জুলাই সনদ ও বিএনপি-জামায়াতের মেরুকরণ

জুলাই বিপ্লব শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নয়, এটি ছিল একটি নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার দাবির বহিঃপ্রকাশ। এ কারণেই আমরা দেখেছি বিভিন্ন কমিশন গঠিত হয়েছে, যারা সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছে। এই প্রস্তাবগুলোর অনেক অংশই জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা আজ জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার দলিল। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব, এই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। অন্যথায়, জনগণের ইচ্ছা বাস্তবায়ন হবে না।

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘জামায়াতের প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার লেখক একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। নিবন্ধে লেখক বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জামায়াতের প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়। নিবন্ধে বিএনপির অবস্থান প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কেবল পরবর্তী সংসদের মাধ্যমেই হওয়া উচিত; যে সংসদে দলটির লক্ষ্য পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। লেখক জামায়াতের ধারণা বাস্তবতার সাথে অসঙ্গত বলে অভিহিত করলেও প্রস্তাবের আইনগত বৈধতার প্রশ্নটি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন। সাধারণ পাঠকের কাছে তার যুক্তিগুলো আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, কিন্তু আইনগত ভিত্তির দিক থেকে তা অত্যন্ত দুর্বল। এখানে আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে জামায়াতের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিএনপির আপত্তিগুলো বিশ্লেষণ করব।

জামায়াতে ইসলামীর দাবি, জুলাই সনদ অবিলম্বে একটি অন্তর্বর্তী সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে কার্যকর করা উচিত। তাদের মতে, এই আদেশ সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণের কর্তৃত্ব থেকে সরাসরি জারি হবে, জামায়াতের ভাষায় যারা ‘সংবিধান প্রতিষ্ঠাকারী ক্ষমতা’ ধারণ করে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধের লেখক এই অবস্থানের বিপরীত মত পোষণ করেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, ‘সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে পরবর্তী সংসদ কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে।’ তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে এই সরকার গঠিত হয়েছে। তার একমাত্র প্রমাণ, এই যে উপদেষ্টারা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী তত্ত¡াবধায়ক সরকারের জন্য নির্ধারিত শপথের অনুরূপ একটি শপথ গ্রহণ করেছেন। এরই ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সাংবিধানিক চর্চা’ অনুসরণ করছে।

নিবন্ধের লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা উপেক্ষা করেছেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী এখন আর সংবিধানে বিদ্যমান নেই। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে এই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বাতিল করেছিলেন। এই রায় বর্তমানে পুনর্বিবেচনার আওতায় রয়েছে এবং ২১ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে যার শুনানি নির্ধারিত হয়েছে। যত দিন না আপিল বিভাগ তাদের পূর্ববর্তী রায় প্রত্যাহার করে, তত দিন সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধই রয়ে যাবে। তা হলে উপদেষ্টারা কীভাবে এমন একটি অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে শপথ নিতে পারেন, যা আর সংবিধানে নেই? বাস্তবতা হলো, তাদের শপথ ছিল সম্পূর্ণরূপে উদ্ভাবিত, সংবিধানে যার কোনো ভিত্তি নেই। আরো একটি বিষয় লেখক এড়িয়ে গেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে সরানো হয়েছে অসংবিধানিক পন্থায়। এই সরকার অপসারণ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের স্থাপন পুরোপুরি সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে ঘটেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ আইনগত অবস্থানটি লেখকের আলোচনায় ছিল অনুপস্থিত।

প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রবন্ধের লেখক অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন রাষ্ট্রীয় কিছু কর্মকাণ্ডের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। তিনি উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন, ১১৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের নিয়োগ দিয়েছেন, ১২৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহাহিসাবরক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দিয়েছেন এবং ১৩৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও তার সদস্যদের নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি সংবিধানের ৯৩ নং অনুচ্ছেদের অধীন রাষ্ট্রপতির জারি করা বেশ কিছু অধ্যাদেশের কথাও তুলে ধরেছেন।

