২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে এসে বাংলাদেশ এক ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক হাল ধরে রেখেছে, যার মূল দায়িত্ব আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর মধ্যে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা। এই সরকার কেবল রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ, দলীয় বিবেচনায় নয়; বরং সুশাসন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার লক্ষ্যেও কাজ করছে। ঠিক এই সময়েই প্রশ্ন উঠছে- রাষ্ট্র কি তার সৎ, দক্ষ ও উদ্যমী নাগরিকদের যথাযথভাবে কাজে লাগাচ্ছে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এসব মানুষ বারবার উপেক্ষিত হন। অথচ এরা যদি এখন কাজে না আসেন, তাহলে নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের ব্যবহারের সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হবে। কাজেই, বর্তমান সরকার চাইলেই এখন একটি সুবর্ণ সুযোগের জানালা (এড়ষফবহ ডরহফড়ি ড়ভ ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু) কাজে লাগাতে পারে।
১. সৎ ও উদ্যমী মানুষের সঙ্কট নয়, ব্যবহারের অভাব : বাংলাদেশে অনেক দেশপ্রেমিক লোক রয়েছে, যারা অত্যন্ত সক্রিয়, অভিজ্ঞ, প্রশাসনিকভাবে দক্ষ এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে উপযুক্ত বলে প্রমাণিত। কিন্তু তারা রাজনৈতিক দলের দালালি করে না, তোষামোদ জানে না, ঘুষ দিয়ে পদে উঠতে চায় না। তাই সিস্টেম থেকে ক্রমাগত ছিটকে পড়ে যান। অনেকেই বাধ্য হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান, অবসর গ্রহণ করেন অথবা বিদেশে চলে যান, এটিই হলো মেধা অপচয়ের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক।
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই লোকদের শনাক্ত করে রাষ্ট্রের উপকারে ব্যবহার করার এখনই সময়। কারণ এই সরকার কোনো দলীয় দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ নয়। সৎ ও কর্মঠ মানুষদের দিয়ে চাকরি নয়, রাষ্ট্রগঠনের কাজ করানোই এখন সময়ের দাবি।
২. রাষ্ট্র কেন তাদের ব্যবহার করে না? : রাষ্ট্র অনেকসময় তাদের ব্যবহার করে না, যারা সত্যিকারের সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক, কারণ এসব গুণাবলি বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূল বিবেচনায় নেই। দলীয় আনুগত্যকে কর্মদক্ষতার চেয়ে বেশি মূল্য দেয়া হয়, ফলে যারা কেবল দলের প্রতি অনুগত নন; কিন্তু খুবই সক্রিয় ও দক্ষ, তারা জায়গা পান না। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ঘুষ ও তোষামোদের সংস্কৃতি আরো ভয়াবহভাবে মেধাবী ও নীতিবান মানুষকে রাজনীতি ও প্রশাসন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এর পাশাপাশি, যারা সাহস করে সিস্টেমকে প্রশ্ন তোলে, পরিবর্তনের কথা বলে, দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠী তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে ধরে বা অবজ্ঞার সাথে দূরে সরিয়ে রাখে। এই যে ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন, তার ফলে রাষ্ট্র শুধু একটি ব্যক্তিকে নয়, একটি সম্ভাবনাকে হত্যা করে।
৩. বর্তমান সরকারের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ : বর্তমান নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, তারা কোনো ভোট রাজনীতি বা জনপ্রিয়তা অর্জনের চাপমুক্ত। কাজেই তারা চাইলে নীতিবান, নির্ভীক এবং অত্যন্ত দক্ষ মানুষকে বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী বোর্ড, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সেল, দুর্নীতি দমন টাস্কফোর্স, প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি ইত্যাদিতে যুক্ত করতে পারে। এই অন্তর্বর্তী সময়টায় যদি সরকার কিছু সৎ, মেধাবী নাগরিককে দুর্নীতি দমন, নির্বাচন-প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা, আমলাতান্ত্রিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সেন্সিটিভ মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত করে, তবে সেটি পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য একটি শক্ত ভিত তৈরি করবে। ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারের কাজ তখন সহজ হবে।
৪. সৎ নাগরিকদের অবহেলার পরিণতি- জাতীয় ক্ষয়ক্ষতি : সৎ, অত্যন্ত উদ্যমী ও চিন্তাশীল নাগরিকদের অবমূল্যায়ন একটি জাতির জন্য চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যখন তাদের সিস্টেম থেকে দূরে রাখা হয়, তখন তা তরুণ সমাজের কাছে এই বিপজ্জনক বার্তাটি পাঠায়, সততা কোনো কাজে আসে না, ফলে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটে। এসব মেধাবী মানুষ হয় বিদেশে চলে যায়, নয়তো নিরুৎসাহী হয়ে অবসরে গিয়ে চুপ করে থাকেন, ফলে জাতি হারায় মূল্যবান মেধা ও দূরদর্শী নেতৃত্ব। এই শূন্যতায় দুর্নীতিবাজদের বিচরণক্ষেত্র হয় প্রশস্ত, যাদের হাতে পড়ে দেশীয় সম্পদ ও প্রশাসন ব্যবস্থার অপব্যবহার বেড়ে যায়। এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও নেতৃত্বের অনুপ্রেরণা পায় না, আর রাজনৈতিকভাবে অস্থির সময়ে রিস্ক ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তির অভাবে রাষ্ট্র গভীর সঙ্কটে পড়ে।
৫. বেশ কিছু সফল দেশের উদাহরণ : সিঙ্গাপুর মডেল- লি কুয়ান ইউ ক্ষমতায় এসেই ঘুষখোর ও অযোগ্যদের বাদ দিয়ে সৎ, কর্মক্ষম ও নিষ্ঠাবান মানুষকে রাষ্ট্র পরিচালনায় এনেছিলেন। ফলাফল, এক প্রজন্মেই সিঙ্গাপুর উন্নত দেশে রূপান্তরিত।
রুয়ান্ডা মডেল- গণহত্যা-উত্তর রুয়ান্ডায় পল কাগামে এমন একটি সুশাসনের কাঠামো গড়ে তুলেছেন, যার কেন্দ্রে আছে সততা ও পারফরম্যান্স।
বাংলাদেশ চাইলে এই উদাহরণগুলো অনুসরণ করে, বিশেষ করে একটি নিরপেক্ষ সরকার চাইলে রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই এ ধরনের সংস্কারমূলক কাজ শুরু করতে পারে।
৬. রাষ্ট্রের করণীয় এখনই-
ক. ট্যালেন্ট হান্ট মেকানিজম তৈরি করা : অবসরপ্রাপ্ত সচিব, সামরিক কর্মকর্তা, কূটনীতিক, গবেষক ও প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি ‘সৎ ও দক্ষ নাগরিক টাস্কফোর্স’ গঠন বর্তমান সময়ে একটি বাস্তব ও কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা দীর্ঘসময় শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে থেকে কাজ করেছেন, যা তাদের নেতৃত্ব ও দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা তৈরি করেছে। যদিও কিছু ব্যতিক্রম আছে, তবে সামগ্রিকভাবে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। একইভাবে, সিভিল সার্ভিস, শিক্ষক, প্রকৌশলীসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যেও অনেক উদ্যমী ও সৎ মানুষ আছেন, যাদের কর্মক্ষমতা অতীতে প্রমাণিত। এদের নিয়ে একটি ‘ট্যালেন্ট পুল’ গঠন করে সংরক্ষণ করলে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশাসনিক বা নীতি-নির্ধারণী কাজে যুক্ত করা যাবে। বিষয়টি নিয়ে আমার পূর্ববর্তী একটি নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে আর কত প্রাণ দিতে হবে?’ নয়াদিগন্ত, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
খ. স্বল্পমেয়াদি মিশন- দ্রুত সমাধানে দক্ষ নাগরিকদের ব্যবহার : মেধাবী ও অভিজ্ঞদের তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি স্বল্পমেয়াদি মিশনে যুক্ত করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে এখনো লাগানো সম্ভব। যেমন- নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ, দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক রিফর্ম পরিকল্পনা ইত্যাদি। এই উদ্যোগ শুধু বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য নয়, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারগুলোর জন্যও একটি কার্যকর মডেল হতে পারে।
গ. নাগরিক মূল্যায়নের জন্য পাবলিক ফোরাম : সাধারণ জনগণকেই সুযোগ দিতে হবে যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার মাধ্যমে অংশীদারিত্বমূলক রাষ্ট্র নির্মাণে। অনেক সৎ, উদ্ভাবনী এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক আছেন, যারা প্রচারবিমুখ, আত্মপ্রকাশে অনিচ্ছুক বা সিস্টেমের প্রতি আস্থাহীন হয়ে আড়ালে থাকেন। সরকার একটি ‘জাতীয় নাগরিক মূল্যায়ন ফোরাম’ চালু করতে পারে, যেখানে জনগণ নিজে প্রস্তাব দিতে পারবে- কে সৎ, দেশপ্রেমিক ও নেতৃত্বের যোগ্য।
ঘ. ঘুষ-তোষামোদ-নির্ভর নিয়োগ ব্যবস্থার বিলোপ : প্রকৃত উন্নয়ন চাইলে রাষ্ট্রকে ‘যোগ্যতার বিপ্লব’ ঘটাতে হবে, যেখানে পেছনে পড়ে থাকা সৎ, উদ্যমী ও দেশপ্রেমিক নাগরিকরা উঠে আসতে পারবেন রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দিতে।
৭. আগামী নির্বাচনের পর যা হতে পারে : নির্বাচনের পর একটি দলীয় রাজনৈতিক সরকার আসবে, যারা স্বভাবতই তাদের ঘনিষ্ঠদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দেবে। তখন এই মুহূর্তে অবহেলিত সৎ, উদ্যমী, চিন্তাশীল মানুষদের আর ব্যবহার করা যাবে না। তাই বর্তমান সরকার যদি সেই সুযোগ কাজে না লাগায়, তবে এই নৈতিক অপরাধের দায় কেবল দলীয় সরকার নয়, এই নিরপেক্ষ সরকারও বহন করবে।
৮. ইতিহাসের দরজায় কড়া নাড়ছে এক সুযোগ : বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সামনে একটি অভূতপূর্ব সুযোগ রয়েছে, তারা যদি চায়, তবে রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকেও দেশপ্রেমিক, সৎ এবং প্রতিভাবান নাগরিকদের নিয়ে একটি ‘শাসনের নতুন মানদণ্ড’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সৎ মানুষকে উপেক্ষা করা শুধু তাদের প্রতি অবিচার নয়, গোটা জাতির প্রতি অন্যায়। রাষ্ট্র যদি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, ‘সততা ও মেধা’ কাজে না লাগায়, তবে সেটি হবে ইতিহাসের এক প্রহসন। ইতিহাস হয়তো বলবে- ২০২৫ সালের অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই রাষ্ট্রকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারত; কিন্তু তারা সাহস দেখায়নি। এই ইতিহাস যেন না লেখা হয়, এটিই প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও প্রো-ভিসি, বিইউপি



