আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অনেকের কিছু উক্তি আছে, যা শুধু সংবাদ শিরোনাম নয়, জেনারেশন থেকে জেনারেশনে রসাত্মক গল্পের মতো মনে রাখার মতো। আজকের নিবন্ধের শিরোনাম ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ তেমনি এক ঘটনা থেকে এসেছে। আগে চলুন কিছু প্রেক্ষাপট দেখি।
২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিখোঁজের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, ‘কোনো গুম হচ্ছে না, প্রেমে ও ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে নানান জন নানান দিকে চলে যাচ্ছে, আমরা তাদের এনে হাজির করছি।’ ২০১৩ সালের রানাপ্লাজা ধসের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের বিশ্লেষণ, ‘হরতালকারী ও মৌলবাদীরা এই ভবনের স্তম্ভ ধরে টানাটানি করায়’ ভবনটি ধসে পড়ে থাকতে পারে।’ ২০১২ সালে আইনশৃঙ্খলার অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে সাহারা খাতুনের পরামর্শ, ‘ঈদে বাড়ি গেলে ঘরে তালা লাগিয়ে যাবেন।’ এমনকি বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানও আলোচিত হয়েছিলেন মানুষের ‘কম খাওয়ার’ পরামর্শ দেয়ার জন্য। এক সময় চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কেউ বলেছিলেন ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান’। কে বলেছিলেন ঠিক মনে নেই। এসব কথা শুনে মনে পড়ে যায় গ্রামের সোজাসাপ্টা কথাবার্তার দৃশ্য, যেমন- কোনো মৃত্যুতে গ্রামের হুজুর সান্ত¡না দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তারে লইয়া গেছে, কাইন্দ না।’ অথবা চল্লিশার ভোজে কাকা বলেন, ‘কম খা, লোক অনেক আসছে’। বক্তারা ভিন্ন হলেও রসিকতার স্বাদ একই।
আরেকটু পেছনে গেলে, ২০০২ সালের ৯ মে, বাড্ডায় বাবার কোলে থাকা ২০ মাসের শিশু নওশিন ছিনতাইকারীর গুলিতে নিহত হলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ হোসেন চৌধুরী শোকার্ত পরিবারের কাছে গিয়ে বলেন, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’। সান্ত¡নার উদ্দেশ্যে বলা হলেও, ওই ঘটনায় এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে।
কিন্তু আমার শিরোনাম ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ এসেছে ২০০৪ সালে দেশে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে উৎকণ্ঠার মুহূর্তে এক সাংবাদিক তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরকে প্রশ্ন করলেন, ‘শত্রু কি শনাক্ত হয়েছে?’
বাবরের উত্তর, ‘না, উই আর লুকিং ফর শত্রুজ!’ তার এ মন্তব্য খানিকটা হাস্যরসের সৃষ্টি করে। পরে আলোচনা চলাকালে তিনি বলেন, ‘ওই কাজের সাথে জড়িতরা দেশের শত্রু।’ তৎকালীন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে আমি সেদিন দেশের আইনশৃঙ্খলা খাতের একটি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করি। তাতে প্রতিটি থানার ওসি বদলির বিষয়টি এনএসআইয়ের তত্ত¡াবধানে সফটওয়্যার সিস্টেমের মাধ্যমে করার প্রস্তাব দিই, যাতে বদলি-বাণিজ্য বন্ধ হয় এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বদলির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সভার অভিজ্ঞতা : দেশের অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মিটিংয়ে আমি পরিচালক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে প্রতিমন্ত্রী বাবর আমার দিকে কিছুটা দোষারোপের সুরে ইঙ্গিত করলেন যে, আমরা দুর্বৃত্তদের গোলযোগের সঠিক আগাম গোয়েন্দা তথ্য দিতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রয়োজনীয় আগাম গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করাও আমার কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সানন্দে দোষটা নিয়ে আমি মন্ত্রীর কাছে আমার জানা একটি বাস্তব ঘটনা সবার সামনে উপস্থাপনের অনুমতি নিলাম।
গল্পটি নিম্নরূপ : ২০০১ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় রমনা থানার এক ওসিকে ওয়াকিটকিতে ডেকে মিন্টো রোডে আসতে বলা হয়। ওসি জানান, তিনি জানেন না মিন্টো রোড কোথায়! হাস্যকর মনে হলেও, এর কারণ ছিল তৎকালীন সরকারের নেয়া এক অনন্য পদক্ষেপ, সমস্ত থানার ওসিদের বদলি করা, গ্রাম থেকে শহরে এবং শহর থেকে গ্রামে। ওই অফিসার সদ্য ময়মনসিংহ থেকে রমনা থানায় যোগ দিয়েছিলেন, সে সময়ে মাত্র ৫৮ টাকা যাতায়াত খরচ করে। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে এলাকার চোর-ডাকাতসহ সব অপরাধ দমন করেন।
এর বিপরীতে, ২০০৪-০৫ সালের দিকে একজন ওসিকে বদলির জন্য পাঁচ-ছয় লাখ টাকা খরচ করতে হতো। আমি সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করি, যে ওসি বদলির জন্য ছয় লাখ টাকা খরচ করেন, তিনি কি ৫৮ টাকা খরচ করা অফিসারের মতো সৎভাবে দায়িত্ব পালন করবেন? এই টাকার লেনদেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়া আর কোথায় সম্ভব? যদিও আমার টিম সরাসরি প্রমাণ পায়নি, তবু বদলি-বাণিজ্যের বাস্তবতা নিয়ে কারো সন্দেহ ছিল না। আমার গল্পের অন্তর্নিহিত বার্তাটি প্রতিমন্ত্রী বাবর সাথে সাথে বুঝতে পারেন এবং চুপ হয়ে যান। তখন পুলিশ অফিসাররা আমার ওপর বিরক্ত হয়ে বলেন, যেখানে বেশি টাকা লেনদেন হয়, সেসব বিভাগে আমার বেশি নজর দেয়া উচিত। পুলিশের সাথে বদলি-বাণিজ্য নিয়ে বাদানুবাদসহ আমার সেই দিনের বক্তব্য শীর্ষস্থানীয় এক জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তে প্রতিফলিত হয়েছিল। দুই দশক পরও সেই পর্যবেক্ষণ সত্য প্রমাণিত হচ্ছে, বরং প্রযুক্তি ও অপরাধচক্রের জটিলতার কারণে এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেড়েছে। (সূত্র ২০০৪ সালের ৩ এপ্রিল, দৈনিক প্রথম আলো)
প্রস্তাবের মূলকথা : আমার প্রস্তাব ছিল, থানার ওসিদের বদলি সম্পূর্ণ সফটওয়্যারভিত্তিক সিস্টেমে করা, যা এনএসআই বা অন্য কোনো নিরপেক্ষ সংস্থার তত্ত¡াবধানে থাকবে। এতে বদলি-বাণিজ্য বন্ধ হবে, রাজনৈতিক প্রভাব কমবে এবং পুলিশের কর্মদক্ষতা বাড়বে। পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতির মূল কারণ তিনটি- নিয়োগবাণিজ্য, বদলিবাণিজ্য ও রাজনৈতিক চাপ। পুলিশের ‘মাথা’ (মহাপরিদর্শক) এবং ‘লেজ’ (ওসি-ইন্সপেক্টর) পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ওসি থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বদলির দায়িত্ব পুলিশ ছাড়া অন্য নিরপেক্ষ সংস্থার হাতে দিতে হবে। সারা দেশের ৬৫২টি থানা মনিটরিংয়ের দায়িত্ব থাকবে সেই সংস্থার ওপর এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে সংশ্লিষ্ট ওসিকে তাৎক্ষণিক জবাবদিহির মুখোমুখি করা হবে।
২০ বছর পর : একই ভাবনা ফিরে আসা : ২০ বছর আগে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম দুঃখজনকভাবে, জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার দেয়ার প্রবণতায় সেই প্রস্তাব আমলে নেয়া হয়নি। আমাদের দেশে বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ শুধু রাজনীতিবিদ হয়ে থেকে যান, প্রকৃত নেতা হয়ে উঠতে পারেন না। যদি তখন থেকে জাতীয় স্বার্থে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে বদলিব্যবস্থা চালু হতো, তাহলে ‘নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্য’ হয়তো এতটা ভয়াবহ রূপ নিত না।
সম্প্রতি মাত্র এক সপ্তাহ আগে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘লটারি অনুযায়ী নির্বাচনের আগে বিশেষভাবে এসপি ও ওসিদের পোস্টিং দেয়া হবে।’ (সূত্র : ৬ আগস্ট ২০২৫, নয়া দিগন্ত) অর্থাৎ তারা এখন নির্বাচন-পূর্ব সময়ে লটারি সিস্টেমে বদলির কথা বলছেন। আমরা ২০ বছর আগে একই ধারণা দিয়েছিলাম, তবে শুধু নির্বাচন নয়; বরং সারা বছর নিয়মিত বদলির জন্য। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, এমন সফটওয়্যারভিত্তিক স্বচ্ছ বদলির সিস্টেম চালু হলে পুলিশের দুর্নীতি অন্তত ৩০ শতাংশ কমবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আনুপাতিকভাবে উন্নত হবে।
জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য দিলে এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখলে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হবেই। এখনো সময় আছে, এটিকে পুলিশ সংস্কারনীতির স্থায়ী অংশ করা হোক।
একটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা তখনই মজবুত হয় যখন ওই দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রু নিধন করা যায়। তাই সবার প্রথমে আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্রু, অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করে বাস্তবভিত্তিক যথাযথ ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও প্রো-ভিসি, বিইউপি



