পবিত্র আল-কুরআনে যে সব খোদাদ্রোহী জনগোষ্ঠীর উল্লেখ এবং তাদের করুণ পরিণতি কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ হয়েছে স্বৈরশাসক ফেরাউনের। যে সব জনগোষ্ঠীর অবাধ্যতার কথা সামষ্টিকভাবে উল্লেখ আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নবী নূহের জনগোষ্ঠী, আদ, ছামূদ ও লূত (আ:)- এর কওম এবং ছালেহ ও শোআয়ব (আ:)-এর কওম। এদের অবাধ্যতার ধরন ছিল এই, তাদের প্রতি প্রেরিত নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান, নবীর প্রতি বিদ্রোহ এবং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। পরিণতিতে এদেরকে বন্যা ও জলোচ্ছ¡াস, ভূমিকম্প, প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিবাত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিল।
ব্যক্তি হিসেবে যারা অবাধ্যতার আশ্রয় নিয়েছিল এবং আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল তাদের মধ্যে দু’জন শাসকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একজন নামরুদ, আরেকজন ফেরাউন।
তবে আল্লাহর দৃষ্টিতে যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে বড় অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত সে হচ্ছে ফেরাউন। তাই দেখা যায়, পবিত্র কুরআনে ফেরাউনের কথা ২৭টি ভিন্ন সূরায় মোট ৭৪ বার উল্লেখ করা হয়েছে। ভেবে দেখা দরকার, ফেরাউনের কী এমন অপরাধ ছিল যে কারণে কুরআনে তার কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে?
এর সঠিক উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের কাছে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় আর তা হলো, ফেরাউন শুধু আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং সে মানবতার বিরুদ্ধেও আপরাধ করেছিল।
ফেরাউনের পরিণতি কী হয়েছিল
পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে ফেরাউনের পরিণতি বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহর নবী মূসা (আ:) যখন তার কাছে বনী ইসরাঈলের লোকদের উপর অমানবিক আচরণ বন্ধ করতে এবং তাদের অন্যত্র গিয়ে বসতি স্থাপনের দাবি জানালেন ফেরাউন তা প্রত্যাখ্যান করে। শেষতক নবী মূসা যখন বনী ইসরাঈলের লোকদেরকে নিয়ে রাতের আঁধারে মিসর ছেড়ে যাওয়ার জন্য এক যোগে বেরিয়ে পড়েন তখন ফেরাউন তার বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তাদের ধরতে বের হয়। মূসা (আ:) আল্লাহর নির্দেশে লোহিত সাগরে নিজের লাঠি দিয়ে আঘাত করেন, আর সাথে সাথে সমুদ্র দ্বিখণ্ডিত হয়ে মাঝখানে রাস্তার সৃষ্টি হয়। এ রাস্তা দিয়ে তিনি সদলবলে ওপারে বেরিয়ে যান। কিন্তু ফেরাউন বাহিনীর সেখানেই সলিল সমাধি হয়।
পবিত্র কুরআনে ফেরাউনের যেসব ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য এবং মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের উল্লেখ রয়েছে তার হুবহু পুনরাবৃত্তি দেখা যায় ফেরাউনের শাসনামলের ৩,৩০০ বছর পর বাংলাদেশের ইতিহাসে আর এক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার অনুসৃত পলিসি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে। তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে এ দুই স্বৈরশাসকের মধ্যকার সাদৃশ্যগুলো খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
১। পবিত্র কুরআনে ফেরাউনকে স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। [আল কুরআন-২৮ঃ৪]
অনুরূপভাবে শেখ হাসিনাকেও দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, সাংবাদিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
২। আল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে ফেরাউন ‘তার দেশের জনসাধারণকে দু’টি পরস্পরবিরোধী শ্রেণীতে বিভক্ত করে রেখেছিল।’
শেখ হাসিনাও এ দেশের অধিবাসীদেরকে দু’টি ভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিল তথা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি।
৩। ফেরাউন একটি শ্রেণীকে সুবিধাভোগী করেছিল, আরেকটি শ্রেণীকে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।
শেখ হাসিনাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সব সুবিধার অধিকারী করেছিল এবং বিপক্ষের শক্তিকে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।
৪। ফেরাউন দেশের জনসাধারণের একটি শ্রেণীর উপর সকল প্রকার নির্যাতন, বিনা বিচারে হত্যা, বংশ বিস্তার রোধের পলিসি নিয়েছিল।
শেখ হাসিনাও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে গুম, হত্যা, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোসহ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে। এজন্য পুরো প্রশাসন যন্ত্র, বিচার বিভাগ, পুলিশ বাহিনী ও নিজের অনুগত রাজনৈতিক দলকে অবারিত অধিকার দিয়েছে।
৫। ফেরাউন নিজেকে দেশের জনগণের একমাত্র বিধাতা, ভাগ্যের নিয়ন্তা, তার নিয়ন্ত্রণাধীন সম্পদ ও উৎস থেকে নিজেদের জীবন নির্বাহের উপকরণ ভোগ করার বিনিময়ে তাদের আনুগত্য ও আনুকূল্য পাওয়ার একচ্ছত্র অধিকারী মনে করত।
শেখ হাসিনাও বিভিন্নভাবে মানুষকে এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করেছিল যে সেই এ দেশের সব সম্পদ ও উৎসের নিয়ন্তা। জনগণের উচিত একমাত্র তারই প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।
পরিণতির বিচারে উভয়ের তুলনা
আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্যণীয় যে, নীতি ও চরিত্রের দিক দিয়ে ফেরাউন ও হাসিনার মধ্যে যেমন সাদৃশ্য, তেমনই উভয়ের পরিণতির ধরনেও অনেক মিল রয়েছে।
পবিত্র কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি, ফেরাউন মূসা (আ:)-এর কথায় কর্ণপাত করেনি। তার লোকদের ওপর জুলুম বন্ধ করা এবং তাদের নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করেনি। বরং সেনাদল নিয়ে মূসার লোকদেরকে ধাওয়া করে, শেষতক তাদের সলিল সমাধি ঘটে।
আল কুরআনে বলা হয়েছে, ফেরাউন বাহিনীর কেউ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। আমরা যদি স্বৈরশাসক হাসিনার পরিণতির কিভাবে সূচনা হয়েছিল তা পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা উভয়ের পতনের মধ্যে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখতে পাই।
হাসিনার পতনের সূচনা হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে। শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্মের জন্য সব সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটা নির্ধারণের ঘোষণা দিলে সে ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গণরোষের সৃষ্টি হয়। কারণ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপাত ৫-১০% এর বেশি নয় অথচ তাদের জন্য এর দশগুণ চাকরির কোটা নির্ধারণ ছিল একটি জঘন্য অন্যায়। ২০১৯ সালে এক আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা কোটা প্রথা বাতিল ঘোষণা করলে সেবারের মত আন্দোলন থেমে যায়। কিন্তু তার মাথায় আবার কুবুদ্ধির উদয় ঘটে। বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে তাদেরকে দিয়ে কোর্টের নির্দেশ বলে বিলুপ্ত কোটা ব্যবস্থার পুনর্বহাল করা হয়। তখন দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা আবারো আন্দোলন শুরু করলে স্বৈরাচারী হাসিনা তার পেটুয়া বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও রাষ্টীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে এ গণরোষ দমন করার প্রয়াস পায়। শেষতক তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং শেখ হাসিনার পতন ঘটে। হাসিনাসহ তার হাজার হাজার নেতাকর্মী, অনুসারী ও পুলিশ বাহিনীর লোকেরা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
অতএব দেখা যায়, উভয় স্বৈরাচারীর পতনের সূচনা হয় একটি ন্যায়ানুগ দাবি দম্ভভরে প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে। তবে পার্থক্য এটুকু যে ফেরাউনের সেনাবাহিনীর সবারই সলিল সমাধি ঘটেছিল আর হাসিনার অনুসারীদের অনেকে দেশ থেকে পালিয়ে প্রাণে বাঁচে। এর কারণ কিন্তু এই নয় যে হাসিনার অপরাধ ফেরাউনের চাইতে কম ছিল। এর আসল কারণ এই যে, হাসিনা নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে আর রাসূলে করীম (সা:) আল্লাহর কাছে থেকে একটি প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন এই মর্মে যে তার উম্মতের লোকদেরকে যেন সামষ্টিকভাবে আযাব দিয়ে ধবংস করা না হয়। তাই আপাততঃ বেঁচে গেলেও পরকালে হাসিনাকে অপরাধের শাস্তি ঠিকই ভোগ করতে হবে।
হাসিনার স্বৈরশাসনের প্রত্যাবর্তন কী সম্ভব
এখন অনেকের মধ্যে এ গুঞ্জন শোনা যায় অথবা এ ভয় কাজ করতে দেখা যায় যে, হাসিনা যেহেতু প্রাণে বেঁচে গেছে এবং তার প্রভু ভারতের আশ্রয় আনুকূল্য লাভ করেছে এবং তার স্বৈরশাসন পরিচালনায় তার সহযোগীদের একটি বিরাট অংশও ভারতের আশ্রয় লাভে সমর্থ হয়েছে তাই তার হৃত ক্ষমতা ফিরে পেতে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা ও আনুকূল্য লাভ করবে। যেহেতু বিষয়টি ভবিষ্যতের সাথে সম্পৃক্ত তাই এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করা উচিত হবে না, কারণ ভবিষ্যতের কথা তো একমাত্র ভবিতব্যই জানেন। তবে আমরা আলকুর’আনের আলোকেই এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পেতে পারি। কুরআনে বিধৃত জাতিগুলোর ইতিহাস থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে আল্লাহর আযাব দ্বারা বিধ্বস্ত কোন গোষ্ঠী এবং পতিত শক্তির পক্ষে পুনরায় ফিরে আসা বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। আল কুরআনের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হচ্ছে : ‘যে জনপদকে আমি বিধ্বস্ত করে দিয়েছি তাদের জন্য প্রত্যাবর্তন নিষিদ্ধ’ [আল কুরআন]
অতএব দেখা যায়, উভয় স্বৈরাচারীর পতনের সূচনা হয় একটি ন্যায়ানুগ দাবিকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে। তবে পার্থক্য শুধু এটুকু যে ফেরাউনের সেনাবাহিনীর সকলেরই সলিল সমাধি ঘটেছিল আর হাসিনার অনুসারীদের অনেকে দেশ থেকে পালিয়ে প্রাণে বাঁচে।
বস্তুতঃ মানবেতিহাসেও এর কোন নজির পাওয়া যায় না যে, আল্লাহর আযাব দিয়ে ধ্বংস করা জনপদ অথবা শাসক গোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন ঘটেছে পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।
আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, হাসিনার পতন একমাত্র আল্লাহর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। কারণ দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ দশ বছরের অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্তে¡ও তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ হয়। শেষতক একদল নিরস্ত্র, নিরীহ ছাত্র তাদের একটি বৈধ অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামলে হাসিনার সশস্ত্র সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী এবং সন্ত্রাসী গুণ্ডা বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে এ আন্দোলন দমন করতে চাইলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমজনতা তথা আবাল বৃদ্ধ বণিতা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের সমর্থনে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। এভাবে কয়েক সহস্র নিষ্পাপ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করার পর শেষতক আল্লাহর ইচ্ছাতেই স্বৈরশাসকের পতন ঘটে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম