এই মানুষের ভিড়ে সেই মানুষ নাই

সাধারণ শিক্ষা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত রেখে সাধারণ শিক্ষা এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োগিক বা বৃত্তিমূলক টেকনিক্যাল শিক্ষার দিকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে ধাবিত করা। শুধু উচ্চ মেধাসম্পন্ন ও গবেষণা ইচ্ছুকরা উচ্চশিক্ষাপর্যায়ে যেতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষা পর্যায়ক্রমে নিরুৎসাহিত করা।

বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৫৫ হতে চলেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন শিল্প উদ্যোগে ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এর অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। দেশটি কৃষি ও ট্রেডিংনির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে অগ্রসরমান। বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ একটি দেশ। সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই দেশের কর্মক্ষম জনগণকে কর্মকুশল দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার অনিবার্যতা এখন চরমে। কেননা, ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ সৃজনশীল কর্মক্ষম জনসমষ্টির আওতায় চলে এসেছে, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নামে পরিচিত। সনাতন শর্তানুযায়ী ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড মূলত তিন দশক পর্যন্ত সৃজনশীল এবং উন্নয়ন অভিসারী অভিযাত্রায় থাকে। ইতোমধ্যে তার এক দশকের বেশি সময় চলে গেছে, সামনে আরো দেড় দুই দশক বাকি আছে। এই সময়ের মধ্যে বিদ্যমান কর্মোপযোগীদের উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করতে না পারলে বা তাদের উপযুক্ত কর্ম সম্পাদনে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে কিংবা তাদের জন্য উপযুক্ত কাজ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে তারা অলসতায় শয়তানের কর্মশালায় যোগ দিতে পারে কিংবা অকর্মন্যতায় হতাশায় নিমজ্জিত হতে পারে। তেমনটা ঘটলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। কেননা, সমাজে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেলে উৎপাদনশীলতায় বা জিডিপিতে তাদের অবদান বঞ্চিত হয় দেশ এবং তারা নিজেরাই নিজেদের, পরিবারের ও দেশের জন্য বোঝা বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে জাতির জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর সময় এবং এর জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হবে বিশেষ মাশুল। গত ৫৪ বছরে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগণকে বিশেষ করে যুবসমাজকে যথাযথভাবে দক্ষ জনসম্পদ বা প্রশিক্ষিত লোকবল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি। যে জন্য এ দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক আর বিদেশের দক্ষ জনবল এ দেশের মধ্য ও উচ্চতর পদগুলোতে বেশি বেতনে নিয়োজিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় সমাপনকারী ডিগ্রিধারী শিক্ষিতের সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা দেশের উদীয়মান শিল্পে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগযোগ্য না। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের সেই বিখ্যাত চরণের মতো, ডধঃবৎ ধিঃবৎ বাবৎুযিবৎব হড়ৎ ধহু ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ.

বিভিন্ন পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশী তরুণ উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের অভাব, পুঁজির অপ্রতুলতা, ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বলতা, প্রায়োগিক জ্ঞানের নিম্নগামিতা, প্রশিক্ষণ এবং অধিক শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহের অভাব, সৃজনশীল পৃষ্ঠপোষকতাদানের ঘাটতি বা কমতি রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য উঠতি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কিংবা অধিকতর যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো উপযুক্ত ও দক্ষ জনবলের যেমন প্রয়োজন তেমনি টেকসই ও লাগসই প্রযুক্তির প্রয়োগ ও সমন্বয়ে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তার সাথে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকুশলতা। এই প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকপর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডে যেসব নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে, সেগুলোর মোকাবেলায় পর্যাপ্ত ও উপযুক্ত লোকবলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। চলতি সহস্রাব্দের শুরু থেকে বলতে গেলে বিশেষ করে মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়ন যখন শুরু হয় তখন থেকে বাংলাদেশে দক্ষ জনবল বা মানবসম্পদ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভ‚ত হয়ে নানা উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। দাতাসংস্থার পরামর্শ ও অর্থায়নে ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংস্থা, প্রকল্প, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গৃহীত হলেও দৃশ্যমান দক্ষ জনবল সেভাবে যে গড়ে ওঠেনি তা বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশে কর্মসৃজন, বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠানোর এবং এ দেশে বিদেশীদের নিয়োগসংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে প্রতিভাত। বিগত দেড় দশকে বরং দেখা গেছে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ঊর্ধ্ব ও মধ্যমপর্যায়ের ব্যবস্থাপক, পরামর্শক, সংগঠন ও কর্মীরা এসে বাংলাদেশে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন আর্থিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত হয়েছে। ফলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিদেশী পরামর্শকরা নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের উল্লেøখযোগ্য অঙ্কের অর্থ। অন্য দিকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণের মাত্রা বেড়েছে। যদিও এই দেড় দশকে দেশে পরীক্ষায় পাসনির্ভর প্রচুর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে বা শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে কিন্তু উঠতি বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মতো পর্যাপ্ত ও কার্যকর জ্ঞান দিয়ে তাদের প্রস্তুত করা যায়নি এ কারণে যে, তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর কর্মীদের তুলনায় চটপটে, পটু, প্রায়োগিক জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া থেকে পেছনে রয়েছে। এরূপ অদক্ষ, অর্ধশিক্ষিত জনসম্পদ বছর বছর তাদের চাকরির বয়স খুইয়ে স্থায়ী বেকারে পরিণত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সেখানে উপযুক্ত দেশীয় লোকবল সংস্থান করা যাচ্ছে না, বিদেশীদের দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প অত্যন্ত সম্ভাবনাময় শ্রমিকনির্ভর শিল্প। সেখানে মধ্যমপর্যায়ের অধিকাংশ ব্যবস্থাপক, পরিচালক, নকশাকার বিদেশীরা। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, গার্মেন্টের বায়াররা প্রতিবেশী দেশে (যারা আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের প্রতিদ্ব›দ্বী) বসে সে দেশের লোক নিয়োগ না করলে আমাদের বাজার হারাতে হবে- এমন একটি অঘোষিত হুমকি রয়েছে। এর ফলে দেশী শিক্ষিত বেকারকে কর্মসংস্থানের চাহিদার কারণে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং চাকরি না পেয়ে বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণরা হতাশায় নিমজ্জিত। সা¤প্রতিককালে কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সেই হতাশার বেদনা বাঙময় হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। একই সময়ে দেশের টেকনিক্যাল শিক্ষার পরিবর্তে সাধারণ শিক্ষার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকায় দক্ষ জনবল সরবরাহের পরিস্থিতি এমন নেতিবাচক পর্যায়ে যাচ্ছে যে, দীর্ঘমেয়াদে তাতে এক করুণ ও আত্মঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আশঙ্কা প্রকাশ পাচ্ছে, ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড ডেমোগ্রাফিক ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। জনসম্পদ উন্নয়নে বিদ্যমান এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং উন্নতপর্যায়ে উত্তরণ শুধু জরুরি নয়, অনিবার্যও বটে। এখনই যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকপর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হয় তাহলেও আগামী ১৫ বছরের আগে সেই দক্ষ জনবলের সাক্ষাৎ মিলবে না। তত দিনে বর্তমানে বিদ্যমান বেকার ও অদক্ষ শিক্ষিত জনসম্পদ ওপরে ও নিচের জন্য জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকবে। ব্যবস্থাপনা ও তত্ত¡াবধান পর্যায়ে বিদেশীদের নিয়োগ অব্যাহত থাকলে বা রাখলে দেশের চাকরি বাজার দেশীয়দের জন্য আরো অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এহেন পরিস্থিতি থেকে কার্যকরভাবে পরিত্রাণ পেতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। গালভরা শব্দমাখা, দেশী-বিদেশী কনসালট্যান্ট ও বিদেশী সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের মাধ্যমে অনুসন্ধান পরীক্ষা পর্যালোচনার পথে থেকেও একটি আত্মনির্ভরশীল পরিস্থিতি সৃজনে নিজেদের ভাবনায় বা উদ্যোগে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-

১. দেশের শিক্ষিত জনবলকে দেশে নিয়োগ বা আত্তীকরণ নিশ্চিত করা। বাইরের বায়ারের চাপে কিংবা বাইরের কর্মীদের স্মার্টনেসের যুক্তিতে তাদের নিয়োগ করা থেকে বিরত থেকে দেশীয়দের নিয়োগে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তথা চাহিদা সৃষ্টি করা। নিজেরা যদি নিজেদের লোকবল নিয়োগের সুযোগ না রাখি বা পদ সৃষ্টি না করি তাহলে দেশীয়দের চাহিদা ও দক্ষ জনবল সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না। দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে।

২. পেশাজীবী ও শিল্পগোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী লোকবল তৈরির জন্য বিশেষায়িত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন। ইতোমধ্যে বিজিএমইএসহ কয়েকটি সংস্থা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট গড়ে তুলছে। কিন্তু সেসবের বাস্তবায়ন বড্ড ধীরগতিসম্পন্ন এবং সেখানে অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ লোকবল তৈরির কাজ এখনো শুরু হয়নি, শুরু হলেও মানসম্মত ফলাফল পেতে দেরি হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, সময় কারো জন্য বসে থাকে না।

৩. বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা এই মুহূর্তে পড়াশোনা করছে তাদের ভাষা ও টেকনিক্যাল জ্ঞান, তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ভাবনা গতানুগতিক অবয়বে না রেখে তাদের জন্য নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি বিশেষ ব্যবস্থায় ভাষা চর্চা ও প্রয়োগিক দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তা না হলে শিক্ষার্থীরা অদক্ষ অবস্থায়ই শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে।

৪. অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোর পথ পরিহার করে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে হবে। দেশে দক্ষ জনবল সৃষ্টির জন্য আলাদাভাবে বিশেষ তহবিল গঠন করে বিশেষ কার্যক্রম/উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বিদ্যমান সব বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকৃতপক্ষে কী শেখানো হচ্ছে তা কঠোর তদারকিতে এনে সেখানে গুণগত শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

৫. বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠাতে পারলে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। দেশে দক্ষ জনবল পাওয়া গেলে, বিদেশীদের নিয়োগ বন্ধ হলে বিদেশী মুদ্রার ব্যাপক সাশ্রয় ঘটবে। সরকারকে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এই লাভ-লোকসানের সমীকরণটি যথা-বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি মনোযোগী এবং সেখানে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গুণগত মান বজায় রাখার ব্যাপারে কড়া তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সুলভ করতে কর রেয়াত কিংবা প্রণোদনা দেয়া যুক্তিযুক্ত হবে।

৬. সাধারণ শিক্ষা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত রেখে সাধারণ শিক্ষা এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োগিক বা বৃত্তিমূলক টেকনিক্যাল শিক্ষার দিকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে ধাবিত করা। শুধু উচ্চ মেধাসম্পন্ন ও গবেষণা ইচ্ছুকরা উচ্চশিক্ষাপর্যায়ে যেতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষা পর্যায়ক্রমে নিরুৎসাহিত করা।

লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান