খলিলপুরের খগেন ব্যানার্জিদের আট ভাই ও পাঁচ বোনের সংসারে সমস্যার যেন শেষ নেই। একটা না একটা ঝামেলা লেগে আছে। বাড়ির বড় কর্তা খগেন বাবু আর তার স্ত্রী সুশীলা দেবী সংসারের হাল ধরে আছেন না বলে, সবাই বলাবলি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে নানান ফন্দিফিকির এঁটে চলেছেন। বোনদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের ঘরে সন্তানসন্ততির সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর আট ভাই তো যে যার মতো বড় করছে তাদের এখতিয়ার ও তালুক। কিন্তু বড়দা ও বৌঠানের ওপর ভাইবোনদের অপ্রকাশযোগ্য অভিযোগ অনুযোগের যেন শেষ নেই। সবার মুখে কুলুপ আঁটা। কেউ কোনো অভিযোগ প্রকাশ্যে আনতে পারে না। বাইরের কারো কাছে বলতে গেলেও খোটা শুনতে হয়। গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত হোক- সবসময় একটা ‘ঠাণ্ডা’ যুদ্ধ, অত্যন্ত ঘরোয়া পর্যায়ে বিদ্যমান। ব্যানার্জিদের বাড়ির বাইরে তো দূরের কথা, ঘরের বারান্দা পর্যন্ত নানান নিরাপত্তা আইনের মতো ভয়ে কেউ ক্ষোভ, নিন্দা ও হিংসা প্রকাশ করতে পারত না। কারণ তারা বাড়ির বড় কর্তা ও কর্ত্রীর কূটকচাল ও চরিত্রের ধারেকাছে ভিড়তে পারে না। বাড়ির বড়কর্তা যতটা না করিৎকর্মা, সংসারের কূটকচালে সুশীলা দেবী তার চেয়ে চার কাঠি বড়। এর ওপর ছিল পারিবারিক বা গৃহপালিত দু’জন মুখপাত্র নান্টু আর বল্টু- তারা শরিকের কারো কোনো কথা মাটিতে পড়তে দিত না, মুখ ভেঙচিয়ে আর টেনে টেনে শব্দ বের করে কথা বলত। নিজেদের কাজের কোনো কথা নেই, কর্তা-কর্ত্রীর পক্ষে সাফাই গাওয়াই যেন ছিল তাদের বিধিবদ্ধ দায়দায়িত্ব।
খগেন-সুশীলার ঘরে যে দিন তাদের বড় মেয়ে নবনীতা মায়ের কোল আলো করে আসে, সে দিন ব্যানার্জি পরিবারে প্রবল আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়, যদিও পৈতৃক জমিজমার সেরেস্তাদারিতে সে হয়তো ভাগ বসাতে পারবে না, তবু সে তো এ পরিবারের প্রথম প্রজন্ম।
ব্যানার্জিদের স্থাবর-অস্থাবর সহায় সম্পত্তিতে ভাগবাটোয়ারায় প্যাঁচ লেগে থাকত। আগেকার জমানায় নায়েব বরকন্দাজদের যেভাবে ম্যানেজ করা যেত, এখন সেভাবে তাদের সে অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে না। আগে তহশিল অফিসে নথি দলিল পরচা খতিয়ান একটা কঠোর নিয়ম মেনে মেইনটেন করা হতো। এখন ভূমি প্রশাসনে বড় কর্তার সংখ্যা যত বাড়ছে, দলিল দস্তাবেজ সংরক্ষণ ও রেজিস্ট্রি, নামজারির পদ্ধতি যত ডিজিটালের পথে রয়েছে; তত ম্যানুয়াল ফন্দিফিকির শুরু হয়েছে। বড় কথা, দলিল দস্তাবেজে রেকর্ডপত্র যথাস্থানে থাকছে না। একজনের জমি নানাজনের নামে খতিয়ান খুলে দেয়া হচ্ছে। সূত্র বা ধারাবাহিকতা ঠিক রাখার বালাই নেই, সিএস, আরএস, বিএস, জরিপ নামীয় গোত্র-গোষ্ঠীভুক্ত করতে গিয়ে, শ্রেণী পরিবর্তনের নামে ঘাটকে অঘাট করা হচ্ছে, সাইলকে সিকস্তি, সিকস্তিকে জলাবন্দী সাব্যস্ত করা চলছে হরহামেশা, এর ফলে সাধারণ রায়ত পড়ছে নানান বিপাকে, ভূমিদস্যুরা সে সুযোগে জমি দখল-বেদখল করে চলছে। ভূমিহীনদের খাসজমি বাড়িঘর পাইয়ে দিতে গিয়ে ভূমি কর্তাদের নীলচাষি জমিদারি মনোভাব দেখার মতো। রানীমাতার নামে আরো জমি চাই, আরো ঘর বর ও বাড়ি দেয়া চাই। পক্ষ-বিপক্ষের কাছ থেকে টাকা হাতানোর এ স্বাধীন ও অবাধ সুযোগ হাতছাড়া করতে কেউ চায় না।
মানিকখালীর হরেন মণ্ডলের এক দাগে পাঁচ বিঘা জমি ছিল শোরা মৌজায়। এসএ খতিয়ান থেকে আরএস খতিয়ানে তোলার সময় তার পাঁচ শরিকের নাম সেখানে ঢুকে পড়ে। হালে বিএস খতিয়ান ও জরিপকালে পাঁচ বিঘার জমি রেকর্ড হয়েছে মোট ১২ জনের নামে। কার কোন অংশ তার চৌহদ্দি বণ্টননামা খতিয়ানে নির্দিষ্ট করা যায়নি। এখন এই ১২ জনের মধ্যে পাঁচজনের কাছ থেকে রমজান নগরের নরিম শেখ সাড়ে চার বিঘা জমি লিখে নেয়। বাকি আধা বিঘা জমি নেয় হরিনগরের নগেন মাঝি। এখন বাকি শরিকদের একজন সুরেন মণ্ডলের থেকে একই দাগে ১৬ শতক জমি কিনতে চায় বংশীপুরের শশিভূষণ কাপালি। চতুর ও চালাক নায়েব পয়সা খেয়ে যাকে-তাকে জমির হালনাগাদ খাজনা রসিদ কেটে দিয়েছে। ১২ শরিকের এক শরিক পরানপুরের পরিমল কয়েক শতক জমি বিক্রি করার সময় মামলাবাজ মনসুর মাদবর ফারাজ অংশ হারাহারি সবকিছু মেলাতে গিয়ে দেখে, জোতে আসলে জমি নেই। এখন নামজারির মোকদ্দমা (মিস আপিল কেস) আপত্তি দেয়া লাগবে, একজনের জমি আরেকজন কিভাবে লিখে দেয়।
নবনীতা বিষয়টি একটু বড় পরিসরে ভাবতে বা দেখতে চায়। নবনীতা আইন ও সমাজবিজ্ঞানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ব্যানার্জি পরিবারের সম্পদ ও সৌভাগ্য বণ্টনপ্রক্রিয়াকে সে একটি গোটা পরগনার সৌভাগ্যকে প্রতিপক্ষের কাছে নানান ফন্দিফিকিরে বিলি বণ্টন বন্দোবস্ত দেয়ার শামিল বলে উচ্চকণ্ঠ হতে চায়। তবে তার এই উচ্চারণ যেন পারিবারিক নিবর্তনমূলক কোনো আচারবিচার নীতিনিয়মের পরিপন্থী বা সাংঘর্ষিক না হয়; সে ব্যাপারে তাকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। এত কড়াকড়ির মধ্যে ন্যায়-ন্যায্যতার সপক্ষে স্বাধীন চিন্তা বা মুক্তবুদ্ধি বিবেক কিভাবে বিকাশ লাভ করবে- নবনীতা ভেবে কূল পায় না।
ব্যানার্জিদের চার পাশে এক বা একাধিক শক্তিশালী প্রতিবেশী পরিবার। তারা খগেনদের দুর্বল করতে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে। ভেতরের শরিকদের ক্ষোভ যন্ত্রণা যত বেড়ে ওঠে, খগেনরা তত শক্তিশালী প্রতিবেশী পরান সরকারের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের পৈতৃক সম্পত্তি ও স্বার্থ নিজেদের ভাইবোনের দিকে না তাকিয়ে সে একসময় চরম শত্রু ও প্রতিপক্ষ পরান বাবুকে আজ একটু কাল একটু করে দিত। ব্যানার্জিদের দক্ষিণ সীমানা উন্মুক্ত, বিশাল বনরাজি। এ বনের অংশ ব্যানার্জিদের ভাগে বেশি আর পরানের অংশেও কিছু আছে। পরানের বনের অংশে ক্ষতিকর কিছু না করে ব্যানার্জিদের বন উজাড় করার এক ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে দুই পরিবার। ভেতর থেকে সমস্যা যত গজায় পরানের সাথে দরকষাকষির শর্ত তত শিথিল হয়ে পড়ে, খগেন পরানের পুতুলে পরিণত হয়। ব্যানার্র্জিদের পরিবারের মধ্যে অন্তর্দ্ব›দ্ব যত জিইয়ে থাকে, পরান বাবুদের তত পোয়াবারো। পরান বাবুর কূটবুদ্ধিও শিষ্যরা ভেতরে ভেতরে খগেনের প্রতিপক্ষকে অনুকম্পা দেখানোর নাম করে তাদের আরো মারমুখী হতে উসকে দেয়। এক দিকে বিরোধীদের সহায়তার নাম করে, আবার অন্য দিকে খগেনকে সাহস জোগায়। দুই ক্ষেত্রে পরানের দখলদারিত্বের ইচ্ছা বেগবান হয়। তবে এ দখলদারিত্ব এখন ভৌতিক নয়, ভূ-রাজনীতির।
যৌথ সংসারের সবার মতামত না নিয়ে, আদৌ কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনো কাজে আসবে কি না, তার অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে, নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে খগেন পরিবারের লাঠিয়াল সর্দার বা তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কেনাকাটার দায়িত্ব দেয় । এ কাজে কাগজ-কলম ঠিক করে যারা দিলো তাদের হাতে রাখত বড় বড় পদবিতে এনাম দিয়ে দিত খগেন-সুশীলারা। এক ঢিলে দুই পাখি মারার বুদ্ধিটা সে পেয়েছিল পাশের বাড়ির পক্বকেশ পণ্ডিতের কাছ থেকে। পাশের বাড়ির লোকেরা সবসময় চেয়েছে, খগেনের সংসার তাদের অনুগত থাকুক। কেননা, খগেনের সংসারে আগুন জ্বললে তার আঁচ তাদের ঘরে লাগতে পারে। গ্রাম্য রাজনীতি এমন মজাদার যে, শত্রু-মিত্র হতে, আর মিত্র-শত্রুতে ভোল পাল্টাতে সময় লাগে না। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের কৌশল সেখানে প্রায়ই প্রয়োগ হয়। খগেন সংসারের সব সম্পদ সুযোগ-সুবিধা নামে-বেনামে পরিবারের চরম শত্রুদের এমনভাবে দিয়ে গেছে যে, একসময় দেখা যাবে তাদের জোতে ভোগ বা বিক্রি করার মতো আর কোনো জমি অবশিষ্ট নেই। ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মতলব নিয়ে সে গোটা সংসার বা পরিবারকে ফতুর করে ফেলেছে। পরশ্রীকাতর প্রতিবেশীদের দাবার ঘুঁটি হয়ে খগেন-সুশীলা গংরা তাদের জন্য স্বস্তির কিছু রেখে যায়নি। খগেন ও তার সাগরেদরা দেশ ছেড়ে চলে গিয়ে হয়তো বাঁচবে; কিন্তু যারা ভেতরে থাকবে সেই ব্যানার্জিদের বনেদি পরিবারের দুঃখ-দুর্দশা বেড়েই চলেছে। যেমনটি তাদের ঠাকুদাদের আমলে ছিল। যদিও সময়ের অবসরে অনেক স্রোত গড়িয়েছে তাদের খোলপেটুয়া-মাউন্দো নদীতে।
খগেনদের বাড়ির দু’পাশে পড়শি পরান সরকারের কিছু জমি আছে। এধারের জমি থেকে ওধারের জমিতে যাওয়ার বাধা ব্যানার্জিদের ঘরবাড়ি-পথঘাট। একবার দু’পরিবারের মধ্যে দারুণ হাঙ্গামা বাধে দু’ধারের জমিতে যাওয়া-আসা নিয়ে। পরান সরকারের ভয় খগেনরা কখন তার আগের জমি জবরদখল নিয়ে নেয়। অদল বদল করে নেয়ার প্রস্তাব মাঝে মধ্যে দু’দিক থেকে ওঠে; কিন্তু কৌশলগত কারণে তা বাস্তবায়নের মুখ তো দেখেই না; বরং এ রেষারেষি মাঝে মধ্যে বেকায়দা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। বিশেষ করে ধান কাটার মৌসুমে। লাঠিয়াল বাহিনী দু’পক্ষের আছে। তারা তেড়ে আসে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। দু-একটি খুনোখুনিও হয়েছে এর মধ্যে। এ ধরনের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিজের কর্তৃত্ব ঠিক রাখতে, ভাইবোনদের অন্ধকারে রেখে খগেন, পরান সরকারের সাথে দহরম মহরম বাড়িয়ে দেয়। পরান সরকারের জমিজমা লোকবল বেশি। সে জানে খগেনকে কাবু বা করায়ত্ত করতে পারলে তার বাড়ির ওপর দিয়ে পশ্চিমের জমিতে যাওয়া-আসা কোনো ব্যাপার না। খগেনের আপন শরিকরা পরান সরকারের এ আচরণকে ভালো চোখে দেখে না। তারা পরান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল নেয়। খগেনের এতে পোয়াবারো। সে পরান সরকারকে খেপিয়ে তোলে তার পরিবারের অপরাপর সদস্যদের বিরুদ্ধে। খগেনের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর ওজর আপত্তি পরান সরকার তাদের পথে বসাবার মতলবে তার সাথে হাত মিলিয়েছে। খগেন তাদের বাড়ির আঙিনা দিয়ে পরান সরকারের লোকলস্কর জিনিসপত্তর পরিবহনের সুযোগ দিচ্ছে বা নিচ্ছে; কিন্তু ব্যানার্জি পরিবারের খাল-বিলে পানি পাওয়ার পথ আটকিয়ে দিয়েছে। আর ব্যানার্জিদের পক্ষে খগেন পরান বাবুর সাথে এ ধরনের আঁতাত করার ফলে অন্য শরিকরা পঞ্চায়েতে আর বিচার দিতে পারে না। পানির ভাগ চাইতে পারে না। সবাই এখন মনে করে, খগেন বাবু তার সব দিয়ে-খুয়ে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য দেউলিয়া পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
লেখক : অনুচিন্তক



