দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ২০২৫ সালের ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫ জারি করেছেন। ১৯৯৯ সালের আপিল বিভাগের ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায় থেকে শুরু হওয়া দুই দশকের বেশি সময়ের দীর্ঘ যাত্রায় এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সেই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বছরের পর বছর ধরে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার নির্দেশ দেয়া হলেও পরবর্তী সরকারগুলো কখনো তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করেনি। বর্তমান প্রধান বিচারপতির নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে অবশেষে এ অধ্যাদেশ বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এ নতুন আইনটির লক্ষ্য হলো একটি পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় তৈরির মাধ্যমে বিচার বিভাগকে প্রকৃত প্রশাসনিক স্বাধীনতা প্রদান করা; এ সচিবালয় পদ সৃষ্টি, নিয়োগ দান, ছুটি মঞ্জুর এবং নিম্ন আদালতের তদারকির মতো দায়িত্ব গ্রহণ করবে। সাধারণ নাগরিকদের জন্য এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে আদালতের ওপর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘ দিনের প্রভাবের অবসান ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অনেক বছর ধরে- বিশেষত পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আইন মন্ত্রণালয় বিচারক নিয়োগে হস্তক্ষেপ করেছে। সেই সাথে এমনকি ম্যাজিস্ট্রেটদের জামিন দেয়ার স্বাধীনতাতেও প্রভাব বিস্তার করেছে। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, সাবেক আইনমন্ত্রী কিভাবে ব্যক্তিগত মামলাগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেটদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। গত সাড়ে ১৫ বছরের ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, মৌলিক অধিকার রক্ষা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধে একটি স্বাধীন নিম্ন আদালত কতটা অপরিহার্য। এ প্রবন্ধে আমারা বিশ্লেষণ করব- নতুন অধ্যাদেশটি কী প্রক্রিয়ায় আইন মন্ত্রণালয়ের এই ধরনের একচ্ছত্র প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করতে চাইছে।
নতুন অধ্যাদেশের ধারা ৪-এর উপধারা ২ ও ৪ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের প্রতিষ্ঠার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে, যা পুরো বিচার বিভাগের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক দফতর হিসেবে কাজ করবে। উল্লিখিত উপধারায় আরো বলা আছে, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এই সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, অর্থাৎ- গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত তার কার্যালয় থেকে চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হবে। অধ্যাদেশ জারির এক দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের প্রথম সচিব হিসেবে একজনকে নিয়োগও দেয়া হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, আইনটি সচিবালয়ের কাঠামো সম্পর্কে খুব একটা স্পষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। এখানে মাত্র একজন সচিব ও অনির্দিষ্টসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সাধারণত যে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিবসহ অন্যান্য শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তার প্রয়োজন হয়- সেগুলোর ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। অর্থাৎ- নামে সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও আসলে কোন ধরনের টিম এটি পরিচালনা করবে এবং কতজন কর্মকর্তা নিয়োগ পাবেন- তা অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়নি। অভিজ্ঞ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত সংখ্যা নিয়ে সুস্পষ্ট বিধান না থাকলে সচিবালয় কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে সমস্যায় পড়তে পারে। দেশের হাজার হাজার বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়োগ, পদোন্নতি, ছুটি, শৃঙ্খলা ও অন্যান্য প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত যেখান থেকে পরিচালিত হবে, সেই দফতরের কাঠামো নিয়ে এমন অস্পষ্টতা স্বাভাবিকভাবে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। কমপক্ষে মূল প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ন্যূনতম সংখ্যা ও পদমর্যাদা অধ্যাদেশে নির্দিষ্ট করা উচিত ছিল- যাতে সচিবালয় প্রথম দিন থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ শুরু করতে পারে।
যদিও নতুন অধ্যাদেশটি সচিবালয়ে কতজন কর্মকর্তা নিয়োগ পাবেন সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য দেয়নি, তবু এ দফতরকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তা নিম্ন আদালতকে আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে চূড়ান্তভাবে মুক্ত করতে যথেষ্ট শক্তিশালী। নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরিসংক্রান্ত শর্ত- বিশেষত নিয়োগের শর্তাবলি এখন থেকে সচিবালয় নির্ধারণ করবে।
প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আদালত স্থাপন, অপ্রয়োজনীয় আদালত বন্ধ করা এবং বিচারিক পদ সৃষ্টি বা বিলুপ্ত করার ক্ষমতাও এ সচিবালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- বিচারকদের কর্মজীবন-সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত যেমন- পদোন্নতি, বদলি, ছুটি এবং শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা, এখন থেকে বিচার বিভাগ নিজে নিয়ন্ত্রণ করবে। ঠিক এ ক্ষেত্রগুলোতে আইন মন্ত্রণালয় প্রভাব বিস্তার করত এবং অনেকসময় সরাসরি হস্তক্ষেপও করত। এ ক্ষমতাগুলো সচিবালয়ের হাতে হস্তান্তর করার মাধ্যমে অধ্যাদেশটি নিশ্চিত করতে চায় যে, ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকরা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের চাপের ভয়ে নয়; বরং ন্যায়সঙ্গত ও স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। যদি অধ্যাদেশটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতার পথে একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অধ্যাদেশটিতে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় কমিশন নামে আরো একটি নতুন সংস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কমিশনের উদ্দেশ্য হলো- বিচারবিভাগীয় সংস্কারকে দিকনির্দেশনা দেয়া, বিচার প্রশাসনকে উন্নত করা ও বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো। কিন্তু এর গঠনকাঠামো গভীরভাবে খতিয়ে দেখলে উদ্বেগের বেশ কিছু কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কমিশনটি গঠিত হবে পাঁচজন সদস্যের সমন্বয়ে, যার সভাপতি থাকবেন প্রধান বিচারপতি। বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে অন্য একমাত্র সদস্য হলেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। কিন্তু বাকি তিন সদস্য বিচার বিভাগ থেকে নেয়া হয়নি। তারা হলেন- ১. আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা; ২. জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন এবং ৩. বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল। অর্থাৎ- পাঁচ সদস্যের এ কমিশনে তিনজন নির্বাহী বিভাগের অংশ, অথবা নির্বাহীর সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত। বিচার বিভাগ থেকে প্রতিনিধি মাত্র দু’জন। এর ফলে যে সংস্থা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা ও শক্তিশালী করতে গঠিত, তার ভেতরে নির্বাহী বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এটি কমিশনের উদ্দেশ্য ও বাস্তব কার্যকারিতা- উভয়ই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়।
ফলে কমিশন যেকোনো সুপারিশ বা নীতিগত দিকনির্দেশনা দিলে তা বিচার বিভাগের প্রকৃত প্রয়োজনের চেয়ে নির্বাহী বিভাগের অগ্রাধিকারকে বেশি প্রতিফলিত করতে পারে। কমিশনের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার ভারসাম্য এমনভাবে বিন্যস্ত যে, বিচার বিভাগের প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবেন না; ফলে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নেবে, এটি নিশ্চিত করা তাদের পক্ষে কঠিন হবে। সংক্ষেপে বলা যায়- কমিশনের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমূলক প্রভাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অধ্যাদেশটি নিজের কাঠামোর মধ্যে এমন একটি অন্তর্নিহিত বাধা তৈরি করেছে, যা শেষ পর্যন্ত সেই বিচারিক স্বাধীনতাকে দুর্বল করতে পারে যে, স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দাবি এ অধ্যাদেশ নিজেই করে।
এটিও মনে রাখা জরুরি যে, নতুন আইনটি কেবল একটি অধ্যাদেশ, অর্থাৎ- এটি সাময়িক। নিম্ন আদালতের জন্য যে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তা স্থায়ী হবে কি না, তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, একটি অধ্যাদেশকে পরবর্তী সংসদের প্রথম অধিবেশনে উপস্থাপন করতে হয়। উপস্থাপনের পর সংসদের হাতে থাকে ৩০ দিন- এ সময়ের মধ্যে যদি স্থায়ী আইন পাস না হয়, তবে অধ্যাদেশটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়। অন্যভাবে বললে, এখন পর্যন্ত যা কিছু অর্জিত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সৃষ্টি থেকে শুরু করে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে প্রশাসনিক ক্ষমতা সরিয়ে নেয়া পর্যন্ত, সব বাতিল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
পরিশেষে, অধ্যাদেশটি যত ভালোভাবে প্রণীত হোক না কেন, বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির ওপর। প্রধান বিচারপতিই নতুন সচিবালয়ের নেতৃত্ব দেবেন এবং ফলস্বরূপ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। যদি সেই নেতৃত্ব নীতিগত ও বিচারিক নিরপেক্ষতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তবে সচিবালয়টি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে একটি প্রকৃত সুরক্ষা বেষ্টনী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যদি উল্টোটা ঘটে, অর্থাৎ- ভবিষ্যতে কোনো প্রধান বিচারপতি যদি সরকারের ইচ্ছা পূরণ করতে প্রস্তুত থাকেন, তবে শক্তিশালী অধ্যাদেশটিও বাস্তবে ব্যর্থ হবে। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে প্রকাশ্যে নিজের প্রদত্ত রায় পরিবর্তন করেছিলেন, অন্য দিকে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এমন একটি সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যখন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছিল। যদি একই ধরনের প্রবণতার ব্যক্তিরা সচিবালয়ের প্রধান হন, তবে আইনের সুরক্ষা থাকা সত্তে¡ও নিম্ন আদালত দুর্বল থেকে যাবে। চূড়ান্তভাবে, এই পুরো সংস্কারের সাফল্য কেবল আইনি বিধানের ওপর নয়; বরং নির্দিষ্ট সময়ে বিচার বিভাগের নেতৃত্বদানকারী প্রধান বিচারপতির সততা, স্বাধীনতা ও সাহসিকতার ওপর নির্ভর করবে।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি



