বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত করিডোর, ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল- সবমিলিয়ে ঢাকার কূটনৈতিক চালচিত্র যেন দাবার বোর্ড। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় ক্রেতা, ভারত স্থলপথ বাণিজ্যের মূল সঙ্গী, আর চীন প্রধান অবকাঠামো বিনিয়োগকারী। একদিকে ভারতের ভূগোলগত নৈকট্য ও ঐতিহাসিক প্রভাব, অন্য দিকে চীনের অর্থনৈতিক শক্তি ও অবকাঠামোগত পরিকল্পনা, আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকেন্দ্রিক চাপ। এতে বাংলাদেশ এক জটিল ভারসাম্যের সন্ধান করছে।
টানাপড়েনের প্রধান ক্ষেত্র
এই অঞ্চলে তিন বড় শক্তির নানা ধরনের স্বার্থ ও পরিকল্পনা রয়েছে। এসব পরিকল্পনা সবসময় সঙ্ঘাতবিহীন সমান্তরাল পথ রেখায় চলে না। যখনই এই স্বার্থ সঙ্ঘাত দেখা দেয় তখনই নানা ধরনের চাপ সৃষ্টির বিষয় সামনে চলে আসে। বাংলাদেশে একাধিক ইস্যুতে বাইরের শক্তিগুলোর স্বার্থের বিপরীতমুখী ধারা রয়েছে। এসব বিষয়ে একপক্ষকে ছাড় দিতে গেলে অন্যপক্ষ থেকে চাপ এসে হাজির হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাপের ইস্যুর মধ্যে রয়েছে-
১. বন্দর ও করিডোর : চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা- প্রতিটি বন্দর ঘিরেই চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে। ফলে এখানে তাদের স্বার্থ আদায়ে প্রভাবশালী পক্ষগুলো সক্রিয় থাকে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান এবং বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির নানা প্রকল্প এ কারণে বেশ সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে।
২. অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা : বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর বড় অংশের অস্ত্র চীন থেকে আসে। প্রতিরক্ষার এই চীন নির্ভরতার বিষয়ে ভারতের রয়েছে তীব্র উদ্বেগ। দিল্লি মনে করে বাংলাদেশে চীনা প্রভাবের বড় অংশজুড়ে রয়েছে এই প্রতিরক্ষা নির্ভরতা। এ কারণে ভারত হাসিনা শাসনের দেড় দশকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার বিভিন্ন শাখায় সমরাস্ত্র সরবরাহের চেষ্টা করেছে। প্রতিরক্ষা ডকট্রিনে বৈরী শক্তি থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ না করার স্বাভাবিক একটি নিয়ম থাকায় এই উদ্যোগ পুরোটা সফল হয়নি। অন্য দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি আমেরিকান ব্যয়বহুল সমরাস্ত্র কেনার মতো এত বড় না হলেও ওয়াশিংটন কিছু কৌশলগত সাশ্রয়ী সমরাস্ত্র সরবরাহ করতে আগ্রহী। কিন্তু এ জন্য প্রাথমিক যে চুক্তি (আকসা, জিসুমিয়া) সম্পাদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা সম্পাদনে বাধা তৈরি করতে চায় ভারত প্রবলভাবে এবং চীন নেপথ্য থেকে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ সম্পর্কের মূলনীতি (দিল্লির চোখে দেখা) পাল্টাতে বাধ্য করে।
৩. রাজনৈতিক প্রভাব : নির্বাচনকালে দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গণতন্ত্র চর্চা ও মানবাধিকার নিয়ে চাপ দেয়। ভারত তার সর্বব্যাপী প্রভাব বজায় রাখতে চায় যাতে অন্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সিদ্ধান্ত প্রণয়নে প্রক্রিয়ায় অংশীদারত্ব না পেতে পারে। দিল্লির এই বাংলাদেশ নীতি অন্য শক্তিগুলো থেকে হাসিনাকে একবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ভারতের শাসক দল বিজেপি ও এর আদর্শগত পৃষ্ঠপোষক আরএসএস অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠায় আধিপত্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্র বিবেচনা করে বাংলাদেশকে। এটি করতে গিয়ে ভারত কিছুটা হয়তো ভুল করে যে বাংলাদেশকে ভারতের চশমা দিয়ে দেখার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের শর্তহীন ছিল না। এর ফলে সৃষ্ট অবিশ্বাসে বাংলাদেশকে ওয়াশিংটন সরাসরি এখন ডিল করছে বলে প্রতীয়মান হয়। আর এতে ভারতের নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য চীন স্থিতি প্রত্যাশা করে।
ভারতের ভূঅবস্থান ও নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশ চারদিক থেকে ভারতের সীমান্তে ঘেরা। ফলে নয়াদিল্লির কাছে ঢাকার প্রতিটি নীতি হয়ে ওঠে নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট। ভারতের প্রধান আগ্রহ হলো- বাংলাদেশ যেন চীন বা আমেরিকার সামরিক অবস্থান বা কৌশলগত করিডোরে পরিণত না হয়। ভারতের বর্তমান শাসকদের ডকট্রিন হলো ভারতের স্বার্থকে নিরাপদ রাখতে হলে বাংলাদেশের সবকিছুকে নিয়ন্ত্রক প্রভাবের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এ কারণে ভারতের একজন সেনাপ্রধান অবসর গ্রহণের পরে মন্তব্য করেছিলেন ঢাকাকে কোনোভাবেই আর দিল্লির রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না। এই দেড় দশকে এই রাডার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পিলখানা ম্যাসাকার, গুম, অপহরণ আর সবশেষে আন্দোলন দমাতে গণহত্যা পর্যন্ত সবকিছু করা হয়েছে। একই সাথে বিদ্যুৎ, রেল ও গ্যাস-পাইপলাইনসহ বহু প্রকল্পে ভারতের প্রভাব বিস্তৃত করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সমঝোতার নামে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর ক্ষমতা ও কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছে।
