আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার পরিকল্পিত করিডোরটি সাধারণত জাঙ্গেজুর (Zangezur) করিডোর হিসেবে পরিচিত। ২০২০-পরবর্তী নাগরনো-কারাবাখ যুদ্ধের মূল উপাদান ছিল এই করিডোর। প্রস্তাবিত পরিবহন সংযোগের লক্ষ্য আর্মেনিয়ার দক্ষিণ সিউনিক প্রদেশ (ঐতিহাসিকভাবে জাঙ্গেজুর নামে পরিচিত) অতিক্রম করে মূল ভূখণ্ড আজারবাইজানকে সরাসরি নাখচিভানের ছিটমহলের সাথে যুক্ত করা। প্রাথমিকভাবে আজারবাইজান ও তুরস্ক প্রচারিত, করিডোরটি আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও রাশিয়ার মধ্যে ২০২০ সালের ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, যা আঞ্চলিক পরিবহন রুটগুলোকে ‘অবরোধমুক্ত করার’ আহ্বান জানিয়েছিল। তবে, পরিকল্পনাটি একটি অত্যন্ত বিতর্কিত ভূ-রাজনৈতিক প্রকল্পে পরিণত হয়। কারণ এতে সার্বভৌমত্ব হ্রাস, সীমান্ত পরিবর্তন এবং আঞ্চলিক ক্ষমতা পরিবর্তনের ঝুঁকি রয়েছে। চলতি ২০২৫ সালের ৭-১০ আগস্টে ওয়াশিংটনে স্বাক্ষরিত আর্মেনিয়া-আজারবাইজান চুক্তি ৩৫ বছরের দ্ব›েদ্বর অবসান ঘটিয়েছে বটে, কিন্তু জাঙ্গেজুর করিডোরের ৯৯ বছরের লিজ যুক্তরাষ্ট্রকে এটি পরিচালনার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে। করিডোরের ২৭ মাইল ইরান সীমান্তবর্তী। তাই ইরান শুরু থেকেই এই কৌশলের বিরোধিতা করে আসছে। করিডোরের শিকড় রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির মধ্যে, যা নাখচিভানকে আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ২০২০ সালের যুদ্ধে, আজারবাইজান নাগরনো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে, ভারসাম্য পরিবর্তন করে। বাকু সরাসরি সংযোগের জন্য চাপ দিতে সক্ষম হয়েছিল। সমর্থকরা এটিকে বৃহত্তর ইউরেশীয় সংযোগ উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেখেন। যেমন মিডল করিডোর, রাশিয়ার উত্তর করিডোর বা স্যুয়েজ খালের মাধ্যমে সামুদ্রিক রুটের একটি স্থলভিত্তিক বিকল্প। করিডোরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ৯৯ বছরের ইজারাসহ সাম্প্রতিক প্রস্তাবগুলো বিতর্ক তীব্রতর করেছে, দক্ষিণ ককেশাসে পশ্চিমা প্রভাবের হাতিয়ার হিসেবে অবস্থান নিয়েছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে করিডোরটি উল্লেখযোগ্য, বিশেষত বাণিজ্য ও জ¦ালানি প্রবাহের জন্য। বাণিজ্যিকভাবে এটি এশিয়া-ইউরোপের স্থল রুটকে ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত করবে এবং মধ্য এশিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে বাণিজ্যের আকার বাড়িয়ে তুলবে। এতে ইউরেশীয় বাণিজ্যে বার্ষিক ৫০-১০০ বিলিয়ন ডলার আয়ের পথ খুলে দেবে। এর পর আসে আঞ্চলিকতা।
আঞ্চলিক একীকরণ তুরস্কের জন্য জ্বালানি, পরিবহন এবং ডিজিটাল অবকাঠামোতে নতুন পথ ও সরবরাহ-সুযোগ সৃষ্টি করবে। তুর্কিভাষী মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্র কাজাখস্তান, উজবেকিস্তানের সাথে সম্পর্ক জোরদার হবে। আজারবাইজান নাখচিভানে বিরামহীন প্রবেশাধিকার থেকে উপকৃত হবে। ইরানি ট্রানজিট রুটের উপর নির্ভরতা হ্রাস করে এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের কেন্দ্র হিসেবে তার ভূমিকা বাড়বে। এরপর দেখতে হবে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব। আজারবাইজানপন্থীরা যুক্তি দেয়, এটি যোগাযোগ ‘অবরোধমুক্ত’ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে, বর্ধিত ট্রানজিট ফি এবং অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরতার মাধ্যমে আর্মেনিয়াসহ সব পক্ষকে উপকৃত করবে। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের ধারণা, এটি উন্নত আঞ্চলিক বাণিজ্যের মাধ্যমে ইরানকে ‘বাস্তব সুবিধা’ দেবে। তাই জাঙ্গেজুর করিডোরটি বৈচিত্র্যময় সরবরাহ চেইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পনাটি রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা প্রভাবের জন্য যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়েছে। সমালোচকরা বলছেন, লাভের চেয়ে অশান্তি এবং যুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারণ করবে।
আর্মেনিয়ান সার্বভৌমত্ব ও অন্যান্য হুমকি : করিডোরটি আর্মেনিয়ার সঙ্কীর্ণ দক্ষিণ বাহু সিউনিকের মধ্য দিয়ে গিয়েছে যা কার্যত বিভাজন বা নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলবে। আজারবাইজান দাবি করেছে করিডোরে কোনো আর্মেনীয় শুল্ক চেকপোস্ট থাকবে না। এমন শর্ত পুনর্মিলনের পরিবর্তে দ্ব›দ্ব বাড়িয়ে তুলবে। ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি : এই প্রকল্পে চারটি মূল দেশ আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ইরান ও রাশিয়া জড়িত। এসব দেশ দক্ষিণ ককেশাসকে অস্থিতিশীল করতে পারে। রুট সুরক্ষিত করার জন্য আমেরিকান বেসরকারি সামরিক ঠিকাদারের প্রস্তাবসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়াকে কেউ কেউ রাশিয়া ও চীনকে মোকাবেলা করে ইউরেশিয়ায় ন্যাটোর ‘গোপন অগ্রগতি’ হিসেবে দেখছেন।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সম্ভাব্যতা : করিডোরটিকে গেম-চেঞ্জার হিসেবে তুলে ধরা হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতাও আছে। করিডোরের সঙ্কীর্ণ পার্বত্য অংশ মূলত দুই লেনের একটি সড়ক যা বড় আকারের সরবরাহ পরিচালনার উপযোগী নয়। সমালোচকরা যুক্তি দেন, এটি বাস্তবের চেয়ে বেশি প্রতীকী। সামগ্রিকভাবে এই পরিকল্পনাটি কয়েক দশকের সঙ্ঘাতের ক্ষতবিক্ষত একটি অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা চিরস্থায়ী করার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
ইরান কেন ক্ষুব্ধ : বহুমুখী হুমকি : জাঙ্গেজুর করিডোরের প্রতি ইরানের বিরোধিতা তীব্র। তেহরান বারবার এটিকে ‘রেড লাইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, ‘রাশিয়ার সাথে বা ছাড়াই’ এটিকে অবরুদ্ধ করার অঙ্গীকার করেছে এবং এমনকি এটিকে বিদেশী শক্তির ‘কবরস্থানে’ পরিণত করার হুমকিও দিয়েছে। ইরানের কারণগুলো যৌক্তিক। ইরান এটিকে তার সুরক্ষা, অর্থনীতি, প্রভাব ও অস্তিত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে।
ককেশাসে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কৌশল : মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম জটিল ভূ-রাজনৈতিক কেন্দ্রস্থল, যেখানে জ¦ালানি সম্পদ, বাণিজ্যিক পথ এবং নিরাপত্তা স্বার্থের সঙ্ঘাত সর্বদা উত্তপ্ত। রাশিয়া এখানে ঐতিহাসিক সামরিক আধিপত্য বজায় রেখেছে, চীন অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছে, ইরান ও ভারত সীমিত কিন্তু কৌশলগত উপস্থিতি রক্ষণাবেক্ষণ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন সামরিকভাবে অনুপস্থিত। ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ওকালতিতে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান শান্তি চুক্তির মাধ্যমে জাঙ্গেজুর করিডোরে ৯৯ বছরের একচেটিয়া উন্নয়ন অধিকার (exclusive development rights) প্রদানের ঘটনা এই ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করে। চুক্তিটি, ‘Trump Route for International Peace and Prosperity’ নামেও পরিচিতি পেয়েছে। করিডোরটি ইরানের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত বিধায় এটি কি সত্যিকারের শান্তির পথ, নাকি নতুন সঙ্ঘাতের বীজ রোপিত হয়েছে তা নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে।
রাশিয়া, চীন, ইরান ও ভারতের প্রভাব : মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি শক্তিশালী ও অপরিবর্তিত। তাজিকিস্তানে সাত সহস্রাধিক রাশিয়ান সেনাঘাঁটি এবং কিরগিজস্তানে সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যা সন্ত্রাসবাদ ও সীমান্ত নিরাপত্তার নামে বজায় রাখা হয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে উজবেকিস্তানে যৌথ সামরিক অভিযাত্রা ইউক্রেন যুদ্ধের পরও আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে রাশিয়ার ভূমিকা পুনরুজ্জীবিত করেছে। সমালোচকরা বলেন, রাশিয়া এখন ‘সিস্টেমিক ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করছে; কিন্তু লজিস্টিক সীমাবদ্ধতার কারণে আগ্রাসী হওয়ার সম্ভাবনা কম। চীনের ভূমিকা অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ করেছে। কাজাকিস্তান ও উজবেকিস্তানকে তার প্রধান অংশীদারে পরিণত হয়েছে।
শিনজিয়াং-সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসের ভয়ে চলতি বছরের জুন মাসে চীন-সেন্ট্রাল এশিয়া চুক্তি জোরদার করেছে, বিশেষ করে তাজিকিস্তানের সাথে যৌথ সামরিক মহড়ায় (কাউন্টার-টেরোরিজম) চীনের প্রভাব বাড়িয়েছে। চীন রাশিয়ার সাথে সমন্বয় করে চলছে; কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উপস্থিতি এই ভারসাম্য বিঘিœত করবে তাতে সন্দেহ নেই। ইরানের সম্পর্ক সীমিত কিন্তু কৌশলগত। তুর্কমেনিস্তানের সাথে চলতি ২০২৫ সালের মে মাসে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের (ঊঅঊট) সাথে ফ্রি ট্রেড চুক্তি এবং জুন মাসে শিপিং-লজিস্টিক্স মেমোরেন্ডাম ইরানের বাণিজ্যিক প্রসারণের সূচনা হয়েছে। তুর্কমেনিস্তান ইরানের অষ্টম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, গ্যাস ঋণ নিষ্পত্তির পর এই সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। তবে, ইরান-ইসরাইল উত্তেজনায় তুর্কমেনিস্তানের শরণার্থী গ্রহণ ও জাঙ্গেজুরের বিরোধিতা ইরানকে সতর্ক করেছে। ভারতের উপস্থিতি ‘হালকা’ হলেও গুরুত্বপূর্ণ। তাজিকিস্তানের Farkhor Air Base (২০০২ সাল থেকে) এবং Ayni Air Base-এ সীমিত সুবিধা ভারতকে পাকিস্তানবিরোধী কৌশলে এগিয়ে নিয়ে গেছে। চলতি সালে এই ঘাঁটিগুলো থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতি বাড়ানো হয়েছে, যা মে মাসের ভারত-পাকিস্তান সঙ্কটে সহায়তা দিয়েছে।
মধ্য এশিয়ায় প্রভাব এবং উপসংহার : ইরান শুরু থেকেই এই কৌশলের বিরোধিতা করছে। কাগজে-কলমে নিরাপত্তামূলক বলা হলেও এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সমালোচকরা বলছেন, ভূমি দখল। ট্রাম্প এটিকে ‘শান্তির জয়’ হিসেবে প্রচার করেছেন, ইরানের প্রধান উপদেষ্টা আলী আকবর বেলায়াতি এটিকে বলেছেন বধ্যভূমি। রাশিয়া এবং তুরস্কও সতর্ক বার্তা দিয়েছে, যদিও আজারবাইজান সমর্থন করছে। স্পষ্টতই, করিডোরটি সামরিক ঘাঁটির সম্ভাবনা তৈরি করছে শতভাগ। এই কৌশল মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্রেটার সেন্ট্রাল এশিয়া’ ভিশনের অংশ এবং চীন-রাশিয়া-ইরানের বিরুদ্ধে একটি নতুন নিরাপত্তা কর্মকাটামো। বলা যায়, জাঙ্গেজুর করিডোর হলো দক্ষিণ ককেশাসের ভঙ্গুরতার উদাহরণ।
অর্থনৈতিক করিডোরগুলো ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। সংযোগ বৃদ্ধি হলেও রাশিয়ানরা যেকোনো সময় একচেটিয়া মোকাবেলা করতে পারে, এটিতে আর্মেনিয়ার সার্বভৌমত্ব খর্ব হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইরানের ক্ষোভ একটি যৌক্তিক কোণ থেকে উদ্ভূত। জাঙ্গেজুর কেবল তার অর্থনৈতিক সুবিধা হ্রাস করে না, প্রতিপক্ষকে দোরগোড়ায় আমন্ত্রণ করেছে, যা তেহরানের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের ক্ষমতার গতিশীলতাকে নতুন রূপ দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সব অংশীজনের উদ্বেগের সমাধান না করে, ইরানের রেড লাইনসহ, করিডোরটি একটি সংযোগ সেতু না হয়ে বরং প্রান্তবিন্দু হয়ে ওঠার ঝুঁকি বেড়েছে। প্রমাণিত ইস্যুগুলো বোঝায়, পারস্পরিক সুবিধা কম এবং আজারবাইজান-তুর্কিদের লাভ বেশি, মার্কিন সম্পৃক্ততা এবং সামরিক উপস্থিতি ইরান ও রাশিয়ার পশ্চিমাবিরোধী প্রতিক্রিয়া বাড়িয়েছে। সত্যিকারের অগ্রগতির জন্য বিকল্প পথ ভেবে দেখা দরকার।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার



