বাবার পথে হাঁটলেন মেয়ে

দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যেমন রাজনৈতিক সত্তার বিলোপ ঘটেছে, তেমনি হাজার হাজার নেতাকর্মী চরম ঝুঁকিতে পড়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের একটি কথা রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, নেয়ারলি অল মেন ক্যান স্ট্যান্ড অ্যাডভারসিটি, বাট ইফ ইউ ওয়ান্ট টু টেস্ট এ ম্যান’স ক্যারেক্টার, গিভ হিম পাওয়ার। বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘প্রায় সব মানুষই প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারে; কিন্তু কারো চরিত্র যাচাই করতে চাইলে তাকে দাও ক্ষমতা।’ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব ছিলেন এ দেশের জনগণের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে কালক্রমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির মাঠে নিজেকে একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ওই সময়ে তার ভূমিকা ছিল গণতন্ত্রের পক্ষে এবং অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করা। যার কারণে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ দেশের জনগণ তাদের শাসক হিসেবে শেখ মুজিবকে বেছে নিতে কোনো বিকল্প চিন্তা করেননি। এমনকি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিপদগ্রস্ত এ দেশের জনগণকে কোনো দিকনির্দেশনা না দিয়ে শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে যুদ্ধকালীন পাকিস্তানের কারাগারে নিরাপদে থাকলেও জনগণের কাছে তিনি মহানায়কের ভূমিকাতে ছিলেন। অর্থাৎ- এ পর্যন্ত শেখ মুজিব ছিলেন জনগণের কাছে বিকল্পহীন এক নেতা।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাহীন শেখ মুজিব ক্ষমতার মসনদে বসার আগে জনগণের অধিকার আদায়ে যত সংগ্রাম করেছেন, ক্ষমতায় বসার পরমুহূর্তে সেই শেখ মুজিব দেশের মানুষের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে ন্যূনতম বিচলিত বা দ্বিধা করেননি। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের; কিন্তু স্বাধীনতার পরে শাসক শেখ মুজিব গণতন্ত্র বিনাশে তৈরি করলেন একদলীয় বাকশাল। কেড়ে নিলেন মানুষের সবধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার। শেখ মুজিবের বিপক্ষে কথা বলার পরিণতি ছিল নিশ্চিত মৃত্যু, গুম অথবা সইতে হতো নির্যাতনের সর্বোচ্চ মাত্রা। সরকারি দলের লোকজন দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি-ডাকাতিসহ লুণ্ঠনের এক নিরাপদ অভয়ারণ্য ছিল শেখ মুজিবের শাসনামল। চরম দুর্নীতি আর দুঃশাসনে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল দেশ। রাষ্ট্র হয়ে পড়েছিল আইনের শাসনহীন এমন এক কঙ্কালসার, যার নামমাত্র অঙ্গপ্রতঙ্গ ছিল; কিন্তু বিচরণ করার ক্ষমতা ছিল না। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে শেখ মুজিবকে জীবন দিতে হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের আগে যে শেখ মুজিব জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন, ক্ষমতায় বসার পর সেই তিনি মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়েছিলেন। তার এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও জনগণের হৃদয়ে একটু সহানুভূতি ফুটে ওঠেনি। উপরন্তু অনেক মানুষ উল্লাসে মিষ্টি বিতরণ করেছেন। আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করেছেন।

যে নেতার ডাকে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে ছুটে আসতেন, মসনদে বসা একই ব্যক্তি মানুষের কাছ থেকে শুধু ঘৃণা কুড়িয়েছেন। ১৯৪৯ সালে যিনি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরহণ করতে সক্ষম হন, তার হাত ধরে আওয়ামী লীগের বিলুপ্তি ঘটে। প্রকৃত অর্থে রাজপথের শেখ মুজিব যতটা উজ্জ্বল ছিলেন, শাসক শেখ মুজিব ততটাই বিবর্ণ ছিলেন। শেখ মুজিবের সফলতা-ব্যর্থতার ইতিহাস হয়তো মানুষ এ পর্যন্ত আলোচনায় রাখতেন। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী তার ভূমিকার কারণে হয়তো শাসন আমলের দুঃশাসন বিস্মৃত হতেন। তার মর্মান্তিক মৃত্যু মানুষের সহানুভূতি নিয়ে ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারত; কিন্তু তার কন্যা শেখ হাসিনা তার সেই নির্মম শাসনের ভয়াবহ ক্ষতগুলো এ প্রজন্মের কাছে এত বেশি আলোচনার সুযোগ করে দিলেন যে, মানুষ এখন শেখ মুজিব নামটি আবার ঘৃণা করতে শুরু করেছেন।

শেখ মুজিব বাকশাল গঠনের পর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগকে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান পুনরায় সাংগঠনিকভাবে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। এরপর শেখ হাসিনা তার অনুপস্থিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে কার্যকরভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পর শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করলেও ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে নির্বাচন করে শেখ হাসিনা নিজের দেয়া জাতীয় বেঈমান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে তীব্র আন্দোলন করে। ১৮৬ দিন হরতাল দিয়ে দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। হরতাল, হামলা, অবরোধ এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দেশ ছিল বিপর্যস্ত। ২০০৪ সালে বাসের মধ্যে গান পাউডার নিক্ষেপ করে ১৫ জনকে হত্যার মতো বর্বর ঘটনাও ঘটানো হয়। এসবের মূলে ছিল যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত হাসিনার প্রথম শাসনামল খুব একটা সুখকর ছিল না। রাজপথে বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা ছিল ভয়াবহ। দুর্নীতি ছিল তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত। হাতে তসবিহ এবং মাথায় হিজাব পরে, চোখের পানি ঝরিয়ে শেখ হাসিনা মানুষের কাছ থেকে ভোটের সুবিধা আদায় করে ক্ষমতায় এসে সব কিছু বেমালুম ভুলে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর চালিয়েছিলেন অবর্ণনীয় নির্যাতন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল।

নেতিবাচক রাজনীতির এক নিষ্ঠুর খেলায় শেখ হাসিনা মেতে উঠেছিলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ দিনে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা করে পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছিলেন। হাসিনার হিংসাত্মক রাজনীতির কারণে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের নামে দেশ সেনাসমর্থিত অসাংবিধানিক একটি সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। ২০০৮ সালের ম্যানেজড নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বিডিআর ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসনের সূত্রপাত ঘটান। এ সময় থেকে টানা ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ১৫ বছর সাত মাসের দীর্ঘ শাসনামলে বাংলাদেশকে একটি গণতন্ত্রহীন নৈরাজ্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। নিষ্ঠুরতার দিক থেকে পৃথিবীর সব স্বৈরশাসককে পেছনে ফেলেন। ভোটাধিকার থেকে শুরু করে সাংবিধানিক সব অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করেন।

শেখ হাসিনার দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী জমানায় প্রতিবাদীদের হত্যা, গুম, জেল-জুলুম ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আয়নাঘর নামের এক লোমহর্ষক টর্চারসেলের সাথে এ দেশের মানুষ পরিচিত হন। যেখানে বছরের পর বছর বন্দী রাখা হতো গুমের শিকার ব্যক্তিদের। দুর্নীতি, অর্থপাচার সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার নেশায় পরিণত হয়েছিল। প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির দায়ে সরকারি দলের কারো বিচার হয়েছে এমন নজির নেই। বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে এবং কানাডা, মালয়েশিয়া, মরিশাসের মতো দেশে সেকেন্ড হোম এবং বেগমপাড়া তৈরি হয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সূত্র মতে, হাসিনার শাসনামলে ২৮৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।

২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের দিনের ভোট রাতে এবং ২০২৪ সালে হয়েছিল আমি-ডামির নির্বাচন। ভোটার এবং অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে একধরনের প্রহসন করা হয়েছিল। ভারতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে বাংলাদেশের ভোটব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়। মূলত ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন শেখ হাসিনাকে বেপরোয়া এবং চরম ফ্যাসিবাদী হওয়ার পেছনে কাজ করেছিল। শেষ পর্যন্ত কোটাবিরোধী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তার পতন নিশ্চিত হয়। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের এ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নেমে এসেছিল। শেখ হাসিনার নিষ্ঠুরতায় এক হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণ গেছে। হাজার হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এত কিছুর পরও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে চরম বিপদে ফেলে ভারতে পালিয়ে গিয়ে শেখ হাসিনা নিজের জীবন বাঁচান।

এখনকার বাস্তবতা হলো- দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। শেখ হাসিনার নিষ্ঠুরতায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের আদালতের বিচারে তিনি ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। সামনে আরো বহু মামলা বিচারাধীন। আলোচনার এ প্রান্তে এসে আমরা বলতে চাই, শাসক হিসেবে শেখ হাসিনা তার পিতা শেখ মুজিবের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। ফল হিসেবে পিতাকে জীবন দিতে হয়েছে, আর শেখ হাসিনাকে পালিয়ে জীবন বাঁচাতে হয়েছে। আর দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যেমন রাজনৈতিক সত্তার বিলোপ ঘটেছে, তেমনি হাজার হাজার নেতাকর্মী চরম ঝুঁকিতে পড়েছেন।

লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক