রাজনীতিতে আদর্শের গুরুত্ব

আজকের গণতন্ত্র, সংবিধান, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন- এসবের সাথে ইসলামী রাজনৈতিক তত্তে¡র সমন্বয় সবসময় সহজ নয়। বাস্তবে সামঞ্জস্য আনতে সংস্কার প্রয়োজন। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতিতে ইসলামী আদর্শ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সহনশীলতা ও বহুত্ববাদও রক্ষা করতে হবে। ইসলামী অর্থনীতি, কল্যাণনীতি বা আইনি কাঠামো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষ প্রতিষ্ঠান, সুশাসন এবং প্রশাসনিক কাঠামো- যা সবসময় পর্যাপ্ত নয়

সুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে নৈতিক আদর্শ অপরিহার্য। ন্যায়বিচার, সুশাসন, সততা, মানবিকতা ও জবাবদিহিতা- এই মূল্যবোধগুলো ছাড়া জনগণের আস্থা তৈরি হয় না এবং রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তও টেকসই হয় না। আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত রাজনীতি দুর্নীতি কমায়, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করে এবং একটি স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে। দলগুলোর জন্য নৈতিক ভিত্তি বজায় রাখা রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

বাংলাদেশে প্রায় ৯০% মানুষ মুসলমান। ইসলামী মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বহু মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও দৈনন্দিন জীবনের অংশ। এই প্রেক্ষাপটে অনেক গবেষক ও সমাজবিশ্লেষক নিম্নলিখিত কারণগুলো তুলে ধরেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নৈতিকতা, জীবনদর্শন ও সামাজিক আচরণে ইসলামী মূল্যবোধের প্রভাব বেশি। রাষ্ট্রীয় নীতি বা সামাজিক আইনব্যবস্থায় কিছু ইসলামী নীতি প্রতিফলিত হলে জনগণের সাথে সংযোগ ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে পারে।

ইসলামের মূল মূল্যবোধ- ন্যায়, পরোপকার, দুর্নীতিবিরোধিতা, সমতা, মানবাধিকার, জবাবদিহিতা- এসব রাজনীতির জন্যও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ইসলামী আদর্শের কেন্দ্রে রয়েছে- সততা, দুর্নীতি পরিহার, মানবিকতা, দায়িত্ববোধ। এগুলো যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। তাই ইসলামী নৈতিকতা রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তবে সেটা এমনভাবে হতে হবে যাতে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের লোকের অধিকার ক্ষুণ্ণ না হয়। সামাজিক ঐক্য ও পরিচয় গঠনে ইসলাম ভুমিকা রাখে। এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম উপাদান। এ কারণে ইসলামী আদর্শ সামাজিক সংহতি, পারস্পরিক সহমর্মিতা,পরিবার ও সমাজ কাঠামোতে স্থিতি গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে।

প্রশাসন-ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হলো ‘আদল’ বা ন্যায় প্রতিষ্ঠা। এই নীতি আইন ও বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে, বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত করা, ইসলামে বিলম্বিত বিচারকে অন্যায়ের সমতুল্য ধরা হয়। ন্যায় প্রতিষ্ঠার মূল শর্ত হলো- মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, বিচারিক জট কমানো ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় রায় প্রদান। দ্রুত বিচার মানুষের আস্থা বাড়ায় এবং অপরাধ কমায়।

ইসলামী শিক্ষায় দুর্নীতি নৈতিকভাবে ঘৃণ্য কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুষ, কমিশন, দালালি- এসবকে সমাজে অবৈধ ও লজ্জাজনক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। কর্মকর্তাদের জন্য কঠোর জবাবদিহির ব্যবস্থা তৈরি করা যায়। সৎ কর্মীদের উৎসাহিত করা সহজ হয়, কারণ তাদের আদর্শের পেছনে ধর্মীয় ভিত্তি থাকে।

ইসলামী চিন্তায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করা। ইসলাম রাষ্ট্রকে কেবল প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে দেখে না; বরং এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে, যা মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করবে। এ কারণে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল নীতিগুলো আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণার সাথে সরাসরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ইসলামী চিন্তায় রাষ্ট্রের তিনটি মৌলিক দায়িত্ব ব্যাখ্যা করা হলো- দরিদ্র-মিসকিনদের সাহায্য-ইসলামের সামাজিক কাঠামোর কেন্দ্রে রয়েছে দরিদ্র ও দুর্বল মানুষের কল্যাণ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দরিদ্র, এতিম, বিধবা, প্রতিবন্ধী- যারা আত্মনির্ভর হতে পারে না, তাদের জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা তৈরি করা, জাকাত, সদকা, বায়তুলমাল ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য কমানো, কর্মসংস্থান ও স্বনির্ভরতার সুযোগ সৃষ্টি করা। ইসলাম সুনির্দিষ্টভাবে বলে সমাজের দুর্বল মানুষ যেন কখনো উপেক্ষিত না হয়। এটি আধুনিক সামাজিক নিরাপত্তা নেট বা সেফটি নেট প্রোগ্রামের সাথে সম্পূর্ণ মিল রাখে।

ইসলাম এমন একটি রাষ্ট্রের কথা বলে যা জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং মানবিক নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চিন্তা করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব- মানসম্মত ও সবার জন্য উন্মুক্ত শিক্ষা, সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করাএই নীতিগুলো আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক দায়িত্বের সঙ্গেও পুরোপুরি মিলে যায়।

ইসলাম সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। ইসলামী সমাজব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হলো সামাজিক ন্যায় বা সামাজিক সাম্য। ইসলাম ঘোষণা করে, মানুষের মধ্যে মর্যাদা নির্ধারিত হয় শুধু নীতি-নৈতিকতা ও চরিত্রে, জন্ম, বংশ, অর্থ বা জাতিতে নয়। ফলে একটি সমাজকে ন্যায়ভিত্তিক করতে হলে অর্থনৈতিক, আইনি ও সামাজিক এই তিনটি ক্ষেত্রেই সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

অর্থনৈতিক ন্যায় (ধন-সম্পদের সুবিচারপূর্ণ বণ্টন)- ইসলামে ধন-সম্পদকে আল্লাহর আমানত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো তা সমাজের উপকারে ব্যয় করা এবং বৈষম্য কমানো। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ধনী ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান কমানো, জাকাত, সদকা ও বায়তুলমালের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, সম্পদের একচেটিয়া মালিকানা ও শোষণ রোধ করা, উৎপাদন ও বাণিজ্যে নৈতিকতা বজায় রাখা। ইসলামে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর ন্যায়নীতি, পক্ষপাতশূন্যতা, সাক্ষ্যের গুরুত্ব, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান এবং ক্ষমতার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ধনী-দরিদ্র, ক্ষমতাবান-অক্ষম সবাই আইনের কাছে সমান হওয়া- এটাই ইসলামী শাসনের মূলনীতি। এতে সমাজে আইনি নিরাপত্তা, আস্থা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা পায়।

ইসলামী সমাজে ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি হলো মানবিকতা, পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধ, নারী-পুরুষের মর্যাদা, পরিবারব্যবস্থা রক্ষা, শোষণ ও বৈষম্য পরিহার এবং দুর্বলদের প্রতি সহমর্মিতা। এই মূল্যবোধ সমাজে সহনশীলতা, ঐক্য ও সমতা প্রতিষ্ঠা করে। বৈষম্যহীন, মানবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গড়া সম্ভব হয়। মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে বেশির ভাগ নাগরিকের মূল্যবোধ ও সামাজিক আচরণ ইসলামের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই রাজনৈতিক ও সামাজিক নীতিতে ইসলামী আদর্শ সংযোজন জনগণের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে। ইসলাম রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে দেখে না; বরং এটিকে এমন একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে, যা নাগরিকের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক উন্নতির জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করবে। বিশেষ করে দুর্বল, দরিদ্র, অনাথ, নারী, শ্রমজীবী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক নীতি হিসেবে বিবেচিত।

ইসলামী রাজনৈতিক দর্শনে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মৌলিক নীতি হলো ‘শূরা’ বা পরামর্শ। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।’ এটি নির্দেশ করে যে রাষ্ট্র পরিচালনায় একক সিদ্ধান্ত নয়, বরং জ্ঞানী, অভিজ্ঞ ও নৈতিক ব্যক্তিদের আলোচনা ও পরামর্শ গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী চিন্তার এই নীতি আধুনিক গণতন্ত্রের পরামর্শমূলক শাসনব্যবস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

নীতিনির্ধারণে জ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত- আলেম, বুদ্ধিজীবী, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক- এদের সম্মিলিত জ্ঞান রাষ্ট্রকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। ধর্মীয় নৈতিকতা, আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞান, অর্থনৈতিক বাস্তবতা, সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত হয় ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত। রাজনৈতিক ভুল ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধ করা যায় এর মাধ্যমে। সিদ্ধান্ত একক নেতার হাতে সীমাবদ্ধ না থাকায় স্বেচ্ছাচারিতা হয় না। শূরা ব্যবস্থায়- ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য (পযবপশং ধহফ নধষধহপবং) নৈতিক ব্যক্তিদের মতামত নেতাকে সঠিক পথে পরামর্শ দেয়, এতে রাষ্ট্র পরিচালনা আরো স্বচ্ছ হয়।

বাংলাদেশে এমন একটি মডেল কার্যকর হতে পারে যেখানে : ইসলামী নৈতিকতা নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলবে। সংবিধানের অধিকার সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে বজায় থাকবে। উন্নয়ন ও কল্যাণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। রাষ্ট্র ধর্মীয় নয়, নৈতিকতা সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে চলবে। ইসলাম শাসনের ক্ষেত্রে আমানত, জবাবদিহিতা ও ন্যায়পরায়ণতার ওপর জোর দেয়া হয়।

সামাজিক সমস্যার মোকাবিলায় ইসলামী শাসন কার্যকর। পারিবারিক অবক্ষয়, মাদক, অপরাধ ইত্যাদি সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামী শিক্ষা যেমন- আত্মসংযম, দায়িত্ববোধ, পরোপকার, সামাজিক আচরণকে ইতিবাচক দিকে পরিচালিত করতে পারে।

আজকের গণতন্ত্র, সংবিধান, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন- এসবের সাথে ইসলামী রাজনৈতিক তত্তে¡র সমন্বয় সবসময় সহজ নয়। বাস্তবে সামঞ্জস্য আনতে সংস্কার প্রয়োজন। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতিতে ইসলামী আদর্শ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সহনশীলতা ও বহুত্ববাদও রক্ষা করতে হবে। ইসলামী অর্থনীতি, কল্যাণনীতি বা আইনি কাঠামো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষ প্রতিষ্ঠান, সুশাসন এবং প্রশাসনিক কাঠামো- যা সবসময় পর্যাপ্ত নয়।

লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি

[email protected]