দেশের পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামগুলোতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ শ্রমিকরা। কিন্তু কারো কোনো টনক নড়ছে না। একটি দুর্ঘটনার পর আরেকটি ঘটলে আগেরটি চাপা পড়ে যায়। পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডে যেসব মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন সেগুলো দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু না বলে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলতে হবে। কেননা, এসব মানুষ এমন কিছু কারণে মারা যাচ্ছেন, যে কারণগুলো নতুন নয়, পুরনো। কারণগুলো সংশ্লিষ্টদের জানা এবং আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। এগুলো সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘনের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং প্রতিরোধযোগ্য ছিল। আর তাই এসব হত্যাকাণ্ডের দায় পোশাক কারখানা, গুদাম মালিক কিংবা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে একটি রাসায়নিক গুদাম ও পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের প্রাণ ঝরেছে। প্রশ্ন হলো- এসব মানুষকে কি মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যেত না? গণমাধ্যমের সরেজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ভবনে আগুন লেগেছে সে ভবনে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। একটি জায়গায় পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদাম থাকবে, অথচ সেখানে কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে না তা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? একই সাথে ওই ভবনের ছাদে তালা লাগানো ছিল। ফলে আগুন লাগার সময় কোনো মানুষ ছাদ দিয়ে বের হতে পারেনি। কারখানার নিরাপত্তা ঘাটতিজনিত বিষয়গুলোর সবগুলোই বর্তমানে বিদ্যমান শ্রম আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা ২০১২ সালে তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের সময়ও দেখেছি, সেখানকার কলাপসিবল গেটগুলোতে তালা লাগানো থাকায় শ্রমিকরা বের হতে না পেরে ভেতরেই মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন। কারখানার মালিকরা বারবার এভাবেই শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
পোশাক কারখানা কিংবা রাসায়নিক গুদামের নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা মালিকপক্ষের দায়িত্ব। আবার মালিকপক্ষ তাদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে পালন করে কি-না তা তদারকি করার জন্যও সরকারের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। যেমন- কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতর, বিস্ফোরক অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, রাজউক প্রভৃতি। সরকারের এসব প্রতিষ্ঠান কি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? মিরপুরের কারখানার নিরাপত্তাজনিত ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তো কারখানা বন্ধ করে দেয়ার কথা ছিল! কিন্তু তা করা হয়নি।
রাজধানীর রাসায়নিক গুদাম কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার আলোচনা অনেক পুরনো। প্রকল্প নিলেও তা বাস্তবায়িত হয় না। ফলে ঢাকার এসব রাসায়নিক গুদামকে অনেকে টাইমবোমা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। রাসায়নিক গুদামের এই ভয়ঙ্কর দশা থেকে ঢাকাবাসীকে মুক্তি দিতে হবে। রাসায়নিক কারখানা কিংবা গুদামগুলো ঢাকার বাইরে স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে আর বিলম্ব করা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।
পোশাক কারখানার নিরাপদ কর্মপরিবেশ কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে সত্য; কিন্তু যেসব কারখানায় অনিরাপদ কর্মপরিবেশ বিদ্যমান সেগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি নেই। নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাবজনিত সমস্যার সমাধান কারখানার মালিকদেরই নিশ্চিত করতে হবে। আর এতে তদারকি করবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এটি করতে ব্যর্থ হলে শ্রমিকদের মৃত্যুর দায় তাদের সবাইকেই নিতে হবে।