রাজনীতি একসময় ছিল রাজা-বাদশাহদের রাজ্য পরিচালনার সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষ এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। তারা বলতেন, ‘আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর’ নিয়ে লাভ কী? তার চেয়ে নিজের চরকায় তেল দেয়া ভালো। এখন সময় পাল্টেছে। মানুষের অনুভূতি আকাক্সক্ষা এবং অধিকার সচেতনতা ক্রমেই তীক্ষ্ণ ও শাণিত হয়েছে। এখন আদার ব্যাপারী জনগণই হয়ে উঠছে রাজনীতির চালিকাশক্তি। এখানেই অনেকের আপত্তি ও বিপত্তি।
রাজনীতি-সচেতনতা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের সতর্কতা অনেকেরই অপছন্দ। এর প্রতিফলন জুলাই ছাত্র গণবিপ্লবের পর প্রতিভাত হয়েছে দৃষ্টিকটুভাবে। জুলাইয়ের ছাত্র-গণবিপ্লব ছিল জনতার স্বীয় অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ। নিজেকে আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষায়। নিজের ক্ষমতার ব্যাপ্তির বিকাশকেন্দ্রিক। বিপ্লব-পরবর্তী অবস্থার সমীকরণ কিন্তু সুখকর হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ নেতারা এটি কতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছেন সেটাই জাতির সামনে প্রশ্ন হয়ে এসেছে। জাতির বিবেক বলে পরিচিত শিক্ষকসমাজ, সাংবাদিক, আমলাতন্ত্র- সর্বত্র একই অবস্থা। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সবাই বুভুক্ষুর মতো নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, জাতীয় স্বার্থ সেখানে লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে। একই চিত্র বৃহত্তর রাজনীতির মাঠেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। বিপ্লব-পূর্ববতী চেহারাগুলোর চরিত্রমাধুর্য হারিয়ে সেখানে অত্যন্ত অশালীনভাবে প্রকাশ পেয়েছে দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ। দেশের স্বার্থ, জনতার কল্যাণ, গণতন্ত্রের অমোঘ শিক্ষা সব ছাপিয়ে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখলের এক কদর্য দৃশ্য দেশবাসী দেখল অবাক বিস্ময়ে!
বিপ্লব-পরবর্তী জনগণের স্বপ্ন ছিল শান্তির সুবাতাসের। বারুদের গন্ধহীন পরিবেশের। শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ এক সমাজের। সিন্ডিকেটমুক্ত অর্থনীতির। মানবাধিকারের আলোয় ঝলমল জাতিরাষ্ট্রের। সুষ্ঠু সুন্দরভাবে গণতান্ত্রিক অভিধায় উত্তরণের। পরিবর্তে বাতাসে শোনা যাচ্ছে ফ্যাসিস্ট প্রতিধ্বনি; শহীদের স্বপ্ন মুছে ফেলার কদর্য চেষ্টা। জনকল্যাণের রাজনীতির নামে দিনের পর দিন রাজপথ দখল করে জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার চেষ্টা জাতি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছে, আর ভেবেছে, এদের হাতে গণতন্ত্র কতটুকু নিরাপদ? গণতন্ত্র এদের হাতে কতটুকু সংহত হবে, কতটুকু বিকশিত হবে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কতটুকু মূল্যায়ন হবে।
এ দেশের সহজ সরল শ্রমিক মুটে-মজুর কৃষক শান্তিতে বসবাস করতে চায়। চায় বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যের সিন্ডিকেট থাকবে না। চায় চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজের নিশ্চয়তা। তাদের অধিকারকে সম্মান করা হবে, অস্ত্রের ঝনঝনানিমুক্ত সুষ্ঠু সুন্দর নিরুপদ্রব শিক্ষার পরিবেশ দলমত নির্বিশেষে সেটি জাতির প্রত্যাশা ছিল। সেশনজটের যন্ত্রণামুক্ত স্বাভাবিক শিক্ষা এবং মেধার মূল্যায়ন ও সৃষ্টিধর্মী শিক্ষার চেতনায় ছাত্ররা সম্পৃক্ত হয়েছিল জুলাই বিপ্লবে। কিন্তু বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে পুরনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও কলহ, ক্ষমতার মোহ, দুর্নীতি, দখলবাজি ও চাঁদাবাজির বিস্তার জনগণকে আবারো ঈশানকোণের লাল মেঘের দুঃস্বপ্ন দেখাচ্ছে। কথায় কথায় দলীয় ও নিজ স্বার্থের জন্য সড়ক, মহাসড়ক দখল করে অসংখ্য লোকের দুর্ভোগ সৃষ্টি জনবান্ধব রাজনীতি নয়। গণতান্ত্রিক চেতনায় ও মূল্যবোধে মতপ্রকাশ একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। অন্যায় অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলার, মতপ্রকাশের অধিকার সবার। এই অধিকার ও তার প্রয়োগ সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইতিবাচক পথে চলতে সাহায্য করে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও শক্তির মূল ভিত্তি। কিন্তু যখন কোন বিশেষ গোষ্ঠী, ব্যক্তি বা দল নিজ প্রয়োজনে সড়ক অবরোধ করে, তখন দুর্ভোগ পোহাতে হয় বিশাল জনগোষ্ঠীকে; যা কোনোভাবেই জনবান্ধব নয়। সামনের দিনগুলোতে সাধারণ মানুষ জনবান্ধব ও ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা দেখতে চায়। আর এটিই জুলাই বিপ্লবের নিহিত শিক্ষা।
বিপ্লবের পর যখন নতুন দেশ নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ছিল সবার সম্মিলিত চেষ্টা, তখন এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় সৃষ্টি হলো বিভাজন। রাজনৈতিক শক্তিগুলো একে অন্যের মুখোমুখি অবস্থানে গিয়ে বিভাজনকে আরো গভীর করলো। জাতিকে বিভ্রান্ত করে তোলার এই চেষ্টা, শক্তি ও সময় ক্ষয়ের চিত্র সবাইকে ব্যথিত করেছে। রাতারাতি ১৮-২০ বছরের সমস্যার সমাধানের জন্য সবারই গন্তব্যে পরিণত হলো যমুনা। আরেক দিকে বলা হতে লাগল, সব কিছুর সমাধানের জন্য প্রয়োজন নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকার। এ জন্য সময়ের দাবি ছিল সরকারকে প্রয়োজনীয় সমর্থন ও পরামর্শ দেয়া। সচিবালয় আক্রান্ত হওয়া, সচিবালয়ের ভেতরে লাগাতার আন্দোলন, সামান্য অজুহাতে এবং পূর্ববর্তী সরকারের অন্যায় ও জুলুমের প্রতিকারে সময় না দিয়ে সরকার ও জনগণকে জিম্মি করা আর যাই হোক গণতন্ত্রের শিক্ষা নয়। এটি ‘জোর যার মুল্লুক তার’ বিশ্বাসের প্রতিফলন। ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী সবার এভাবে যমুনামুখী হওয়ার ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার কোনো বক্তব্য শোনা যায়নি। মনে হয়েছে, সবার নীরব প্রশ্রয়ে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। এর ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে অপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ, ক্ষীণ হয়ে আসছে রাষ্ট্র সংস্কারের গতি-প্রকৃতি ও ধারণা। অথচ বিপ্লবের সময় ও পরে দলমত নির্বিশেষে সবাই এ ব্যাপারে একমত ছিলেন। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সবারই একটি একক প্রত্যাশা ছিল দেশের রাজনীতি পরিশুদ্ধ হবে, পরিশীলিত হবে। দলগুলো দেশ ও মানুষের স্বার্থে কাজ করবে। নিবেদিত হবে একক জাতিসত্তার নির্মাণ ও বিকাশে। এর পরিবর্তে ক্ষমতার রাজনীতির চর্চা দেশ ও জাতিকে হতাশ করেছে। চাঁদাবাজি, জবরদখলসহ বিভিন্ন অসামাজিক অন্যায়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নীরবতা নেতৃত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
৫ আগস্টের বিপ্লব দেশের সামনে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে জনগণের প্রত্যাশার কাছে যাওয়ার, জনতার জন্য, জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করার। প্রয়োজন শুধু নেতাদের দূরদর্শিতা ও বাস্তবায়নের দৃঢ়তা।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]