চলে গেলেন প্রিয় সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন

আলমগীর মহিউদ্দিন ভাইকে দৈনিক নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা স্যার সম্বোধন করতেন। কারণ তিনি ছিলেন সবার শিক্ষকতুল্য।

নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন
নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন |সংগৃহীত

মৃত্যু চোখের সামনের মানুষটিকে মুহূর্তেই চোখের আড়াল করে দেয়। আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি, শোকে কাতর হই। তবে কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা সহজে চোখের আড়াল হতে পারেন না। প্রিয় সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন তাদের একজন। ২৩ আগস্ট পথিবীর অমোঘ নিয়মে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু তার কাজ ও উজ্জ্বল স্মৃতি হৃদয়পটে চির জাগরুক থাকবে।

আলমগীর মহিউদ্দিন ভাইকে দৈনিক নয়া দিগন্তের সাংবাদিকরা স্যার সম্বোধন করতেন। কারণ তিনি ছিলেন সবার শিক্ষকতুল্য। এ ছাড়া সাংবাদিক প্রশিক্ষণে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, রিসোর্স পারসন। তার জানাশোনা, ঘোরাফেরা ও দেখার পরিধি এতটা ব্যাপক ছিল যে, তিনি অনেক কঠিন বিষয়ও নতুন সাংবাদিক বা প্রশিক্ষণরত সাংবাদিকদের জন্য সহজবোধ্য করে তুলে ধরতে পারতেন। নিউজ কি, ফিচার কি, নিউজ রাইটিং, ফিচার রাইটিং, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখার কৌশলগুলো তিনি প্রয়োজনীয় রেফারেন্সসহ অনবদ্য ভাষায় উপস্থাপন করতেন। তার এসব কথা কোনো বইতে পাওয়া যেত না। ফলে সবাই নোট নিতেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার মহান এক শিক্ষক। তাই অনেকেই তারে স্যার ডাকতেন। আমিও তার বাইরে নই। মাঝে মধ্যে ভাইও বলতাম। কারণ পত্রিকার অলিখিত নিয়ম সবাইকে ভাই সংবোধন করা।

বিশে^র এন্তার বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল। তিনি অনেক লেখাপড়া করতেন। ফলে এসব তার আয়ত্তে ছিল। তিনি বহুবার সাংবাদিক হিসেবে বিদেশ সফর করেছেন। ছিলেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। নাটোরের একজন গ্রামের ছেলে সেই সময়ে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে পড়ছেন, এ থেকেই তার মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশনে তিনি দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। বেশ কয়েকটি ইংরেজি বার্তা সংস্থায়ও তিনি কাজ করেন। ফলে ইংরেজিতে সংবাদ, নিবন্ধ, রিপোর্ট লেখা ও সম্পাদনা করা ছিল তার করায়ত্ত।

ভালো ইংরেজি জানার কারণে তিনি ভালো বাংলাও জানতেন। তার লেখা কলামগুলোতে তার ছোঁয়া পাওয়া যায়। তিনি অসম্ভব পড়াশোনা করতেন। ফলে বিভিন্ন সূত্র ও তথ্য খুঁজে পেতে তাকে সমস্যায় পড়তে হতো না। তার লেখায় ও লেকচারে, বক্তৃতায় তার প্রমাণ পাওয়া যেত। আর্থ-সামজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে তার কলাম ছিল গুরুগম্ভীর ও নতুন নতুন তথ্য ও মন্তব্যে সমৃদ্ধ। অন্য অনেকের মতো আমারও ভালো লাগত এসব লেখা ও কলাম।

তিনি ছিলেন নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও বাসসের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য। ২০০৪ সাল থেকে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি নিয়মিত অফিস করতেন। বিভিন্ন বিভাগের কাজের খোঁজ নিতে চলে যেতেন সংশ্লিষ্ট ডেস্কে। অনেক দিন সন্ধ্যায় নিউজ সেকশনে আসতেন। বার্তা সম্পাদক মহোদয় বা সেন্ট্রাল ডেস্কের জন্য তিনি নিয়ে আসতেন কম্পিউটার থেকে ডাউনলোড করা অনেক চাঞ্চল্যকর বা মজার মজার খবর। বলতেন, এটি অনুবাদ করে দিয়ে দেন। এভাবে নয়া দিগন্তে সেন্ট্রাল ডেস্কে রাতের পালাপ্রধান হিসেবে কাজ করার সময় আমাকেও বহু নিউজ দিয়েছেন। আমরা যতœ করে তা ছাপতাম। তিনি খুশি হতেন।

দেখতাম ব্যতিক্রমী খবরের প্রতি তার ঝোঁক বেশি ছিল। তিনি বলতেন, নিয়মিত আইটেমের পাশাপাশি এসব আইটেম পাঠ করা বেশ পছন্দ করেন, বাড়তি কিছু পান। এর পর ধীরে ধীরে বাংলা দৈনিকগুলোতে অড নিউজ ছাপা হতে থাকে। নয়া দিগন্তে চিত্র-বিচিত্র কলামে দীর্ঘ দিন এসব ব্যতিক্রমী খবর শেষ পাতায় ছাপা হয়েছে। এখন শেষ পাতায় উপরের দিকে প্রতিদিন দু’টি করে এই ধরনের নিউজ থাকে। বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্নভাবে তা প্রকাশ করে।

তিনি গ্রাম থেকে উঠে আসা সাংবাদিক ছিলেন। তাই মফস্বল সংবাদ প্রকাশের খুব তাগিদ দিতেন। অনেক সময় স্থানাভাবে তা প্রকাশ করা যেত না। কিন্তু তার তাগিদ ছিল বরাবরই। দৈনিক নয়া দিগন্তে বেশ বড় স্পেস দিয়ে জেলা উপজেলার সংবাদ বা কান্ট্রি নিউজ ছাপা হতো। সেই ধারা এখনো বজায় আছে। এর ফলে নয়া দিগন্ত প্রকাশের শুরু থেকেই ঢাকার বাইরে বড় একটি পাঠকগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। সব শ্রেণীর সব মানুষের প্রিয় পত্রিকা হিসেবে দ্রুতই স্থান করে নেয়। এই ক্ষেত্রে সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিনের অবদান অনস্বীকার্য।

২.

আলমগীর মহিউদ্দিন ১৯৪২ সালের ১ মার্চ নাটোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চাঁচকৈড় নাজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে আলমগীর মহিউদ্দিন দুই মেয়ের বাবা। তার বড় মেয়ে কানাডায় বসবাস করেন। চার বছর আগে তার স্ত্রী মারা গেছেন। আগেই বলেছি, আলমগীর মহিউদ্দিন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নয়া দিগন্তের সম্পাদক ছিলেন। এর আগে তিনি ইংরেজি দৈনিক নিউনেশনের সম্পাদক ছিলেন। তারও আগে তিনি বাংলাদেশ টাইমসের বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

৩.

কে না জানে প্রেস ক্লাব হলো সাংবাদিকদের সেকেন্ড হোম! আলমগীর মহিউদ্দিন ছিলেন প্রেস ক্লাবমুখী সাংবাদিক। দুপুর-বিকেল তো নিয়মিত ক্লাবে থাকতেন। সবার সাথে প্রেস ক্লাবের সাধারণ খাবার খেতেন। কোনো অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে গেলে অবশ্য অন্য কথা। বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত প্রধান অতিথি বা বিশেষ বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দিতেন। তিন মাস আগে থেকে তাকে প্রেস ক্লাবে না দেখে ভাবতে থাকি, বোধ হয় অসুস্থ। ঠিক তাই। শয্যাশায়ী হওয়ার পর আর তিনি প্রেস ক্লাবমুখী হতে পারেননি। তা সম্ভবও ছিল না। নিয়মিত প্রেস ক্লাবে আগত সদস্যরা তাকে মিস করতেন।

গত ৩০ মে বাসায় তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দ্রুত রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুটা সুস্থ হলে কয়েক দিন পর তাকে বাসায় নেয়া হয়। গত সপ্তাহে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আবার একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তিনি নির্বাক ও নিঃসাড় ছিলেন।

তিনি ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত। অসুখের কথা খুব একটা বলতেন না। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের বার্ষিকী ও সঙ্কলনে আলমগীর মহিউদ্দিন ভাইয়ের লেখা থাকত নিয়মিত। আমি নয়া দিগন্তে কাজ করি- এই সুবাদে আমার উপর দায়িত্ব দেয়া হতো তার লেখা সংগ্রহের। তার কাছে গিয়ে লেখা চাইতাম। তিনি হাসিমুখে নতুন লেখা লিখে দিতেন। প্রিন্ট কপি দিতেন তার সহকারীর মাধ্যমে। কখনো বা মেলে। বেশ কয়েক বছর এই দায়িত্ব পালন করেছি, তার লেখা সংগ্রহ করে ছেপেছি এবং ছাপা সঙ্কলন তার হাতে পৌঁছে দিয়েছি। তিনি খুশি হয়েছেন। এভাবে তার সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তা অটুট ছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

তিনি সেরা রিপোর্টার ছিলেন। তাও আবার ইংরেজি কাগজের। তার মুখেই এসব কথা শুনেছি। ফলে দেশের বড় বড় অনেক নেতার সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি তাদের সাথে বহুবার পৃথিবীর নানা দেশ সফর করেছেন। এসব বিবরণ তার কাছে প্রশিক্ষণার্থী সাংবাদিকরা পেতেন বিভিন্ন আলোচনা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে। তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তের বিভিন্ন ঘরোয়া আয়োজনে ও নিয়মিত সভাগুলোতে এসব জ্ঞানগর্ভ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। অভিজ্ঞতার ঝুলি উন্মুক্ত করে দিতেন। আর সবাই শুনে মুগ্ধ হতেন।

অল্প দিনের রোগ ভুগে তিনি মনে হয় দ্রুতই চলে গেলেন। তাকে আরো কিছুকাল পেলে হয়তো আমরা আরো লাভবান হতে পারতাম। আমরা তার রূহের মাগফিরাত কামনা করি। তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাই। আল্লাহ তাদেরকে শোক সহ্য করার ক্ষমতা দিন। আমীন।