিলিস্তিনি জনগণ আন্তর্জাতিক যুদ্ধের শিকার হতে পারে।
তুলনামূলকভাবে পথচিত্র-১ এর জনপ্রিয়তা বেশি। এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাঝারি সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সামরিকভাবে টিকে থাকা কঠিন হলেও দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকা সম্ভাবনা রয়েছে। এতে মানবিক পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। পথচিত্র-২ এ সামরিকভাবে টিকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মানবিক পরিস্থিতি নাজুক হতে পারে। পথচিত্র-৩ এ সামরিকভাবে টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি রয়েছে। তবে মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। পথচিত্র-২ কম প্রচারিত, কিন্তু হামাসের জন্য কৌশলগতভাবে টিকে থাকার পথ বলে মনে হয়।
হামাসের ভবিষ্যৎ মূলত রাজনৈতিক উদারতা বনাম কৌশলগত প্রতিরোধ এই দুইয়ের ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করছে। যদি তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায় তবে পথচিত্র-১ হতে পারে বাস্তববাদী; আর ইসরাইলি দখল যদি তারা মেনে না নেয় তা হলে পথচিত্র-২ অবশ্যম্ভাবী; অন্যদিকে বড় আঞ্চলিক সঙ্ঘাতে যেতে চাইলে পথচিত্র-৩ বিপজ্জনকভাবে সম্ভব।
বিশ্লেষণ অনুসারে পথচিত্র-২ এর সম্ভাবনা ৬২ শতাংশ। পথচিত্র-১ সবচেয়ে স্থিতিশীল ও বাস্তবভিত্তিক বিকল্প, কিন্তু ইসরাইলের অনুমোদন ছাড়া এটি অসম্পূর্ণ। এর সম্ভাবনা ৫৬ শতাংশ। পথচিত্র-৩ ইরান বা হিজবুল্লাহর সঙ্ঘাতের ওপর নির্ভরশীল, এটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং বড় ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। বিশ্লেষণ অনুসারে এর সম্ভাবনা ৪৬ শতাংশ।
সবশেষে বলা যায়, পথচিত্র-২ সবচেয়ে সম্ভাব্য পথ এবং এটি হলো ছায়া প্রতিরোধ ও বিকেন্দ্রীকরণ মডেল। এটি হামাসের জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও নিজস্ব কৌশলের ধারাবাহিকতা। যদিও এতে গাজার পুনর্গঠন বিলম্বিত হবে, কিন্তু হামাস অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে এবং পরবর্তী ‘বড় প্রতিরোধ’-এর প্রস্তুতি নিতে পারবে।
এই পথ যদি অনুসৃত হয় গাজা দীর্ঘমেয়াদি সামরিক অবরোধ ও প্রশাসনিক দুর্যোগে থাকবে। হামাস নিজেদের উদ্দিষ্ট প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে প্রকাশ করবে, কিন্তু গোপনে কাজ করবে। ইসরাইল গাজা দখল না করলেও স্থায়ী সামরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে। জনগণের দুর্ভোগ বাড়বে, কিন্তু সশস্ত্র প্রতিরোধ পুনরায় উত্থিত হতে পারে এক থেকে তিন বছরের মধ্যে। তখন ইসরাইল তার অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে পারে।
[email protected]