আপাতদৃষ্টিতে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের এসব দৃষ্টান্ত দেখে মনে হতে পারে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এই মূল্যায়ন অত্যন্ত সরলীকৃত ও গভীর বিশ্লেষণ বিবর্জিত। আধুনিক সাংবিধানিক তত্তে¡ কেবল সরকারি দফতরের চলমান কার্যক্রম কিংবা প্রচলিত বিধান অনুযায়ী নিয়োগ সম্পন্ন হওয়ার মতো উপাদানগুলো বৈধতার মৌলিক প্রশ্নের যথাযথ সমাধান প্রদান করে না। লেখক মূলত এই যুক্তিটি ব্যবহার করেছেন এ ধারণা অস্বীকার করার জন্য যে, জনগণ ‘সংবিধান প্রতিষ্ঠাকারী ক্ষমতা’ প্রয়োগ করেছে, অর্থাৎ বিপ্লব বা রাজনৈতিক অস্থিরতার পর জনগণের যে বিশেষ ক্ষমতা থাকে নতুন সংবিধান রচনা বা বিদ্যমান সংবিধান পুনর্গঠনের। কিন্তু এই যুক্তি ভুল এবং অসম্পূর্ণ। জনগণের ‘সংবিধান প্রতিষ্ঠাকারী ক্ষমতার’ প্রয়োগ মানেই বিদ্যমান সংবিধান বাতিল হয়ে যায় এমন নয়। বাস্তবে, উভয় কাঠামো পাশাপাশি চলতে পারে : জনগণ হয়তো একটি সরকারকে সরিয়ে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রকাশ করেছে, কিন্তু একই সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র পুরনো সংবিধানের বিধান অনুযায়ী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, জনগণের ‘সংবিধান প্রতিষ্ঠাকারী ক্ষমতা’ স্বীকার করা মানে সংবিধান বিলুপ্ত হয়ে গেছে এমন নয়; বরং এর মানে হলো, সংবিধানের কর্তৃত্ব এখন জনগণের উচ্চতর ক্ষমতার অধীন, যার মাধ্যমে তারা চাইলে সংবিধান অনুমোদন, সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারে।

২০২৪ সালের আগস্ট মাসের রাজনৈতিক ঘটনাবলি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে আবিভর্ূত। এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের সংবিধান প্রতিষ্ঠাকারী ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে, যে ক্ষমতা দিয়ে তারা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোকে নতুন রূপ দিতে সক্ষম। এই ক্ষমতা প্রয়োগ মানেই সংবিধান বাতিল হয়ে যাওয়া, বিষয়টি এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে সংবিধানের অস্তিত্ব জনগণের এই ক্ষমতা প্রয়োগের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। জার্মান পণ্ডিত ও সংবিধান আদালতের সাবেক বিচারপতি আর্নস্ট-ভলফগাং বোকেনফোর্ডে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংবিধান প্রতিষ্ঠাকারী ক্ষমতা ‘টুকরো টুকরো করে, ধাপে ধাপে’ বিদ্যমান সংবিধানকে ক্ষয় করতে পারে। এই আলোকে, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের উত্তাল সময়কে দেখা যেতে পারে জনগণের সেই চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগের মুহূর্ত হিসেবে, যার মাধ্যমে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা নির্মাণের পথে এগিয়েছে, যা ধীরে ধীরে বিদ্যমান সংবিধানের কিছু অংশকে ক্ষয়প্রাপ্ত করতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামণ্ডলীর সমন্বয়ে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর থাকার কারণ হলো এটি জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। অনেক সংবিধানবিদ একে ‘আইন-পূর্ব ক্ষমতা’ বলে অভিহিত করেন, এটি এমন একটি ক্ষমতা যা প্রচলিত আইন ও সংবিধানের কাঠামোর বাইরে অবস্থান করে। অতএব, পুরনো সংবিধানে এর অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো অনুচ্ছেদ খুঁজতে যাওয়াই ভুল চেষ্টার পরিচায়ক। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ জনগণকে একটি নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা নির্মাণের কর্তৃত্ব দিয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, পুরনো সংবিধানের সব কিছু বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে সংঘটিত পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোকে পুনর্গঠিত করেছে, কিন্তু যেখানে নতুন বাস্তবতার সাথে সঙ্ঘাত নেই, সেখানে পুরনো সংবিধান এখনো কার্যকর রয়েছে। ২০ শতকের জার্মান সংবিধানতত্ত¡বিদ কার্ল শমিট দেখিয়েছেন, সংবিধান বিদ্যমান থাকলেও জনগণ তাদের ‘সংবিধান-প্রণয়ন ক্ষমতা’ প্রয়োগ করতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে জনগণের কর্তৃত্ব বিদ্যমান সাংবিধানিক শৃঙ্খলার পাশাপাশি এবং তার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। একইভাবে, স্প্যানিশ পণ্ডিত হেক্টর লোপেজ বোফিল যুক্তি দেন যে, ‘সংবিধান-প্রণয়ন ক্ষমতা’ একটি ধারাবাহিক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত। এই ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়, বর্তমান সংবিধানের অনেক অংশ এখনো অনুসৃত হচ্ছে, যদিও আওয়ামী লীগ সরকারকে সরানো হয়েছে স্পষ্টভাবে পুরনো সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে। সংবিধান মানা আর জনগণের ‘সংবিধান-প্রণয়ন ক্ষমতার’ প্রয়োগ একে অপরের বিরোধী, এমন ব্যাখ্যা অত্যন্ত সরলীকৃত ও ভ্রান্ত। সাংবিধানিক পণ্ডিতদের অভিমত হলো, সংবিধান বিদ্যমান থাকলেও জনগণ তাদের সংবিধান-প্রণয়ন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, যার মাধ্যমে তারা পুরনো ব্যবস্থার সংশোধন, পরিবর্তন কিংবা সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করতে পারে।

প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে বিএনপির প্রতিফলিত অবস্থানের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, যদি বর্তমান সংবিধান অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে জুলাই সনদের কিছু মৌলিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। যেমন- সুপ্রিম কোর্টকে বিকেন্দ্রীকরণ করা এবং দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন- এই সংস্কারগুলো বর্তমান সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’র সাথে সাংঘর্ষিক। এই বাস্তবতা নাগরিকদের মধ্যে একটি গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সেটি হলো, বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে, তা হলে তারা জুলাই সনদের বহু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নাও করতে পারে। প্রবন্ধের লেখক এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন, বিএনপি কীভাবে সেই অংশগুলো বাস্তবায়ন করবে, যেগুলো সরাসরি বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক। এই অনুচ্চারিত দিকটি শুধু রাজনৈতিক কৌশলের প্রশ্ন নয়, সাংবিধানিক স্বচ্ছতার অভাবও নির্দেশ করে।

জামায়াতের প্রস্তাবের প্রধান সমালোচনার জায়গা হলো, দলটি সংবিধান প্রতিষ্ঠাকারী ক্ষমতা এবং বিদ্যমান সংবিধানের দুর্বলতার বাস্তবতা স্বীকার করতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। প্রকৃতপক্ষে, সম্ভবত জামায়াতই একমাত্র রাজনৈতিক দল যারা ২০২৪ সালের অক্টোবরেই এ বিষয়ে স্বাধীন আইনি পরামর্শ গ্রহণ করেছিল। সেই আইনি পরামর্শের আলোকে জামায়াত স্পষ্টত জানত, ৫ আগস্ট ২০২৪-এ জনগণ তাদের ‘সংবিধান প্রণয়ন ক্ষমতা’ প্রয়োগ করেছে এবং এর ফলে সংবিধানের অনেক অংশ ইতোমধ্যেই কার্যকারিতা হারিয়েছে। অন্যথায় শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? এ ঘটনাগুলো নিজেই প্রমাণ করে যে, সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে জনগণের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব কার্যকর হয়েছে, যা আইন-পূর্ব ক্ষমতার একটি বাস্তব উদাহরণ।

কিন্তু জামায়াত সেই পরামর্শ উপেক্ষা করল। তারা তা কাজে লাগায়নি, জনগণকে এর তাৎপর্য বোঝানোর চেষ্টা করেনি। কারণ তখন এটি তাদের কোনো রাজনৈতিক সুফল বয়ে আনছিল না। এবার, এক বছর পরে তারা সত্যটি বুঝেছে কিন্তু অনেক দেরিতে এবং জনগণকে সাংবিধানিক বাস্তবতা বোঝানোর ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। জুলাই বিপ্লবের অন্যতম প্রধান অংশগ্রহণকারী দল হিসেবে জামায়াতের দায়িত্ব ছিল স্পষ্টভাবে জানানো যে, এই বিপ্লবের ফলে সংবিধানের বহু অংশ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে, আওয়ামী লীগ উৎখাতের কয়েক মাসের মধ্যেই, এই বিষয়টি জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করা অনেক সহজ হতো। কিন্তু এক বছর পর এসে জনগণকে বোঝানো অনেক কঠিন। স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক সুবিধার হিসাব না করে জামায়াতের উচিত ছিল শুরু থেকেই এ বিষয়ে নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করা এবং দেশের প্রকৃত সাংবিধানিক অবস্থান সম্যকভাবে জনগণকে অবহিত করানো। যেমন ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী অনেক দেরিতে বুঝেছিল যে, ২৫ মার্চ রাতেই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে, তেমনি তারা এবারো বিলম্বে উপলব্ধি করেছে যে, সংবিধানের বহু অংশ এখন অকার্যকর এবং বাংলাদেশ একটি সাংবিধানিক রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। নীতির চেয়ে রাজনৈতিক লাভালাভকে অগ্রাধিকার দেয়ার এই প্রবণতা এখন জুলাই সনদের বহু গুরুত্বপূর্ণ ধারার বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করছে।

জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান বিতর্কের ফলাফলের অপেক্ষায় যখন বাংলাদেশের সমগ্র জনগণ অধীর হয়ে আছে, তখন এই বিভ্রান্তিতে একমাত্র সন্তুষ্ট ব্যক্তি হচ্ছেন আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানেন, বর্তমান সংবিধান অপরিবর্তিত থাকলে তার এবং তার দলের জন্য সুবিধা হবে, যদি তারা ক্ষমতায় ফিরতে পারে। তখন তার প্রয়োজন হবে শুধু সংবিধানের ৭এ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করা, আর তার পর যারা তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে, তাদের শাস্তি দেয়া। এই সরল অথচ গভীর বাস্তবতাটি বিএনপির দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে। তারা বুঝতে পারছেন না, সংবিধান অপরিবর্তিত রাখার কৌশল কাকে সুবিধা দিচ্ছে, আর এই অদৃষ্টিগম্যতা জুলাই সনদের বহু প্রতিশ্রুতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

শেষত, প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধে লেখক অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সংবিধানের ১০৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের মতামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা অনুচ্ছেদ ১০৬ সংক্রান্ত বিতর্কে প্রবেশ করতে চাই না, তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অনুচ্ছেদ ১০৬ এর এই মতামত অন্তর্বর্তী সরকার বৈধতা দিতে পারবে না যদি সরকার স্বতঃসিদ্ধভাবে অবৈধ হয়। এই সরকার যে বৈধ তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর বৈধতা এসেছে জনগণের কর্তৃত্ব থেকে এবং ১০৬ নং অনুচ্ছেদের অধীন আমাদের আপিল বিভাগের মতামতের আশ্রয় নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু, লেখক সরাসরি এই বৈধতা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এর বিপরীতে তিনি লিখেছেন, ‘এই বিষয়ে আমি সরাসরি উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকছি।’ এই দ্বিধা একটি রাজনৈতিক ইঙ্গিত বহন করে, বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন হলে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে, যেমন একসময় আওয়ামী লীগ ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বৈধতা অস্বীকার করেছিল। এই অনুচ্চারিত সম্ভাবনা জুলাই সনদের বাস্তবায়নকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে, যদি রাজনৈতিক দলগুলো নীতির চেয়ে কৌশলকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়।

বিএনপি জুলাই সনদে প্রতিশ্রুত সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়নে দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। দলটি বিশ্বাস করে, তারা আগামী সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করবে, আর তারা জানে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে, যা বিএনপি-নেতৃত্বাধীন সরকারকে দুর্বল করতে পারে। অন্য দিকে, জামায়াতের মতো ছোট দলগুলো জানে, পরবর্তী সরকার তারা গঠন করতে পারবে না। তাই তারা চায় জুলাই সনদ অবিলম্বে বাস্তবায়ন হোক, যাতে তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে এবং বিএনপির মতো বড় দলগুলোর দ্বারা উপেক্ষিত না হয়। শেষমেশ, সংস্কারগুলোকে জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পরিবর্তে উভয় দলই নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার দিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

জুলাই বিপ্লব শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নয়, এটি ছিল একটি নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার দাবির বহিঃপ্রকাশ। এ কারণেই আমরা দেখেছি বিভিন্ন কমিশন গঠিত হয়েছে, যারা সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছে। এই প্রস্তাবগুলোর অনেক অংশই জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা আজ জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার দলিল। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব, এই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। অন্যথায়, জনগণের ইচ্ছা বাস্তবায়ন হবে না।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি