চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে

শ্রীলঙ্কার কলম্বো এবং ভারতের মুন্দ্রা বন্দরের উদাহরণ প্রমাণ করে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে এবং প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিশ্চিত করলে চট্টগ্রাম বন্দরও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এটি অদক্ষতা ও দুর্নীতির এক বিপজ্জনক জালে আটকা পড়ে আছে। এটি শুধু আমদানি-রফতানির খরচ বাড়াচ্ছে না; বরং জাতীয় অর্থনীতির মূল ভিত্তিকেই দুর্বল করছে। এই অদক্ষতার প্রধান লক্ষণগুলো স্পষ্ট, যা সরকারের রাজস্ব ক্ষতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশের সুনাম ক্ষুণœ করছে।

বন্দর অব্যবস্থাপনার জাঁতাকলে অর্থনীতি

বন্দর অব্যবস্থাপনার মূল শুধু প্রযুক্তির অভাব নয়, এটি নৈতিকতা ও প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যর্থতা। প্রথমত, কাস্টমস ও বন্দরের কিছু কর্মকর্তা শুল্ক মূল্যায়নে ইচ্ছাকৃতভাবে জটিলতা তৈরি করে ব্যবসায়ীদের এক ধরনের ‘সমঝোতা’ বা অনানুষ্ঠানিক পথে যেতে বাধ্য করেন। এই সমঝোতার অর্থ হলো- প্রাপ্য শুল্কের একটি বড় অংশ সরকারের কোষাগারে না গিয়ে সরাসরি কাস্টমস কর্মকর্তার পকেটে চলে যায়। অনুমান করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় সরকার বছরে আট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব হারাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, শ্রমিক সিন্ডিকেটের কৃত্রিম কালক্ষেপণ লজিস্টিক খরচকে আকাশচুম্বী করছে। যে কনটেইনার খালাস করতে চার ঘণ্টা লাগার কথা তা ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় নেয়। এই অতিরিক্ত ‘অনানুষ্ঠানিক খরচ’ ছোট আমদানিকারকদের মুনাফার ৩০-৪০ শতাংশ খেয়ে ফেলে। অন্যদিকে, একটি কনটেইনার বন্দরে ১২-১৫ দিন আটকে থাকা মানে তা ‘মৃত পুঁজি’তে পরিণত হওয়া। সঠিক সময়ে ডেলিভারি নিশ্চিত করতে না পারায় দেশের রফতানিকারকরা সরবরাহকারী হিসেবে আস্থা হারান এবং বড় অর্ডার থেকে বঞ্চিত হন।

আমলাতন্ত্রের থাবা ও পেশাদার নেতৃত্বের আবশ্যকতা

অব্যবস্থাপনার মূল কারণ প্রশাসনিক পক্ষাঘাত। এর মূলে রয়েছে বাংলায় প্রচলিত নৈরাশ্যবাদী সংস্কৃতি ‘কাকের গোশত কাকে খায় না’। গতানুগতিক তদন্ত ও মন্থর বিচারপ্রক্রিয়া এই মহামারী মোকাবেলায় সম্পূর্ণ অক্ষম। একজন প্রাক্তন চেয়ারম্যানের মতামত অনুযায়ী, বন্দরের মতো সংস্থায় আমলাদের ডেপুটেশন একটি বড় সমস্যা। আমলারা মূলত ‘ধীর বাস্তবায়ন, বিধিনিষেধের নেতিবাচক ব্যাখ্যা এবং উদ্যোগ দমনের জন্য প্রশিক্ষিত ও অভ্যস্ত।’ তাই সরকারি ব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে এসে বন্দর ও সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোকে অবিলম্বে করপোরেট কাঠামোর আওতায় আনা প্রয়োজন। এর জন্য উপযুক্ত ব্যবসায়িক ও বাজারজাতকরণ জ্ঞানসম্পন্ন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ করা যেতে পারে। নীতিনির্ধারণ যখন সমুদ্র অর্থনীতি, নৌ-বাণিজ্য ও বন্দরের দিকে নিবদ্ধ, তখন সরকারের উচিত সমুদ্র বিষয়ে সর্বোচ্চ অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া। এই বিশেষায়িত অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোই ‘বøু ইকোনমি’কে সফল করার সবচেয়ে স্পষ্ট ও কার্যকর পথ।

সমাধানের পথ : ‘ল্যান্ডলর্ড মডেল’ কেন অপরিহার্য

বিশ্বের সফল বন্দরগুলো অনুসরণ করে বাংলাদেশের জন্য এখন ‘ল্যান্ডলর্ড মডেল’ (ভূমির মালিক মডেল)-এ রূপান্তর সুফলদায়ক হতে পারে। এই মডেলটি বিশেষভাবে বাংলাদেশের জন্য কার্যকর, কারণ এটি জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে বেসরকারি দক্ষতা ও প্রযুক্তি নিশ্চিত করে।

জাতীয় নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগের ভারমুক্তি : ভূমির মালিক মডেলে বন্দরের জমি, প্রধান পরিকাঠামো এবং চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে সরকার বা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) হাতে সংরক্ষিত থাকে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক পরিচালনাকারীরা (যেমন- ডিপি ওয়ার্ল্ড, পিএসএ) টার্মিনালগুলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে নিয়ে পরিচালনা করে এবং নিজস্ব তহবিল থেকে আধুনিক ক্রেন, তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল সিস্টেমে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে।

দুর্নীতির মূলোৎপাটন ও রাজস্বের নিশ্চয়তা : আন্তর্জাতিক পরিচালনাকারীদের ডিজিটাল ব্যবস্থা আসার ফলে কাস্টমস বা শ্রমিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ‘সমঝোতা’র সুযোগ থাকে না, কারণ এই সিস্টেমে মানুষের হস্তক্ষেপ প্রায় শূন্য। সরকার একদিকে ইজারা ফি পায়, অন্যদিকে পরিচালনাকারীর আয়ের একটি অংশ (রাজস্ব ভাগ) পায়। এতে সরকারি রাজস্বের একটি নিশ্চিত এবং স্থিতিশীল উৎস তৈরি হয়।

ট্রানজিট হাব হওয়ার সুযোগ : দক্ষতা বাড়লে বন্দর ২৪-৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য খালাস নিশ্চিত করতে পারবে। এতে নেপাল, ভুটান ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রামকে আঞ্চলিক ট্রানজিট কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হবে, যা বছরে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি আয় এনে দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক উদাহরণ : দক্ষতা ও রাজস্বে উল্লম্ফন

বন্দর পরিচালনায় ‘ল্যান্ডলর্ড মডেল’-এর সাফল্য এখন বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত। এই মডেলে ট্রানজিট নিলে বন্দরের দক্ষতা ও সরকারি রাজস্ব কিভাবে বহুগুণে বাড়ে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কার কলম্বো এবং ভারতের মুন্দ্রা বন্দর।

কলম্বো বন্দর (শ্রীলঙ্কা) : কলম্বো বন্দর ‘সার্ভিস পোর্ট’ মডেল থেকে ‘ল্যান্ডলর্ড মডেলে’ স্থানান্তরিত হয়। বেসরকারি বিনিয়োগে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্দরের সক্ষমতা ৪.৫ মিলিয়ন কুড়ি ফুট কনটেইনার একক (টিইইউএস) থেকে ১১.৭ মিলিয়ন কুড়ি ফুট কনটেইনার এককে উন্নীত করার লক্ষ্য নেয়া হয়। এই দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে, কলম্বো বন্দর কর্তৃপক্ষ ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা বৃদ্ধি রেকর্ড করেছে।

মুন্দ্রা বন্দর (ভারত) : মুন্দ্রা হলো প্রায় সম্পূর্ণ বেসরকারি মালিকানা ও পরিচালনায় পরিচালিত ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক বন্দর। এই বন্দর সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও অটোমেশনের মাধ্যমে ভারতে সর্বাধিক গতি ও দক্ষতা এনেছে। পরিচালনাকারী আদানির তথ্যানুযায়ী, এই দক্ষতা ও বহু-পণ্য পরিবহনের সক্ষমতার কারণে তাদের মোট পরিচালন রাজস্ব এবং মুনাফা প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে (যেমন- এক বছরে মুনাফা প্রায় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়)।

রূপান্তরের জন্য জরুরি সুপারিশমালা

জাতীয় নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে অচলাবস্থা কাটাতে কঠোর ও দ্রুত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। যেহেতু রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর এই জটিল প্রশাসনিক সংস্কার আরো পিছিয়ে যেতে পারে, তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সুযোগটি গ্রহণ করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারই এই মডেলের ভিত্তি স্থাপন করে রাজনৈতিক সরকারের হাতে তুলে দিতে পারে।

১. করপোরেটাইজেশন ও ডেপুটেশন বাতিল : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)সহ সব স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় আমলাদের ডেপুটেশন বন্ধ করতে হবে এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক দক্ষতা ও ব্যবসায়িক জ্ঞানসম্পন্ন পেশাদার সিইও নিয়োগ করতে হবে।

২. ‘ল্যান্ডলর্ড মডেল’ দ্রুত বাস্তবায়ন : বিলম্ব না করে বে-টার্মিনাল বা পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের মতো একটি অংশকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ‘ল্যান্ডলর্ড মডেলে’ আন্তর্জাতিক পরিচালনাকারীর হাতে তুলে দিতে হবে।

৩. প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ : চুক্তির শর্তে পরিচালনাকারীকে অবশ্যই ‘একক জানালা ডিজিটাল ব্যবস্থা’ চালুর জন্য বাধ্য করতে হবে, যা মানুষের হস্তক্ষেপ শূন্য করে দেবে।

৪. কঠোর জবাবদিহি (কর্মদক্ষতা সূচকের মাধ্যমে) : চুক্তির শর্তাবলি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও প্রকাশ্য রাখতে হবে এবং একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করে বন্দরের কর্মক্ষমতা এবং আর্থিক হিসাবের নিয়মিত নিরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সুনির্দিষ্ট মূল কর্মক্ষমতা সূচক (কেপিআই) প্রতিষ্ঠা করা জরুরি :

গতি ও দক্ষতা নিশ্চিতকরণ : জাহাজের অপেক্ষার সময় (বার্থের জন্য) আন্তর্জাতিক মান, যেমন শূন্য থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে সীমিত করা এবং ক্রেনের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় কনটেইনার ওঠানো-নামানোর হার (জিসিআর) অন্তত ২৫-৩৫ মুভ/ঘণ্টা নিশ্চিত করা।

ন্যূনতম রাজস্ব নিশ্চয়তা : পরিচালনাকারীকে অবশ্যই প্রতি বছর একটি ন্যূনতম কনটেইনার পরিবহন ক্ষমতা নিশ্চিত করার শর্তে আবদ্ধ করা।

শাস্তির বিধান : কর্মদক্ষতা সূচক অর্জিত না হলে পরিচালনাকারীর ওপর ভারী জরিমানা আরোপ করা এবং বারবার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে টার্মিনালের ইজারা বাতিল করার সুস্পষ্ট বিধান চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা।

শ্রীলঙ্কার কলম্বো এবং ভারতের মুন্দ্রা বন্দরের উদাহরণ প্রমাণ করে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে এবং প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক দক্ষতা নিশ্চিত করলে চট্টগ্রাম বন্দরও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি