বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ও কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা

ত্রিশের দশকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দার সময় পুঁজিবাদী দেশগুলো তীব্র সঙ্কটে পড়ে। উৎপাদন ঘাটতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বেকারত্ব মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আর এ সময় সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল।

এটি সর্বজনবিদিত সত্য যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে জনগণের অভিপ্রায় হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা বলা হয়েছিল। মূলত এ তিনটি বিষয় রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে থাকার কথা ছিল; কিন্তু তৎকালীন সরকার তা বিস্মৃত হয়ে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপর চারটি বিষয় তথা- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে নির্ধারণ করে। মজার বিষয় হলো- এ মূলনীতিগুলো ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্নভাবে অপব্যবহার করা হয়। জাতীয়তাবাদ বলে ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ বুঝানো হয়েছিল এবং রাষ্ট্রের সব নাগরিক ‘বাঙালি’ বলে পরিচিত হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এর দ্বারা দেশে যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ছিল তাদের স্বকীয়তা অস্বীকার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান চাকমাদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার উপদেশ দেন, যা ছিল সম্পূর্ণভাবে অবিবেচনাপ্রসূত।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রের যাত্রা হয়েছিল সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কবর দিয়ে একদলীয় বাকশাল প্রবর্তন করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলাম ও ইসলামী দল ও প্রতিষ্ঠানের ওপর খড়গ চাপানো হয়। ধর্মহীনতা তথা ইসলাম নির্মূলের সংস্কৃতি চালু করা হয়। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। কথিত আছে- সে সময়ে বামপন্থী সর্বহারা পার্টি ও জাসদের ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। সমাজতন্ত্রের নামে সব শিল্প-কারখানা, ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ করা হলে দেখা দেয় নৈরাজ্য ও অরাজকতা। আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের কারখানাগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে তা লুটপাটের মহোৎসবে পরিণত হয়। শিল্প উৎপাদন ভেঙে পড়ে। প্রফেসর এমাজউদ্দীনের ভাষ্যমতে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিল্প-কারখানাগুলো আর পুনরায় পাকিস্তান আমলের উৎপাদন সক্ষমতায় ফিরে যেতে পারেনি। শেখ মুজিব সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিলেন রাজনৈতিক ফ্যান্টাসি বা আবেগের বসে; কিন্তু এ জন্য তার না ছিল প্রশিক্ষিত জনবল আর না ছিল সুষ্ঠু পরিকল্পনা। লুটপাট আর অব্যবস্থাপনায় দেশের অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়েছিল।

১৯৭৪ সালে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মারা যান। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায় আকাশচুম্বী। নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়। ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হলে চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় মৌলিক কিছু পরিবর্তন আনেন। প্রথমত, জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাগরিকদের বাঙালির পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী’ বলে সাংবিধানিক পরিচয় দেন। তিনি বাকশালের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন করেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘আল্লাহের উপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা’ প্রতিস্থাপন করেন। তিনি সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ‘সামাজিক সুবিচার অর্থে সমাজতন্ত্র’ প্রতিস্থাপন করেন।

জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি দেশের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। তিনি জাতীয়করণ প্রথা বাতিল করে বেসরকারি খাত উৎসাহিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার সময় দেশে গার্মেন্ট-শিল্পের সূচনা হয়। তিনি মানবসম্পদ রফতানির উদ্যোগ নেন। এর পর থেকে দেশ মূলত বাজার তথা পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিকে ধাবিত হয়। জেনারেল এরশাদ একই নীতি অনুসরণ করেন। এরপর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার জিয়ার অনুসৃত পথে হাঁটতে থাকে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে বাকশালের পথে না হেঁটে পুঁজিবাদী অর্থনীতি অব্যাহত রাখে। ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে ষোলকলায় পরিণত করে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে শোষণ, বৈষম্য, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি একপ্রকার দেউলিয়া করে ফেলে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে নিঃশেষ করার চেষ্টা চলে। পুরো রাষ্ট্রকে একটি পুলিশি রাষ্ট্র তথা ফ্যাসিবাদী চরিত্রে রূপদান করা হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছিল আকাশচুম্বী। বেকারত্ব ছিল ভয়াবহ। যুবসমাজ ছিল হতাশাগ্রস্ত। বিদেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। ফলে মেধা পাচার হতে থাকে। অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। কয়েক হাজার লোক একেকজন হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যায়। সরকারদলীয় চাটুকারদের হাতে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও লুটপাট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। একশ্রেণীর ব্যবসায়ী রাতারাতি রাজনীতিকে পরিণত হয়ে সরকারি নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে থাকে। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৗমত্ব প্রতিবেশী ভারতের কাছে বন্ধক দেয়া হয়। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে ভারতের পদলেহী নীতি অনুসরণ করা হতে থাকে। এরূপ গুমোট পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশের তরুণসমাজের নেতৃত্বে ঘটে একটি বিপ্লব। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে শেখ হাসিনা ও তার সরকার পালিয়ে যায় সেই ভারতে, যার ওপর নির্ভর করে তারা এতদিন ক্ষমতায় টিকে ছিল। বারবার প্রহসনের নির্বাচন করে পুরো জাতিকে বোকা বানাতে চেষ্টা করা হয়েছিল। নির্বাচনকে একটি তামাশায় পরিণত করা হয়েছিল।

অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এখন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ : ঘাতকদের বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচন। রাষ্ট্র সংস্কারে প্রথমে আসে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি কী হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের তিন মূলনীতি তথা- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার। বামপন্থী ও সেক্যুলার শক্তি মুজিব আমলের চার মূলনীতি বহাল রাখার পক্ষে। অর্থাৎ তারা সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখতে চায়। গণতন্ত্র নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সমাজতন্ত্র একটি পরিত্যক্ত মতবাদ। এ নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই। দেশের বামপন্থী রাজনীতির দৈন্যদশা দেখলে তা আর বুঝতে অসুবিধা হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী নীতি অব্যাহত থাকবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তবাজার বা পুঁজিবাদী অর্থনীতি এ পর্যন্ত দেশের জনগণকে কতটুকু দিতে পেরেছে।

এটি সুস্পষ্ট যে, মুক্তবাজার অর্থনীতি দেশে একটি বৈষম্যমূলক সমাজ গড়ে তুলেছে। একটি গোষ্ঠী রাতারাতি ধনিক-বণিক শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। তারা অনৈতিক পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাটে ফোকলা হয়ে গেছে। বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করেছে। বিদেশী ঋণের বোঝা জাতিকে ন্যুব্জ করে ফেলেছে। অপব্যয় ও দুর্নীতি সরকারি অফিসে নিয়মে পরিণত হয়েছে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে এখনো লাখ লাখ মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে। চুরি, ডাকতি, রাহাজানি, নিরাপত্তাহীনতায় নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। পতিত সরকারের আমলে সর্বক্ষেত্রে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল তা এখন আরেকটি দলের হাত দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। জনগণ ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

অন্তর্বর্তী সরকার সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু একটি শক্তিশালী নির্বাচিত সরকার ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা এত সহজ নয়। আবার এটিও সত্য যে, নির্বাচিত সরকার হলেই যেসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, সেটি মনে করারও কারণ নেই। পুঁজিবাদী অর্থনীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আমাদের সমাজ যেভাবে বিপর্যস্ত, যদি নির্বাচিত সরকারের সততা, আমানতদারিতা, নৈতিকতা ও দক্ষতা না থাকে তাহলে তারাও সফল হতে পারবে না। সুতরাং এটি স্বতঃসিদ্ধ যে, সুশাসনের প্রত্যয়, সততা ও দক্ষতাসম্পন্ন একটি নির্বাচিত সরকার পারবে পাহাড়সম সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে।

আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অভিশাপ দেখেছি। তা থেকে পরিত্রাণে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু রেখেছি। তার ফলে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? পাকিস্তান আমলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফলে ২২টি ধনী পরিবারের উত্থান ঘটেছিল।

শাসকগোষ্ঠী ও ২২টি করপোরেট শিল্পগোষ্ঠী দেশকে শোষণ করেছিল। অধিকন্তু, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা বলা হয়েছিল; কিন্তু অতীত সরকারগুলো এসব নীতি বাস্তবায়নে তেমন মনোযোগী হয়নি। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে ৫৩ বছর পরও বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতনে পিষ্ট মানুষ নিজেদের মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে দেখছে।

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় এবং ১৯৪৯ সালে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে। তখন বিশ্বের বহু দেশ সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সমাজান্ত্রিক রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাথে জার্মানবিরোধী জোটে থাকলেও যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে মতবিরোধ দেখা দেয়। সেটি ছিল আদর্শিক বিরোধ। রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ততদিনে পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ তথা ব্রিটেন, ফ্রান্স ছিল সমাজতন্ত্রবিরোধী। এসব দেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সুতরাং সমাজতন্ত্র তথা কমিউনিস্ট ঠেকানোর কৌশল গ্রহণ করে। বলা বাহুল্য, পুঁজিবাদী অর্থনীতির দ্বারা শোষিত হয়ে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো ক্লাসিক্যাল পুঁজিবাদী নীতির সংস্কারে উদ্যোগ নেয় এবং তার ফলে ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের’ ধারণার উদ্ভব ঘটে। বিশেষ করে সুইডেন, হল্যান্ড ও নরওয়ে তথা নরডিক কান্ট্রিগুলোতে এ ধারণা জনপ্রিয়তা পায়।

ত্রিশের দশকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দার সময় পুঁজিবাদী দেশগুলো তীব্র সঙ্কটে পড়ে। উৎপাদন ঘাটতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বেকারত্ব মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আর এ সময় সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল।

তখন অর্থনীতিবিদ কিনস যুক্তি প্রদর্শন করেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি সবসময় পূর্ণ কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে না। এ ধরনের অর্থনৈতিক অবস্থা দীর্ঘ সময়ে অর্থনৈতিক মন্দার খানাখন্দে পড়ে থাকতে পারে। মন্দার কবলে পতিত অর্থনীতি একসময়ে আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমৃদ্ধির যুগে ফিরে আসবে- এ ধরনের বিশ্বাস একটি চরম ভ্রান্তিবিলাস ছাড়া আর কিছু নয়।’ এ পেক্ষাপটে মন্দা থেকে উত্তরণে কিনস অর্থনীতিতে সরকারকে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানান। কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা এখান থেকে শুরু। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে তাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। প্রধানত নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও ন্যূনতম চাহিদা পূরণের প্রতি মনোযোগী হয়। এ জন্য দেখা যায়, ইউরোপীয় দেশগুলো যথেষ্ট কর্মসংস্থান করতে না পেরে বেকারভাতা দেয়া শুরু করে, যা এখনো বহু দেশে অব্যাহত আছে। ইসলামী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর উমার চাপড়া মনে করেন, কিনসীয় কৌশল উভয় সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। এ অর্থনৈতিক কৌশল এক দিকে দারিদ্র্যদূরীকরণ, ন্যূনতম চাহিদাপূরণ, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করতে পারেনি; অপর দিকে সম্পদ ও আয়ের বিশাল বৈষম্য হ্রাসেরও কোনো পন্থা উদ্ভাবন করতে পারেনি। অবশ্য সমাজতন্ত্রের অপ্রতিরোধ্য অগ্রসরতায় এ লক্ষ্যগুলো কালক্রমে বুদ্ধিবৃত্তিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে, এখান থেকে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার জন্ম হয়েছে।

কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, পুঁজিবাদী বিশ্বে কল্যাণ রাষ্ট্রের আবির্ভাব একটি ইতিবাচক ও শুভ ঘটনা। তারা মনে করেন, কল্যাণ রাষ্ট্রের আশু লক্ষ্য পুঁজিবাদের অতিরিক্ত কুফলগুলো প্রশমিত করে সমাজতন্ত্রের আবেদন হ্রাস করা। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ, শ্রমিক, পুঁজিপতি নির্বিশেষে সবাই এ ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। তবে এর সমালোচকরা মনে করেন, কল্যাণ রাষ্ট্র হচ্ছে শাসকশ্রেণীর কাছ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষের কাছে ক্ষমতার হাতবদল না ঘটিয়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে একটি সামাজিক ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি। বস্তুতপক্ষে, মানুষের দারিদ্র্য ও স্বীয় প্রয়োজন পূরণের অক্ষমতা শুধু ব্যক্তি-মানুষের নিজস্ব ব্যর্থতা নয়; বরং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফল। তাই সীমিত সামর্থ্যরে মানুষকে আধুনিক সমাজে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ন, যোগাযোগ প্রভৃতি সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দ্বার উন্মোচন করা এবং শিল্পদুর্ঘটনা, অঙ্গহানি ও বেকারত্বের মতো সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে তাদের সামাজিক প্রতিরক্ষা প্রয়োজন। এরূপ ধারণা থেকে কল্যাণ রাষ্ট্রের দর্শন রাষ্ট্রীয় নীতিমালার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং সম্পদ ও আয়ের সুষম বণ্টনকে নির্ধারণ করেছে।

বাংলাদেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুসরণে দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, অবকাঠামোর উন্নতি ঘটেছে, বেশ কিছু লোক ধনী হয়েছেন। অপর দিকে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, দুর্নীতি তীব্র আকার ধারণ করেছে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি বা বৈষম্য বহুগুণ বেড়েছে। কল্যাণ রাষ্ট্রের আদলে সামজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর নামে বহু প্রকল্প নেয়া হলেও এখনো লাখো-কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। সুতরাং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী- আগামী সপ্তাহে তা নিয়ে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব