কঠিন সময় পার করছে দেশ

মানবাধিকার নিয়ে কোনো উদ্বেগ এলে সেটিকে বিবেচনায়ও নেবে। ছয় সংস্থার চিঠি নিয়ে সরকার প্রতিবাদ বা বিবৃতিও দেবে না।

রিন্টু আনোয়ার
রিন্টু আনোয়ার |সংগৃহীত

কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ। কে কোন দিকে কাকে শিকার করছে, দেশকে কোন অস্থিরতায় ফেলার ছক করছে, তার ইয়ত্তা নেই। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি স্থাপনায় ঘটেছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। সামনে আরো কোনো অঘটনের শঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে সারা দেশে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় (কেপিআই) নিরাপত্তায় জোর দেয়া হয়েছে।

দেশে এখন কেপিআইভুক্ত স্থাপনা ৫৮৭টি। সংসদ ভবন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বঙ্গভবন, সচিবালয়, মেট্রোরেল বিশেষভাবে কেপিআইভুক্ত। কেবল র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসর ছুটিতে); র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো: মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো: সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম, বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা মেজর মো: রাফাত-বিন-আলম নন; ডিজিএফআইয়ের সাবেক তিনজন পরিচালক- মেজর জেনারেল শেখ মো: সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকীও বিচারের কাঠগড়ায়। আদালতকে তাদের বিষয়ে নতুন করে কোনো রুলিং দিতে হয়নি। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিতে হয়নি। বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির না হলে বা তাদের হাজির না করলে দু’টি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। মামলা তিনটির মধ্যে দু’টি হচ্ছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। অন্যটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। আসামিদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতাও দৃশ্যমান হলো। এর মধ্য দিয়ে গুজবের বাজার আবারো মার খেয়েছে।

সেনাবাহিনী বিচার করতে দিতে চায় না, এ নিয়ে সরকারের সাথে বা আদালতের সাথে সেনাবাহিনীর চরম বিরোধ যাচ্ছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে, ভেতরে অবস্থা বড় গরম- ইত্যাদি গুজবে দেশ গরম করে তোলা হয়। সেখানে ঠাণ্ডা পানির ছটা দিয়েছে সেনাবাহিনীই। জানিয়ে দিয়েছে, ‘নো কম্প্রোমাইজ উইথ ইনসাফ’। গুমের শিকার পরিবারগুলোকে গভীর সমবেদনাও প্রকাশ করেছে। ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইনকে মুখোমুখিও করেনি; বরং আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে সহায়তা দিচ্ছে। বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর পর অভিযুক্তদের পরিবার থেকে আলাদা করে সেনা হেফাজতে এনে সেনাবাহিনী এ বিচারে সহায়তা করছে। জানানো হয়েছে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। এটি কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়। আরো জানানো হয়, ঘটনাকালে অভিযুক্তদের কেউই সেনাবাহিনীর সরাসরি কমান্ডের অধীনে কর্মরত ছিলেন না। ডিজিএফআই বা র‌্যাবে ছিলেন ডেপুটেশন বা প্রেষণে। এসব বাহিনী সেনাবাহিনীর অধীনে নয়। বিশেষ করে ডিজিএফআই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়। অভিযুক্তদের কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ডের বাইরে। তাদের সম্পর্কে সেনা সদরের পক্ষে অবগত হওয়া বা নজরদারি করার ব্যবস্থাই নেই। আর র‌্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

এ অবস্থায় গোটা সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি করার দুষ্টু চেষ্টা চলে। এর আপাতত একটা অবসান ঘটেছে। তাদেরকে ঢাকা সেনানিবাসের যে সাব জেলে রাখা হয়েছে, সেখানে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হাসিনা সরকারের আমলে গড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ সরকার আমলে তার অতীত একতরফা বিচারিক কলঙ্ক কাটিয়ে উঠেছে। কাউকে মনগড়া মৃত্যুদণ্ড বা বিচারিক হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পথে নেই ট্রাইব্যুনাল। বিচারের আগেই বিচার করছে না। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ দেয়া হচ্ছে। মন খুলে কথা বলছেন তাদের আইনজীবীরা। ট্রাইব্যুনাল কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর এই সেনাকর্মকর্তাদের ঢাকা সেনানিবাসের সাব জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের গুম-নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দু’টি মামলায় এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা একটি মামলায় মোট ২৫ জন সাবেক-বর্তমান সেনাকর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ৮ অক্টোবর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। সে দিনই এই তিন মামলায় ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এরপর ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৫ কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেয়া হয়েছে।

গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন পরবর্তীতে পূর্ববর্তী গুম-খুনের বিচার করা বর্তমান সরকারের দায়িত্ব। সরকারের একারই দায়িত্ব এমনই নয়। সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতাসহ বিপ্লব সফলে সংশ্লিষ্ট সবাই এর অংশীজন। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের নজরও এ দিকে। বিশেষ নজর বিচার প্রক্রিয়ার দিকে। ১৫ সেনাকর্মকর্তাকে ট্রায়ালে আনার ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বলেছে, বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করার এটিই প্রথম উদাহরণ। ভুক্তভোগীদের জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই বিচারিক প্রক্রিয়াজুড়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড পুরোপুরি মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে রয়েছে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ও সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা বিধান করা, বিচার কার্যক্রম বেসামরিক আদালতে পরিচালনা করা।

বিশ্বায়নের এ যুগে বিচারসহ যেকোনো দেশের ঘটনাবলির দিকে বিভিন্ন দেশেরই নজর থাকে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের পর্যবেক্ষণ জোরদার করে। অ্যামনেস্টির প্রতিক্রিয়া এরই অংশ। এর দুই দিন আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তদন্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রশংসা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি যৌথভাবে খোলাচিঠি দিয়েছে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা। এতে স্বাক্ষরকারী সংস্থাগুলো হলো- সিভিকাস, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, ফর্টিফাই রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস ও টেক গেøাবাল ইনস্টিটিউট। চিঠিটি প্রকাশ হয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে। এতে তারা ১২টি সুপারিশ আমলে নেয়ার জন্য সরকারের উদ্দেশে তুলে ধরেছে। পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দিয়েছে। ৯ নম্বর প্রেসক্রিপশনে এসেছে আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে যে সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও বহুদলীয় রাজনীতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

১০, ১১, ১২ নম্বরে গিয়ে সিভিল সোসাইটি ও এনজিও স্বাধীনতাসহ আরো কিছু বিষয় আনা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- কিছু গণমাধ্যম আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকেই বেশি পিক করেছে। কেউ কেউ এক নম্বরেই নিয়ে এসেছে। সরকার গোটা বিষয়টিকে সতর্কতার সাথে নিয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যেও তা পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজ করবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের কাজ করবে। সরকারের পক্ষে কখনোই তাদের সব কিছু মেনে নেয়া সম্ভব হবে না। মানবাধিকার নিয়ে কোনো উদ্বেগ এলে সেটিকে বিবেচনায়ও নেবে। ছয় সংস্থার চিঠি নিয়ে সরকার প্রতিবাদ বা বিবৃতিও দেবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট