দেশ আবারো এক বিপজ্জনক মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটি এমন একটি মোড়, যেখানে চালক সামান্য ভুল করলে বা অসতর্ক হলে আমাদের অর্জিত গণতন্ত্র ও জাতির ভবিষ্যৎ উভয়ই অতল খাদে পড়তে পারে। আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের পর যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল, আজ সেই রাষ্ট্রের রাজনীতি আবারো অনিশ্চয়তা, বিভাজন ও আত্মবিধ্বংসের গভীর খাদে নেমে যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে, রাজনীতিকরা ঐক্যের পথে নয়, বরং বিশৃঙ্খলা ও পারস্পরিক আক্রমণের পথে এগোচ্ছেন। এক দিকে দলগুলো একে অপরকে দোষারোপ করছে, গালাগাল ও কাদা ছোড়াছুড়িতে মেতে আছে, অন্য দিকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগ, বিভ্রান্তি ও হতাশা। কেউই ছাড় দিতে রাজি নয়, কেউই নিজেদের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চি সরতে চায় না। প্রতিটি দল মনে করছে তারাই সত্য, বাকিরা শত্রু। নির্বাচনের রূপরেখা, জুলাই চার্টার বা গণভোটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে কোনো ঐকমত্য হচ্ছে না। নেতারা ব্যস্ত নিজেদের প্রচার, মিথ্যা অভিযোগ আর সড়কে ক্ষমতা প্রদর্শনে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রমাণ করে, প্রতিবার যখন দলগুলো নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে বন্দী হয়েছে, তখনই রাষ্ট্রকে ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের আগের সময়টি ছিল সেই দৃষ্টান্তের সবচেয়ে তিক্ত উদাহরণ, যেখানে ক্ষমতার লড়াই, একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার মানসিকতা এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস পুরো জাতিকে এক অচলায়তনে পরিণত করেছিল। রাজনীতি তখন আর জনগণের সেবা ছিল না; তা হয়ে উঠেছিল প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতা। প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট, বিচারব্যবস্থা রাজনীতির হাতিয়ার, আর সাধারণ মানুষ হয়ে উঠেছিল নিছক দর্শক। ঠিক সেই দিকেই আমরা আবার হাঁটছি, হয়তো আরো দ্রুত গতিতে।
আজ রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান এতটাই শক্ত করে ফেলেছে যে, তারা জনগণের কণ্ঠস্বর শুনতেও রাজি নয়। ‘আমিই ঠিক, অন্যরা ভুল’- এই মানসিকতা তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়েছে। ফলাফল হলো, সংলাপের জায়গায় এসেছে সঙ্ঘাত, আলোচনা বদলে গেছে আগুন-ঝরানো বক্তৃতায়, আর গণতন্ত্রের আদর্শ ডুবে গেছে ব্যক্তিগত স্বার্থের কাদায়। যারা একসময় গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছে, তারাই এখন সেই গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হানছে মিথ্যা প্রচারণা, গুজব, সহিংসতা ও ভয় দেখানোর রাজনীতির মাধ্যমে। এই আত্মবিধ্বংসী রাজনীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার। যখন রাজনীতিকরা নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়ে, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, আর বিদেশী প্রভাবশালী শক্তিগুলো সেই দুর্বলতাকে সুযোগ হিসেবে নেয়। গণতন্ত্র তখন নামমাত্র থাকে, ভোট, সংসদ, দল সবই থাকে; কিন্তু তার ভেতরের প্রাণ চলে যায়। এটি সেই ‘নরম একনায়কতন্ত্র’, যেখানে স্বাধীনতার আড়ালে থাকে দাসত্ব, আর জনগণের নামে চলে ক্ষমতার ব্যবসায়।
যারা আজ গণতন্ত্র রক্ষার বুলি দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই জানেন, গণতন্ত্র মানে ক্ষমতার দখল নয়; বরং জনগণের কাছে জবাবদিহি। কিন্তু তারা সেটি ভুলে গেছেন। তারা বিশ্বাস করেন, তাদের ছাড়া দেশ চলবে না; তারা মনে করেন, তাদের ব্যর্থতাও দেশকে সহ্য করতে হবে। এই আত্মঅহঙ্কারই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রæ। যখন রাজনীতি জনগণের আস্থা হারায়, তখনই গণতন্ত্র ভেঙে পড়ে। কারণ গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের ব্যবস্থা নয়, এটি বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠান। আজ যদি এই প্রবণতা না থামে, তবে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে, অর্থনীতি থমকে যাবে, সমাজ বিভক্ত হবে এবং সেই শূন্যতায় প্রবেশ করবে এমন শক্তি, যারা কখনো জনগণের মঙ্গল চায় না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে বেশি সময় লাগবে না। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে, এখনই রাজনীতিকে দায়িত্বশীল হতে হবে- না হলে আবারো গণতন্ত্রের নামে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে কুটিল স্বার্থের কাছে।
এর মধ্যেই আবার মাথা তুলছে পরাজিত শক্তি আওয়ামী লীগের অপরাধচক্র ও তাদের বিদেশী প্রভুরা। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ও সহায়তায় তারা পরিকল্পনা করছে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করার, ভয় ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার। তাদের লক্ষ্য একটাই, যেভাবেই হোক, নির্বাচন বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত করে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে তারা আবারো ক্ষমতায় অনুপ্রবেশ করতে পারে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন তথাকথিত গণমাধ্যমের মাধ্যমে মিথ্যা গুজব, বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কিন্তু তারা ভুল করছে। এই দেশ এখন আগের বাংলাদেশ নয়। দেশপ্রেমিক মানুষ আজ অনেক বেশি সচেতন। তারা জানে, স্বাধীনতার পর থেকে যত সঙ্কট এসেছে, সব কিছুর মূলে ছিল ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ ও বিদেশী প্রভাব। এবার জনগণ সেই ভুল আর করবে না। ভারতের প্ররোচনায় বা কোনো কূটনৈতিক চাপের মুখে তারা নিজের ভবিষ্যৎ কাউকে বন্ধক দেবে না। এই দেশ একবার রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে- দ্বিতীয়বার আর পরাধীনতার শৃঙ্খল পরবে না। দেশপ্রেমিক শক্তি এবার যেভাবেই হোক, প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, যে শক্তিই দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা করবে, তারা জাতির ক্রোধের মুখে পড়বে।
যদি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের বিভেদ দূর করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। ওয়ান-ইলেভেনের শিক্ষা আমরা ভুলে যেতে পারি না, যখন রাজনীতি ব্যর্থ হয়, তখন অন্যরা এসে ‘উদ্ধারকর্তা’ সাজার সুযোগ নেয়। কিন্তু সেই উদ্ধারেই গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে যায়। তাই সরকার ও প্রশাসনের এখনই দায়িত্ব নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে দৃঢ়ভাবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করতে হবে, যাতে দেশের ভেতরে বা বাইরে থেকে কোনো শক্তি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। মিথ্যা প্রচারণা, বিভ্রান্তি ও মানসিক আতঙ্ক তৈরি- সব কিছু কঠোরভাবে দমন করতে হবে। যারা নির্বাচনের নামে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। রাষ্ট্র আর রাজনৈতিক ব্যর্থতা বা তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের নামে বিশৃঙ্খলা’ সহ্য করার অবস্থায় নেই।
এখন সময় এসেছে শক্ত অবস্থান নেয়ার। যারা বিদেশী প্ররোচনায় কাজ করছে, নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইছে, তাদের জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। গণতন্ত্র মানে বিশৃঙ্খলার স্বাধীনতা নয়; গণতন্ত্র মানে জবাবদিহি ও দায়িত্ববোধ। যদি রাজনৈতিক নেতারা এটি না বোঝেন, তবে তাদের নেতৃত্বের নৈতিক অধিকার নেই। এ দিকে, কিছু তথাকথিত আন্দোলনও চলছে যার উদ্দেশ্য কোনো বাস্তব সমস্যা সমাধান নয়; বরং মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়া। এসব আন্দোলন পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে যেন দেশবাসী মূল সমস্যাগুলো- দুর্নীতি, কর্মসংস্থান, ন্যায়বিচার ও শাসনব্যবস্থার সংস্কার ভুলে যায়। জনগণ আজ এসব নাটক আর বিশ্বাস করে না। তারা ফলাফল চায়, প্রতিশ্রুতি নয়। রাজনীতিকদের এই বাস্তবতা বুঝতে হবে।
জুলাই বিপ্লব হয়তো পুরো সফল হয়নি, কিন্তু তার চেতনা এখনো জীবিত। আজ দরকার সেই চেতনার পুনর্জাগরণ, সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, যেখানে ভোট, স্বাধীনতা ও মর্যাদা থাকবে বিদেশী নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
আগামী কয়েক সপ্তাহই ঠিক করে দেবে, বাংলাদেশ এগোবে, নাকি আবারো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখনই একত্র হতে হবে, শক্তি ভাগাভাগির জন্য নয়, বরং দেশ রক্ষার জন্য। একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়া, পারস্পরিক সংযম এবং বিদেশী প্রভাবমুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণেই জাতীয় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
যদি রাজনীতিকরা এখনো দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, তাহলে আবারো রাস্তাই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে এবং ইতিহাস তাদের নাম স্মরণ করবে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। দেশ আর কোনো রাজনৈতিক উন্মাদনা সহ্য করতে পারবে না। বাংলাদেশের জনগণ এখন এমন একটি সরকার চায়, যা তারা নিজের হাতে বেছে নেবে, কোনো বিদেশী শক্তি চাপিয়ে দেবে না। তারা এমন এক গণতন্ত্র চায়, যা ঐক্য ও মর্যাদার ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে, বিভেদ ও বিশৃঙ্খলার ওপর নয়। সময় শেষ হয়ে আসছে, এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।