ভারত তার এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথে চীনের অবকাঠামো বিনিয়োগকে একটি বড় বাধা মনে করেছে। এ কারণে চীনের বন্দর থেকে শুরু করে ব্যারাজ পর্যন্ত বেইজিংয়ের কৌশলগত সব বিনিয়োগে বাধা দেয়া হয়েছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্পে ভারতের অস্বস্তি স্পষ্ট করার একপর্যায়ে বেইজিংয়ের পক্ষে তাদের বিনিয়োগ নিয়ে অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতের অর্থনৈতিক প্রভাব ক্রমেই সর্বগ্রাসীভাবে বিস্তৃত করা হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ, রেলসংযোগ, ট্রানজিট সুবিধা, এমনকি বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নয়াদিল্লির সক্রিয় উপস্থিতি তৈরি করা হয়। দেখা গেছে বাংলাদেশের বিগত শাসকশক্তি যখনই চাপে পড়েছে, ভারতের কূটনৈতিক সমর্থন তাকে টিকিয়ে রেখেছে, আর এটিকে ভারতের প্রভাবকে আরো শক্তভাবে বেঁধে নিতে প্রধান হাতিয়ার বানানো হয়েছে।
চীনের অর্থনৈতিক পদচিহ্ন
চীন বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। কর্ণফুলী টানেল থেকে শুরু করে পদ্মা সেতুর সরঞ্জাম, বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে মেট্রোরেল- সবখানেই চীনের অর্থ ও প্রযুক্তি জড়িত। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মাধ্যমে বেইজিং বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবেশদ্বার নিশ্চিত করতে চায়। এভাবে তারা ভারতের একচেটিয়া প্রভাবকে ভেঙে নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে উদ্যোগী হয়।
চীন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে উন্নয়ন সহায়তার মোড়কে। বেইজিংয়ের এ বিনিয়োগ শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগতও। কারণ চীন জানে, বাংলাদেশে শক্তিশালী উপস্থিতি মানে ভারতের একচেটিয়া প্রভাব ভাঙা। তবে চীনের সাথে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হয়। কারণ এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সন্দেহ তৈরি হয়। তারা পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার কথা বিবেচনা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নজর
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ শুধু একটি উদীয়মান অর্থনীতি নয়; বরং সমুদ্রপথের নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ওয়াশিংটন তাই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির আওতায় বাংলাদেশকে কাছে টানতে চায়। তবে তাদের প্রধান কূটনৈতিক হাতিয়ার হলো- গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানবাধিকার প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়গুলোকে শুধু নৈতিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখে না; বরং কৌশলগত স্বার্থের সাথেই যুক্ত করে।
বাংলাদেশ ওয়াশিংটনের চোখে সমুদ্রপথের নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বিন্দু। আর আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির মূল লক্ষ্য হলো, চীনের উত্থান নিয়ন্ত্রণ করা। এ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কৌশলগত স্বার্থ বার্মা আইনকে ঘিরে। বার্মাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমেরিকা চীনকে নজরে রাখার সুযোগ খুঁজে পেতে চায়। এর সাথে বার্মা অঞ্চলের বিপুল খনিজসম্পদে প্রবেশাধিকার সম্ভাবনা থাকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। এই গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস বার্মা প্রকল্পে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দ করেছে।
বাইরের দুনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের ভাষা দুই ধরনের দেখা যায়। একটি থাকে নমনীয় কূটনৈতিক ভাষা। অন্যটি হয় শক্তি প্রয়োগের কঠোর বার্তা। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ভাষাও অনেক সময় হয় ভিন্ন। তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসনকে সামনে আনে। নির্বাচনকালে চাপ সৃষ্টি, নিষেধাজ্ঞার হুমকি, কিংবা কূটনৈতিক বিবৃতি- এসব যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত টুলস। তাদের চোখে গণতন্ত্র কেবল নীতি নয়, বরং কৌশলগত হাতিয়ার।
সুযোগ না অভিশাপ?
বাংলাদেশের সামনে এখন এক দ্বৈত বাস্তবতা। এক দিকে এই টানাপড়েন হুমকি- কারণ একপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠতা অন্যপক্ষকে শত্রু করার আশঙ্কা। অন্য দিকে এটি একটি সুযোগ- কারণ প্রতিযোগিতার কারণে সবাই বাংলাদেশকে কাছে টানতে চায়, বিনিয়োগ বাড়ায়, সহযোগিতা প্রস্তাব করে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি এই প্রতিযোগিতাকে সুযোগে রূপান্তর করতে পারবে? নাকি বড় শক্তিগুলোর খেলায় ঘুঁটি হয়ে পড়বে?
বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট দেশ হলেও তার অবস্থান একেবারে কৌশলগত কেন্দ্রে। এক দিকে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের সামুদ্রিক করিডোর, অন্য দিকে ভারত ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আর ওপাশে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল- সবমিলিয়ে বাংলাদেশ আজ বৈশ্বিক ভূরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই অবস্থান কি বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ, নাকি অভিশাপ?
কেন এটি সুযোগ : কৌশলগত গুরুত্বের কারণে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র- তিন পক্ষই বাংলাদেশকে কাছে টানতে চায়। এর মানে ঢাকা প্রতিটি ক্ষেত্রে দরকষাকষির সুযোগ পায়। এরপর রয়েছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুযোগ। চীনের অবকাঠামো বিনিয়োগ, ভারতের আঞ্চলিক সংযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি বাজার- সবমিলিয়ে বাংলাদেশ বহুমুখী অর্থনৈতিক সুবিধা নিতে পারে। বহুপক্ষীয় খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনারও একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। ভূরাজনৈতিক অবস্থান কাজে লাগালে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পুরো এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও প্রভাবশালী মধ্যম শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারে। কূটনৈতিক ভারসাম্য এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিন পরাশক্তির প্রতিযোগিতা বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে নিজেদের শর্ত চাপিয়ে দেয়ার জায়গা তৈরি করে, যদি ঢাকা বুদ্ধিমত্তার সাথে খেলতে পারে।
কেন এটি অভিশাপ : অতিরিক্ত নির্ভরতা ঢাকার জন্য একটি নেতিবাচক দিক। একপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠ হলে অন্যপক্ষ ক্ষুব্ধ হয়। ফলে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়ে। অন্য শক্তিগুলোর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ প্রবণতাও অনেক সময় বিপদ ডেকে আনে। ভারত নির্বাচনে পক্ষপাত করে, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের নামে চাপ দেয়, চীন স্থিতিশীলতা রক্ষায় তাদের স্বার্থের কথা জানান দিয়ে নীরব সমর্থন দেয়- সবমিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিদেশী খেলায় পরিণত হয়। ঋণফাঁদ ও সার্বভৌমত্ব সঙ্কট ঢাকার জন্য একটি উদ্বেগের কারণ। চীনা বিনিয়োগ অনেক সময় ঋণের বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্য দিকে ভারতীয় প্রকল্পগুলো ভূরাজনৈতিক শেকলে পরিণত হয়। নিরাপত্তা ঝুঁকি বিপদের অন্যতম শঙ্কা তৈরি করে। বঙ্গোপসাগর কেবল অর্থনীতির নয়, সামরিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও রণক্ষেত্র হয়ে উঠছে। এতে বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
সুযোগে রূপ দেয়ার শর্ত ও ভারসাম্যের কৌশল
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান তখনই আশীর্বাদ হবে যদি- স্বচ্ছ ও সাহসী ক‚টনীতি চালানো যায়, জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়, অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমাতে বৈচিত্র্য আনা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতায় সক্রিয় ভূমিকা নেয়া যায়।
বাংলাদেশের ভূরাজনীতি নিজে থেকে সুযোগ বা অভিশাপ কিছুই নয়। এটি একটি শক্তিশালী অবস্থান, যেটি আমরা কিভাবে ব্যবহার করি তার ওপরই নির্ভর করে। আমরা যদি স্বার্থসচেতন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ক‚টনীতি চালাই, তবে এটি হবে আশীর্বাদ। আর যদি আমরা বিদেশী খেলায় ঘুঁটি হয়ে পড়ি, তবে এ অবস্থানই অভিশাপে রূপ নেবে। অতএব, প্রশ্নটি আসলে ভাগ্যের নয়- প্রশ্নটি আমাদের প্রজ্ঞা ও সাহসের।
ঢাকার অবস্থান তাই জটিল। ভারতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা যায় না, চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া বড় উন্নয়ন সম্ভব নয়, আর যুক্তরাষ্ট্রকে অস্বীকার করলে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও কূটনৈতিক অবস্থান ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। ফলে বাংলাদেশকে বহুমুখী কূটনীতি বা ‘ব্যালান্সিং অ্যাক্ট’ চালাতে হচ্ছে। এই কারণে বাংলাদেশ বাধ্য হচ্ছে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে। এক দিকে ভারতকে বড়ভাবে বৈরী না করা, আর চীনের বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো, সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চাপ সামলানো- এটি যেন দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা এক দুঃসাহসিক যাত্রা। প্রশ্ন হলো- এই কৌশলে প্রজ্ঞাকে ঠিক কিভাবে বাস্তবতায় অনুবাদ বা রূপান্তর করা যাবে।
বাংলাদেশের সামনে এখন প্রধান এজেন্ডা তিনটি। একটি হলো ভৌগোলিক নিরাপত্তা রক্ষা করা। এ জন্য প্রতিরক্ষা কৌশল ও সামর্থ্যকে শক্তিশালী করতে হবে। ১৫ বছর প্রতিরক্ষা বাহিনীকে কৌশলগত অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে শক্তিশালী করা যায়নি প্রধানত ভারতের চাপে। এখন সময়ের প্রতিরক্ষা চাবিকাঠি হিসাবে পরিচিত ট্যাংকবহরকে আধুনিকায়ন, মধ্যমপাল্লার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ, অন্তত জে১০ থান্ডার্সের মতো চতুর্থ প্রজন্মের জঙ্গিবিমান সংগ্রহ, কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও শক্তিশালী ড্রোন বহর সংগ্রহের প্রতি জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অস্ত্রের উৎসের বিষয়ে চীনের পাশাপাশি তুরস্ক পাকিস্তান ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তরে জোর দিতে হবে।
দ্বিতীয়টি হলো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আরাকানে তাদের বসতি এলাকায় নিরাপদ অঞ্চল তৈরির কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক অংশীদারদের মধ্যে যাদের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে তাদের সহায়তা নিতে হবে। আমেরিকার বার্মা আইন ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের বাস্তবতা উপলব্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত বিরোধ ও সঙ্ঘাত এড়াতে হবে।
তৃতীয়ত, অভিন্ন নদীর ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের চীনা সহায়তা গ্রহণের বিষয়ে চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তায় তিন শক্তির সাথে সম্পর্ককে কৌশলগত ভারসাম্যতায় নিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতের সর্বগ্রাসী চাপ, চীনের অর্থনৈতিক উপস্থিতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রত্যাশার মাঝে ঢাকার প্রতিটি পদক্ষেপই ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে। যদি আমরা স্বচ্ছ, স্বার্থসচেতন এবং সাহসী কূটনীতি চালাতে পারি, তবে এই টানাপড়েন হবে আশীর্বাদ। কিন্তু যদি আমরা বিদেশী প্রভাবের দোলাচলে পড়ি, তবে তা হবে অভিশাপ।