আওয়ামী লীগের শাসনামলের বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন তৎকালীন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাহবুবে আলম। তার নিয়োগ বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। ২০১৬ সালে সংবিধানে নির্ধারিত ৬৭ বছর বয়সসীমা অতিক্রম করার পরও তাকে পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়। এ ঘটনায় রাজনৈতিক চরম আনুগত্য এবং সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। আদালতে মাহবুবে আলম প্রচণ্ড প্রভাব ও ক্ষমতার প্রয়োগ করতেন। যুক্তি দিয়ে কাজ করতে না পারলে আইনবহির্ভূত চাপের পথ বেছে নিতেন। প্রায়ই তিনি বিচারকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বশীভূত করতেন অথবা যারা স্বাধীনভাবে রায় দেয়ার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ‘অনাস্থা’ প্রকাশ করতেন। আদালতের বাইরেও তার প্রভাবের বিস্তার ছিল পুলিশের মাধ্যমে মামলা সংশ্লিষ্টদের হয়রানি করা পর্যন্ত। অনেকের চোখে, মাহবুবে আলম একটি প্রজাতন্ত্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের চেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ‘আইন সচিব’ হিসেবে বেশি ভূমিকা পালন করেছেন।
মাহবুবে আলমের সাথে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নতুন কোনো বিষয় ছিল না। ১৯৯৮ সালে যখন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করে, তখন থেকে এ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ পদে থাকাকালীন তিনি সরকারের প্রতি গভীর রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন করতে শুরু করেন। আইনি যৌক্তিকতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি দলীয় স্বার্থে মামলায় যুক্তি উপস্থাপন করতেন। মামলার আইনগত ভিত্তি যাই হোক না কেন, বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর সাথে সামান্য সংশ্লিষ্টতা থাকা যেকোনো আবেদনকে তিনি নিয়মিতভাবে এবং আক্রমণাত্মকভাবে বিরোধিতা করতেন। এ বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে একটি কাস্টমস-বিষয়ক মামলা, যেখানে তার আপত্তির একমাত্র দৃশ্যমান কারণ ছিল এটি যে, আবেদনকারীর পক্ষের আইনজীবী ছিলেন জামায়াতের একজন পরিচিত মুখ, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। হাইকোর্ট বিভাগ যখন তার বিপক্ষে রায় দেন, তখন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে মাহবুবে আলম আপিল বিভাগে আপিল করেন, সেখানে তিনি আবারো পরাজিত হন। পরবর্তী সময়ে একই জেলা, মুন্সীগঞ্জের অধিবাসী হওয়ার সুবাদে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের একজন জুনিয়র আইনজীবীর সাথে খোলামেলা আলাপচারিতায় মাহবুবে আলম স্বীকার করেন, মামলাটিতে তিনি আপিল করেছিলেন শুধু রাজ্জাকের মামলায় সম্পৃক্ততার কারণে। তিনি বলেছিলেন, যদি অন্য কোনো আইনজীবী জড়িত থাকতেন, তাহলে তিনি আপিল করতেন না। আইন পেশার এ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত আইনজীবীত্বের ধরন তাকে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার পর অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগের স্বাভাবিক পছন্দে পরিণত করে।
অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরপর মাহবুবে আলম সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত আইনজীবী ও মামলাকারীদের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করতে শুরু করেন। ২০০৯ সালে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক তার স্ত্রীর সাথে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করে তাকে বিমানবন্দরে থামিয়ে দেয়া হয়। সেই সাথে বিদেশ যেতে বাধা দেয়া হয়। রাজ্জাক তখন হাইকোর্ট বিভাগের শরণাপন্ন হলে আদালত তাকে ভ্রমণের অনুমতি দেন। কিন্তু আদালতের আদেশ সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তাকে দেশত্যাগে বাধা দিতে থাকে। আদালতের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে মাহবুবে আলম আরো গুরুতর একটি পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেন। ব্যারিস্টার রাজ্জাককে তিনি ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত করার অপচেষ্টা করেন। তিনি দাবি করেন, রাজ্জাক বিদ্রোহীদের লাশগুলো কীভাবে সরাতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে সরাসরি বিডিআর মামলার তদন্তকারী সিআইডি কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দকে ফোন করে ব্যারিস্টার রাজ্জাককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করতে বলেন তিনি। এ নির্দেশনা অনুযায়ী, জনাব আকন্দ ব্যারিস্টার রাজ্জাককে তার পাসপোর্টসহ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উপস্থিত হওয়ার নোটিশ জারি করেন।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সিআইডি সদর দফতরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যাওয়ার আগে আইনি সতর্কতা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে পূর্বধার্য জামিনের আদেশ (অ্যান্টিসিপেটরি বেইল) নিয়ে আসেন, সাথে একটি নির্দেশনা যাতে সিআইডি অফিসার আব্দুল কাহহার আকন্দ তার পাসপোর্ট জব্দ করতে না পারেন। জিজ্ঞাসাবাদের দিন আমরা সিআইডি সদর দফতরে অপেক্ষা করছিলাম, তখন ব্যারিস্টার রাজ্জাকের আইন সহায়তাকারীর কাছ থেকে একটি ফোনকল আসে। তিনি আমাদের জানান, অ্যাটর্নি জেনারেল জামিনের (অ্যান্টিসিপেটরি বেইল) আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আপিল বিভাগের চেম্বার জজের কাছে আপিল দায়ের করতে ছুটে গেছেন। সে সময় পূর্বধার্য জামিনের আদেশের বিরুদ্ধে সরকারের আপিল করা প্রায় অশ্রুত ছিল। আমরা সবাই চেম্বার জজের কক্ষে উপস্থিত হই এবং মামলাটি শুনানির জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। চেম্বার জজ ছিলেন বিচারক শাহ আবু নঈম মোমেনুর রহমান। তিনি প্রথমে আমাদের মামলাটি গ্রহণ করেন এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত দেন। তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলের আবেদন খারিজ করে দেন এবং মামলাটি পূর্ণাঙ্গ আদালতে পাঠানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
