আরাকান আর্মি (এএ) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সক্রিয় জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন। এর লক্ষ্য রাখাইন জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা এবং তাদের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তার মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সেনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কার্যক্রম, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার পরিস্থিতি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সামরিক শাসক শ্রেণী একে অপরের বিপরীতে অবস্থান করছে। সামরিকজান্তা আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।
সহিংসতা ও সঙ্ঘাত : ২০১৯ সাল থেকে আরাকান আর্মি এবং সামরিকজান্তার মধ্যে সঙ্ঘাত ব্যাপকতা পায়। এই সঙ্ঘাতে রাখাইনে মানবিক সঙ্কট বেড়েছে।
সামরিক দক্ষতা : আরাকান আর্মি একটি শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। তাদের সংগঠন ও প্রশিক্ষণ মিয়ানমারের অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত। আরাকান আর্মি বর্তমানে রাখাইনের বেশির ভাগ জায়গা নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তারা মংডু শহর দখল করে, যা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নিয়ে আসে। এটি সামরিকজান্তার একটি বড় পরাজয়। এএ বর্তমানে রাখাইনের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১১টির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যার আওতায় রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি এলাকা। এর ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। তাদের সামরিক কৌশল, প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে তারা তাতমাদাওয়ের (মিয়ানমার সামরিক বাহিনী) জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের জন্য এএ’র এই নিয়ন্ত্রণ সীমান্ত নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ। শরণার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।
প্রশাসনিক কার্যক্রম : আরাকান আর্মি শুধু সামরিক নিয়ন্ত্রণই নয়, অনেক এলাকায় বিকল্প প্রশাসনিক কাঠামোও প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা স্থানীয় কর আদায়, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করছে।
জনসমর্থন : রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরাকান আর্মির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। তারা নিজেদেরকে রাখাইন জনগণের স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাখাইন জনগোষ্ঠী তাদের রসদ সরবরাহ ও তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করে।
তাতমাদাওয়ের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাত : সামরিকজান্তার সাথে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ নিয়মিত ঘটনা। তবে ২০২২ সালের শেষ দিকে কিছু সময়ের জন্য উভয়ের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। এরপর সঙ্ঘাত আবার বেড়েছে।
অর্থনীতি ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণ : আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে জেড (লধফব), কাঠ এবং সমুদ্রভিত্তিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই সম্পদ তাদের সামরিক কার্যক্রম ও প্রশাসনিক কাঠামো চালাতে সহায়তা করে।
সংগঠন ও নেতৃত্ব : তাদের একটি সুশৃঙ্খল কমান্ড কাঠামো রয়েছে। নেতৃত্ব এবং যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে আরাকান আর্মি সুসংগঠিত, যা তাদের কার্যক্রমে সমন্বয় বজায় রাখতে সহায়ক।
ভূগোলের সুবিধা : রাখাইন রাজ্যের পাহাড়ি ও দুর্গম অঞ্চলগুলোতে তাদের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। এই ভূখণ্ডে তারা সহজেই আত্মগোপন করতে পারে এবং প্রতিপক্ষের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালাতে সক্ষম।
টেকনোলজি ও যোগাযোগ : আরাকান আর্মি উন্নত প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয়, যা জনসমর্থন জোগাড় করতে সাহায্য করে।
চ্যালেঞ্জ এবং প্রভাব
আঞ্চলিক নিরাপত্তা সঙ্কট : তাদের কার্যক্রম সীমান্তবর্তী দেশগুলোর (বিশেষ করে বাংলাদেশের) নিরাপত্তা পরিস্থিতি জটিল করছে।
সহযোগী গোষ্ঠী : আরাকান আর্মি অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে মৈত্রী স্থাপন করেছে, যা তাদের সামরিক কার্যক্রম আরো শক্তিশালী করে।
বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক
সীমান্ত অঞ্চলের পরিস্থিতি : রাখাইন রাজ্যের সঙ্ঘাত বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি প্রভাবিত করে। আরাকান আর্মি ও তাতমাদাওয়ের মধ্যে সঙ্ঘাতের কারণে অনেক শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট : রাখাইন রাজ্যের সঙ্ঘাত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে বর্তমানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছেন।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া : বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সাথে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করছে। তবে সীমান্তে আরাকান আর্মি ও তাতমাদাওয়ের সঙ্ঘাত বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) ও স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
আরাকান আর্মি ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সম্পর্ক : আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নজর কেড়েছে। বিশেষ করে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় শক্তিগুলো রাখাইন রাজ্যের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কার্যক্রমের ওপর সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্রভাব রাখছে।
চীনের সাথে সম্পর্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ
রাখাইন রাজ্য চীনের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানেই ‘চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর প্রকল্পের প্রধান অংশ অবস্থিত। কিউকফিউ (কুধঁশঢ়ুঁ) গভীর সমুদ্রবন্দর এবং চীন-মিয়ানমার পাইপলাইন প্রকল্প চীনের জন্য অর্থনৈতিক ও জ্বালানি নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান অংশ।
চীনের ভূমিকা : চীন সরাসরি আরাকান আর্মিকে সমর্থন করার বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন পরোক্ষভাবে এএ’র সাথে যোগাযোগ রাখে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখার জন্য চীন উভয়ের সাথেই সম্পর্ক রাখে। চীন চায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে, যাতে তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (ইজও) প্রকল্প বাধাগ্রস্ত না হয়।
২০২১ সালে সামরিকজান্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে চীন বেশ কয়েকবার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে।
ভারতের সাথে সম্পর্ক
ভারত ‘কালাদান মাল্টিমডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প’-এর মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যের সিত্তে বন্দরকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করছে। রাখাইনে অস্থিতিশীলতা ভারতের এই বড় প্রকল্পের জন্য হুমকি হতে পারে। ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও, মাঠপর্যায়ে কিছুটা কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখছে। মিয়ানমারের সামরিকজান্তাকে সমর্থন দিলেও ভারত রাখাইন অঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করছে।
সম্ভাব্য সংযোগ : ভারতের কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এএ সরাসরি নয়; বরং বিভিন্ন চোরাচালান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভারতীয় অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম পেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলোর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র আরাকান আর্মিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেয় না, তবে তারা রাখাইন রাজ্যের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সামরিকজান্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখে। কিছু গবেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র আরাকান আর্মিকে সরাসরি সহায়তা না দিলেও মিয়ানমারের সামরিকজান্তাকে দুর্বল করার জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমের প্রতি নীরব সমর্থন দেখাতে পারে।
সম্ভাব্য সংযোগ : আমেরিকার কিছু থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং মানবাধিকার সংস্থা রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করছে, যা এএ’র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। কিছু প্রতিবেদন ইঙ্গিত দেয়, পশ্চিমা দেশগুলো আরাকান আর্মির মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে কৌশলগত আলোচনায় প্রস্তুত থাকতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য করণীয়
কৌশলগত নিরপেক্ষতা বজায় রাখা : বাংলাদেশকে সরাসরি কোনো পক্ষের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন না দিয়ে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। চীন, ভারত, আসিয়ান (অঝঊঅঘ) ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় রেখে নীতি গ্রহণ করা জরুরি।
কূটনৈতিক সম্পর্ক গঠন ও পর্যবেক্ষণ : বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আরাকান আর্মির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিতে হবে। সম্ভাব্য আলোচনার জন্য ব্যাক-চ্যানেল কূটনীতি ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে রাখাইনের স্থিতিশীলতা ও রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংলাপ হতে পারে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ : আরাকান আর্মির প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা যাচাই করা এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল নিশ্চিত করা সম্ভব কি-না, তা পর্যালোচনা করা উচিত।
অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা পরিকল্পনা : রাখাইনে সঙ্ঘাত বাড়লে নতুন করে শরণার্থী সঙ্কট তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সীমান্ত অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প ও মানবিক সহায়তা বাড়ানোর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশের উচিত সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষা, কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকার দিয়ে আরাকান আর্মির সাথে সম্পর্ক নির্ধারণ করা। কৌশলগত সচেতনতা ও বিচক্ষণ কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি থেকে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক সুবিধা পেতে পারে।
লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি,
নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি



