দেশের চলমান পরিস্থিতি থেকে আঁচ করা তেমন কঠিন নয় যে, গোটা দেশে বিশেষ মহল থেকে একটা গোল বাধানোর অপচেষ্টা হচ্ছে, যাতে পতিতজন অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে পারে। তারা এমন আকাশ-কুসুম ভাবনায় বিমোহিত যে, সহসাই তাদের স্বর্ণের পালঙ্কে নিশি যাপনের আয়োজন সম্পন্ন হবে। তবে সে স্বপ্নের গুড়ে বালি পড়তে শুরু করেছে। কেননা জেন-জি’রা এই উপমহাদেশে যে ঝড় তুলেছে, তার উত্তাল হাওয়া ইতিহাসের পাতায় নতুন এক অধ্যায়ের সংযুক্তি ঘটাচ্ছে।
আজ অনেকেই ইতিহাস ভুলে যান বা ভুলে যেতে ভালোবাসেন। এর পরিণতি যে কতটা আত্মঘাতী তা হয়তো তাদের ধারণায় নেই। ইতিহাস আমাদের আত্মশুদ্ধির পথ দেখাতে পারে যদি আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই। ইতিহাস ভুলে গেলে অনেক স্বপ্ন সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তার ভূরি ভূরি প্রমাণ থাকার পরও অনেকেই ডিমেনশিয়াকে আমন্ত্রণ জানাতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেন না। অতীতের অভিজ্ঞতার দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, যে জাতি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়, প্রকৃত বন্ধু মিত্র এবং প্রতিপক্ষকে সুনির্দিষ্টভাবে পৃথক করতে পারে, তারাই সহজে সাফল্যের মিনারে পৌঁছতে পারে। যারা পারে না তাদের স্থান হয় কালের আঁস্তাকুড়ে। এসব তথ্য জানার পরও আমাদের অনেকেরই ইতিহাসের চত্বরে আনাগোনা লক্ষ করা যায় না। তারা মনে করেন, ইতিহাসচর্চা মানে অতীতমুখিতা, যা খুব একটা কাজে আসে না। তাদের ধারণা, অতীত ঘাঁটলে শান্তি-স্বস্তি বিঘিœত হয়, একই সাথে অকারণ সময়ক্ষেপণ হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইতিহাস থেকে মুখ ফেরালে শান্তি নয়; বরং শাস্তি পেতে হয়। এমন জবাবকে অনেকেই নেতিবাচক বলে ধরে নিতে পারে। হয়তো ঝামেলা এড়াতে অতীতের অনেক কথাই কেউ কেউ ভুলে যেতে ভালোবাসে। সে কারণে এ জনপদ বারবার ভুলপথে হাঁটতে গিয়ে নিয়ত হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে। সুহৃদ-স্বজনদের চিনতে না পেরে, অমিত্রকে মিত্র ভেবে কাছে টেনে নিয়ে প্রতিদিন প্রতারিত হতে হয়। জের হিসাবে বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং জাতির ভোগান্তির মাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে। একই সাথে ইতিহাস বিকৃতির কাহিনীও চলমান।
সমাজে স্বার্থান্বেষীদের পক্ষ থেকে অনেকসময় খলনায়ককে নায়কোচিত করে তোলার অন্তহীন প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। একই মহল জাতির ক্রান্তিকালের নায়কদের খলনায়ক এবং কখনো কখনো বহিঃশক্তির ‘চর’ হিসেবেও অভিহিত করে। তাদের অবদানকে ধুলায় মলিন করে দিতেই এমন অসত্য বয়ান সামনে আনা হয়। অথচ দেশের বোদ্ধাসমাজের কেউ এখনো ভাবেন না। ইতিহাসের সত্য-মিথ্যাকে পৃথকভাবে গ্রন্থিত করে সব অসত্যকে তুলে ধরা হয়। এমন ঘটনা জাতি বোঝে না তা নয়; কিন্তু এসব অবাধে, বিনা প্রতিবাদে চলতে দেয়া হলে ভ্রান্তিমুক্ত, স্বচ্ছ, সুন্দরের অভীষ্ট পথ আবিষ্কারের কোনো সুযোগ আর থাকবে না। তখন হালভাঙা তরীর মতো শুধু মাঝ দরিয়ায় বৃত্তাকারে ঘুরতে হবে। শতবার অনুশোচনা করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না। স্বাধীনতার সত্যিকার ইতিহাসের পরিবর্তে সত্য-মিথ্যা আশ্রয়ে বানানো ন্যারেটিভ সত্য হিসেবে জনগণের সামনে প্রতিভাত হবে। একবার সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেলে মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা মোটেও সহজ হবে না।
স্মৃতিপটে অস্বচ্ছ হতে থাকা কিছু গুচ্ছচিত্র এখানে তুলে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে। ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট পদোন্নতি পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী শহীদ জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পেলেন, তখন ঐতিহাসিক এক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পেয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে ইউনিটে তিনি সংযুক্ত হন, বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম সুযোগেই তিনি সেই ইউনিটের কাছে তার একটি পিস্তল হস্তান্তর করেন। পিস্তলটির এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। ১৯৫৬ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে বীরত্বের এক পদক পেয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে জিয়াউর রহমান ভারতীয় এক সেনাকর্মকর্তাকে পরাস্ত করে তার কোমরে রক্ষিত পিস্তলটি কেড়ে নিয়েছিলেন। সেই পিস্তল এতকাল তারই ব্যক্তিগত সংরক্ষণে ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর, (লে. জে) জিয়া সেই পিস্তলটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের সংশ্লিষ্ট ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করেন।
এটা নিছক একটি পিস্তল হস্তান্তর নয়, এর মধ্যে বাস্তব ও কঠিন এক বার্তা ছিল। সেই অসমসাহসী যোদ্ধা সময়ের এক অনিবার্য প্রয়োজনে রাজনীতিতে এসেছিলেন। কোটি মানুষের ভাগ্যবদলের এক কঠিন কাজ হাতে নিয়ে চারণের মতো দেশের বনবাদাড়ে ঘুরতে শুরু করেন। জনমনে অভূতপূর্ব এক জাগরণ তৈরি করতে সক্ষম হন। দেশের পথে-প্রান্তরে দিবা-নিশি কোটি কোটি জনতার হাতে হাত রেখে সবার ভাগ্যবদলের এক নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন জিয়া। তিনি সমন্বয়, সহযোগিতা এবং ইনক্লুসিভ এক রাজনীতির দ্বার উন্মুক্ত করেন।
রাজনীতির বাগানে শত ফুলের সমাহার ঘটান জিয়াউর রহমান। অর্থাৎ রাজনীতির অঙ্গনে বহু মত-পথের বিকশিত হওয়ার পথ খুলে দিয়েছিলেন। খুব দ্রুতই তিনি জনগণের হৃদয়ের জলাশয়ের ‘কমল’ হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিলেন।
প্রশ্ন হতে পারে, আজ কি তার দল, জিয়ার সেই সমন্বয়ের নীতি ও চেতনা লালন করে?
কিন্তু এ জনপদের ‘কমল’ হয়ে ফুটলেও, যারা ছদ্মবেশে বন্ধুর বেশে এ বদ্বীপে অতীতে অনুপ্রবেশ কৌশলে ছিল, তারা ভেবেছিল এই কমলকে প্রস্ফুটিত হতে দিলে, তাদের আর কখনো বর্গি হয়ে এখানে প্রবেশাধিকার থাকবে না। এই ভূখণ্ডকে তাঁবে রাখার তাদের যে স্বপ্ন, তা কখনোই পূরণ হবে না। তাই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল এই কমলকে বৃন্তচ্যুত করতে আর দেরি করা যাবে না। তবে এই লক্ষ্য পূরণের জন্য তাদের পক্ষে স্বরূপে সশরীরে অনুপ্রবেশ করা ঠিক হবে না। তাদের যত চর-অনুচরের বীজ বপন করা ছিল তারাই তো এখন বাড়বাড়ন্তিতে যথেষ্ট উপযুক্ত। শুধু পথনকশা পাল্টালেই কেল্লা ফতেহ হবে।
‘বন্ধু’ দেশের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষিত ‘রক্ষীবাহিনী’ যখন বিলুপ্ত হয়, তখন সেই বাহিনীর অনেক সদস্যকেই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়েছিল। তাদেরই অন্যতম একজনসহ কিছু বিপথগামী সেনাকর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার মিশনে যুক্ত ছিলেন। দেশের এমন জঘন্য হত্যা মিশনের সদস্যরা মিশন শেষে নির্বিঘেœ পালিয়ে গিয়ে সদলবলে ভারতে নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে যায়।
বাংলাদেশের বেশুমার সম্পদ লুটেপুটে লক্ষ প্রাণকে নিঃশেষ করে, শেখ হাসিনা পালিয়ে দিল্লিতে বসে রসগোল্লা ও রসমালাই খাচ্ছে। তবে বোদ্ধাদের অনেকের এমন বদ্ধমূল ধারণা- দিল্লির গোল্লা খেয়ে তাকে অচিরেই পস্তাতে হবে এবং গভীর মনস্তাপে ধীরে ধীরে নীরবে নিভৃতে তিনি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবেন।
এমন সব দেশদ্রোহীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে দিল্লি এ দেশের মানুষের এক চিরস্থায়ী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে। হতেও পারে এই উপমহাদেশে ভারত হয়তো অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়তে পারে, গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে। তাদের যে গৃহদাহ ও গৃহবিবাদ সেটি তারই একটা পূর্ব লক্ষণ বা পূর্বাভাস। তবে এ নিয়ে এ সমাজের কারো কোনো ভূমিকার প্রয়োজন পড়বে না।
শহীদ জিয়াকে নিয়ে যে মূল্যায়ন, তা কোনোক্রমেই কোনো বন্দনা নয়। এটি নিছক ব্যক্তি জিয়ার কাজের একটা স্বীকৃতি প্রদান। ইতিহাসকে সঠিক ধারায় ফেরানোর একটা প্রয়াস। এর মধ্যে অনেক সুনির্দিষ্ট বার্তা আছে জিয়ার উত্তরসূরিদের জন্য। প্রয়োজন তাদের নিজের ভূমিকার মূল্যায়ন এবং নিজের ভবিষ্যতের পথকে যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করা। আসলে দেশের আরো মেন্টর দরকার। মেন্টরের ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনার সে পদগুলো এখন শূন্য। মেন্টরদের শূন্যপদ পূরণ করতে হলে, দেশের সবাইকে অভিন্ন প্রতিপক্ষ সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। অসতর্কভাবে বিবাদ-বিসম্বাদে জড়ালে তা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, শহীদ জিয়ার জীবনাবসান তারই এক করুণ নমুনা।
সবাই জানেন, ইতিহাস এমন এক আরশি, যেখানে কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠী বা জাতির ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার ক্রমবিকাশের ও ক্রমহ্রাসের ধারা স্বচ্ছভাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এখানে কারো ধরাছোঁয়ার কোনো অবকাশ থাকে না। ব্যক্তি বা জাতির ত্রুটি-বিচ্যুতি বা সাফল্য সবই স্বচ্ছ আলোকে আবিষ্কার করা যায়। প্রতিবিধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। অথচ সেই সুযোগ এখন বারবার হারিয়ে ফেলা হচ্ছে। কেননা এই জনপদের মানুষকে তার সরলতার সুযোগে পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আত্মবিলুপ্তির হাজারো শেখানো বয়ান বাতাসে অনুরণিত হচ্ছে। সবার মন-মগজে সেসব বয়ান গেঁথে দেয়ার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। তবে আশার কথা জেন-জি’রা জেগে উঠেছে। ইতিহাসের সঠিক ধারা আত্মস্থ করতে সোচ্চার ধ্বনি তুলছে। সেই ধ্বনি এখন সবার কর্ণকুহরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আশা জাগছে, অদূর ভবিষ্যতে দিগন্তে প্রজ্ব¡ল নতুন দিনের সম্ভাবনার দ্বার ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হবে। আড়মোড়া ভেঙে সবাইকে সমস্বরে সেই নতুন দিনের গানে সুর মেলাতে হবে।