আইনি কোনো উপায় না পেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালত থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। সেখানে তিনি মিথ্যা অভিযোগ করেন যে, ব্যারিস্টার রাজ্জাক বিডিআর বিদ্রোহের সময় জওয়ানদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ ঘটনা স্পষ্ট করে জানান দেয়, মাহবুবে আলম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে কত দূর যেতে প্রস্তুত ছিলেন। শুধু আদালতে প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক লড়াইয়ে জেতায় তিনি ভয়াবহ অপরাধ-সংশ্লিষ্ট মামলাতেও মিথ্যা অভিযোগ করতে দ্বিধা করেননি।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের ওপর মাহবুবে আলম তখনই হয়রানি বন্ধ করেন, যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে তাকে তা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। মার্কিন কূটনীতিকদের সরাসরি হস্তক্ষেপের পর এ নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ হাসিনার এ সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি আশা করেননি, প্রধানমন্ত্রী নিজে এগিয়ে আসবেন। সেই মুহূর্ত থেকে তিনি আর কখনো ব্যক্তিগতভাবে ব্যারিস্টার রাজ্জাককে লক্ষ্যবস্তু বা হয়রানি করেননি।
অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মাহবুবে আলম বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের তার বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাড়িটিতে বেগম খালেদা জিয়া প্রায় ৪০ বছর ধরে বসবাস করেছিলেন। এ ঘটনায় মাহবুবে আলম উচ্ছেদ কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিশেষভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিদের সম্পত্তি বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলাগুলোতে মাহবুবে আলম ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখাতেন। এমন একটি মামলার লক্ষ্য ছিল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল। সরকার দাবি করে, হাসপাতালটির একটি অংশ দখলকৃত জমিতে নির্মিত হয়েছে এবং তা ভাঙার উদ্যোগ নেয়। মাহবুবে আলম আদালতে উপস্থিত হয়ে উচ্ছেদের পক্ষে যুক্তি দেন। আইনি ভিত্তিতে নয়; বরং তিনি বিশ্বাস করতেন- হাসপাতালটি জামায়াতে ইসলামী-সম্পৃক্ত। তিনি হাইকোর্ট ডিভিশনে মামলা পরিচালনা করেন কিন্তু পরাজিত হন। রায় মেনে নেয়ার পরিবর্তে তিনি আপিল বিভাগে আপিল করেন। সেখানেও পরাজিত হন। মামলার গুণাগুণ বিবেচনা না করে বিরোধী দলের সাথে সম্পৃক্ত যেকোনো মামলা চ্যালেঞ্জ করার তার এ বাতিক, প্রায়ই মামলাকারীদের জন্য অপ্রয়োজনীয় হয়রানি এবং আদালতের মূল্যবান সময়ের অপচয় ঘটাত।
যখনই ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের চেম্বার কোনো সরকারি সংস্থার পক্ষে আদালতে উপস্থিত হতেন, মাহবুবে আলম সাথে সাথে মামলার ফাইল খতিয়ে দেখতেন। তিনি জানতে চাইতেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে একজন বিরোধীদলীয় আইনজীবী কীভাবে সরকারি মামলার দায়িত্ব পেতে পারেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যেসব গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, সেগুলোর সাথে মাহবুবে আলম ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি জানতেন, এসব বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। কিছু মামলায়, যেমন- আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের ক্ষেত্রে, তিনি জানতেন- সাজা নিশ্চিত করতে ভুয়া প্রমাণ ব্যবহার করা হয়েছে। তবু তিনি অন্যায় সংশোধনে কোনো চেষ্টা করেননি; বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আভাস দিয়েছিলেন, তিনি সাঈদীর ফাঁসি চান না, তখনো মাহবুবে আলম মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। তিনি জেনেশুনে অবিশ্বস্ত ও বানোয়াট প্রমাণের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত রায়কে সমর্থন করেন। এসব বিচার চলাকালীন মাহবুবে আলম ন্যায্যতা রক্ষার কোনো সদিচ্ছা দেখাননি। বাংলাদেশের জনগণের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে, তিনি আওয়ামী লীগের একজন বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন এবং তার পদ ব্যবহার করেছেন দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোভিড-১৯ জনিত জটিলতায় মাহবুবে আলমের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর সিনিয়র অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল পদে তার স্থলাভিষিক্ত হন। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই মাহবুবে আলমকে ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আসন্ন গণবিক্ষোভ ও তার কর্মকাণ্ডের পরিণতি থেকে রক্ষা করেছিল।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি