দুপুর ১২টায় বাঞ্ছারামপুরের আবদুল বারি বরকন্দাজগঞ্জের বাজারে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যান। ইউনিয়নে কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকে তাকে নেয়া হলো, কমিউনিটির কাউকে পাওয়া গেল না, মাসে মাসে টাকা ও ওষুধ পাওয়ার বরাদ্দ কারা পায় তাদের তালিকা কারো কাছে মেলে না। বারি বরকন্দাজকে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কমপাউন্ডার দেখে বলেন ওনার স্ট্রোক করেছে, তাকে তাড়াতাড়ি ক্লিনিকে নেয়া দরকার। সাড়ে ১২টায় সরকারি ডাক্তার কবিরাজ কাউকে পাওয়া গেল না। তারা দুপুরের খাওয়া খেয়ে গরিবের কসাই ক্লিনিকে বসবেন। রাত ১১টা পর্যন্ত পয়সা কামাবেন।
আবদুল বারি বরকন্দাজ গত ৫-৬ বছরে নিজে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হয়েছেন। গতবার থেকে ট্যাক্স দেয়া শুরু করেছেন। এখন ট্যাক্সের টাকায় পোষা ডাক্তার কেন জনসেবাকে কেনাবেচায় নামলেন। এসব কথা বারি বরকন্দাজের জন্য এখন প্রযোজ্য নয়। তার দরকার তাৎক্ষণিক চিকিৎসা। ইউটিউবে বলছে, স্ট্রোকের রোগীকে সত্বর চিকিৎসা দিতে না পারলে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সামান্য ক্ষতির যখন প্রতিকার পাওয়া মুশকিল তখন বড় ক্ষতি ঠেকাবে কে? ইদানীং সবাই বলাবলি করেন গণতন্ত্রকে ধরো, গণতন্ত্রের পথে ওঠো। আবদুল আলীমের গানের মতো ‘রাস্তায় পাবি যদি তারে নিয়ে চলো মুর্শিদের দরবারে’।
গণতন্ত্রের অবস্থা বারি বরকন্দাজের মতো। ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ এখন তারা তর্কবিতর্কের ফেরে পড়ে গেছে বারি বরকন্দাজ আর গণতন্ত্র। গণতন্ত্র বাঁচলে বারির চিকিৎসা তাৎক্ষণিক ও দায়িত্বশীলতার সাথে মিলবে না বারি নিজে বেঁচেবর্তে গেলে সরকারি চিকিৎসকের সেবা সুযোগ বা মওকা মিলবে? কোনটা আগে? মরে ভূত হয়ে গেলে গণতন্ত্রের মুক্তি মিলবে- বারির সমাধিতে ফুল দেয়ার জন্য? বড় টানাপড়েনে আছে গণতন্ত্রের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। আমরা গণতন্ত্রের শুনানি নিতে পারি। তার আসল অবস্থা কী সে সম্পর্কে সেই বলুক-
‘আমি গণতন্ত্র, এথেন্স ইরান তুরান পার হয়ে সাথী সেলুকাসের সামনে যে ভূখণ্ড দেখেছিলেন মেসিডোনিয়ার মহামতি আলেকজান্ডার সেই দেশে এসেছি বেশ কিছু কাল আগে। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না কাকে সুধাব- কিছুই বুঝতে পারছি না। দিব্যজ্ঞানে বুঝতে পারছি আমাকে নিয়ে ব্যবসা ভালোই জমেছে এখানে, যেমন জমেছিল জুলিয়াস সিজারের রোমে, মার্কোস মহোদয়ের সময়ে ফিলিপিনে, অগাস্টো পিনাচোটের চিলিতে, বলুয়ার্তের পেরেুতে, চচেস্কুর রোমানিয়ায়, গোটাবায়া রাজা পাকসের শ্রীলঙ্কায়।
এ দেশের এক কবি লিখেছিলেন ‘তুমি আসবে বলে স্বাধীনতা শহরের বুকে জলপাই রঙের জিপ এলো, তুমি আসবে বলে হরিদাসীর সিথি সিঁদুর মুছে গেল’, আমার মনে হয় এই কবিকে আমাকে নিয়ে লিখতে বললে তিনি এমন তরো উপমা উৎপ্রেক্ষায় লিখতেন। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ এ ধরনের স্লোগান বুকে পিঠে করে যে সাহসী তরুণ মারা গেলেন সেবার তাকে আমি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। তার বুকে পিঠে লেখা স্লোগানে কথাটি অন্তত ছিল যে গণতন্ত্র মুক্তি পাক-এর অর্থ এটা দাঁড়ায় যে, গণতন্ত্র পরাধীন, শৃঙ্খলিত অপদস্ত অসম্মানিত। কে ধরেছে গণতন্ত্রের এ হাল? সবার সাথে আলাপ করে জানতে পেরেছি স্বার্থবোধ, উৎসারিত দুর্নীতি গণতন্ত্রের বড় শত্রু। একটা জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি, ইন্ধন এবং প্রক্রিয়াকরণ (ফিশ প্রসেসিংয়ের মতো) সেসব সরকার বা দল বা দেশের সাবেক প্রধানদের বিরুদ্ধে সালিসালয়ে মামলা ঠুকে দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে নিখিল বন্য প্রাণী মোর্চা।
গোটা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সমিতিগুলোর ফেডারেশন মনে করে ঘরে ঘরে দুর্নীতির দুর্গ গড়ে তোলা রুখে না দিতে পারলে কোথাও পরিত্রাণ মিলবে না। মাথামোটা এক বিশ্লেষক বললেন সেদিন সম্প্রতি নেপালে যে গণ-অভ্যুত্থান তার মূল কারণ নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধচারিতা নয়- তা ভূরাজনীতির ভায়রা ভাইদের চালবাজি। কাতারে ইসরাইলে আক্রমণের ইনামস্বরূপ ইসরাইলে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অর্ডার পেল যুক্তরাষ্ট্র। কইয়ের তেলে কই ভাজার বিশ্ব রাজনীতিতে পলিটিক্যাাল ব্রাইবিংয়ের এতবড় উদাহরণ থেকে আমার ভূত ভবিষ্যৎ সবাই সম্যক উপলব্ধি করবেন আশা করি। আমাকে ফেরানো বা প্রতিষ্ঠার জন্য গণ-অভ্যুত্থানকেও ফেল মারাবার তালে সবাই, মতানৈক্যের খেসারত দিতে চলছে কত সুন্দর কারসাজি। লুট করা, দুর্নীতির টাকার অপব্যবহার এবং অপপ্রয়োগ, বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের রানআউটের সুযোগ নিয়ে আমাকে সাজঘরে পাঠানোর চেষ্টা চলছে। শোনা যাচ্ছে আমাকে ফেরানোর আন্দোলনের সাধু ভক্তরাও দুর্নীতির পাপে পুড়ছেন।
আমার প্রতিষ্ঠা কোন সার। আমি দুঃখিত, নিখিল প্রাণিসম্পদ সমিতি যদি বিবেকালয়ে কোনো মামলা ঠুকে দেয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেখানে আমি গণতন্ত্র গণসাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। আমাকে নিয়ে ‘হায় সোনালী ডানার চিল’ হিসেবে হায় হায় করতে হবে না এ সমতটের সাবেক কোনো কবির মতো। আমি সত্যি মুমূর্ষু! বিশ্ববিদ্যা যেখানে লয় বা ক্ষয় হয় সেখানেও দেখি নিজেদের নির্বাচন নিয়ে নানান প্রতিবাদের নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। দুর্নীতির নাট্যশালায় আধিপত্য বিস্তারের আকাক্সক্ষা কেমন বীভৎস ও বিবস্ত্র হতে পারে তা যদি পাঠ না করতে পারেন আমি গণতন্ত্র তখন কী করতে পারি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
সবাই জানে বৈষম্য এবং দুর্নীতি পরস্পরের পরিপূরক। একে অন্যের উপায় ও উপলক্ষ। বিস্ময়কর মনে হলেও খোদ দুর্নীতির সংজ্ঞা সন্ধানেও দুর্নীতি হতে পারে। যে ব্যাখ্যা নিজের মনোপূত নয়, যে বয়ান নিজের ভেদবুদ্ধি জ্ঞানের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, যে বর্ণনায় নিজের ধ্যান-ধারণারা আশ্রয় প্রশ্রয় পায় না সংজ্ঞায়নে সুকৌশলে তা এড়িয়ে চলাও এক ধরনের দুর্নীতি। চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। যে কর্মকাণ্ড নৈতিকতা বিবর্জিত, সুশাসন, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহি যেখানে যবুথবু অবস্থায়, যা সম্পাদনের দ্বারা অন্যের মৌলিক অধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়- তাই দুর্নীতি। সুতরাং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (কজ অ্যান্ড ইফেক্ট) উভয়ের মধ্যে দুর্নীতির উপস্থিতি লক্ষণীয়। চিন্তাভাবনায়, পরিকল্পনায়, সম্পাদনে, ফলে প্রতিক্রিয়ায় সর্বত্র ন্যায়নীতিনির্ভরতার অনুপস্থিতির মধ্যে দুর্নীতির আদি অকৃত্রিম অধিবাস ।
দুর্নীতি শুধু দৃশ্যমান অন্যায় অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ, তহবিল তসরুপ, ক্ষমতার অপব্যবহার, সম্পদের অপচয়, প্রতারণায় সীমাবদ্ধ নয়- দুর্নীতির ষড়যন্ত্রকেও দুর্নীতির এখতিয়ারভুক্ত করার বিধান রয়েছে। যে পরিবেশে দুর্নীতি সংঘটিত হয়ে থাকে ওই পরিবেশকে এবং সেই পরিবেশ সৃজনকারীকেও গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে দুর্নীতিকে এজাহারভুক্ত করা যেতে পারে। তাই নীতি ও নৈতিকতার অভাবে ভৌত ও আর্থিক ক্ষতি, অপচয়, অপব্যয়, আত্মসাৎ তসরুপ, চিন্তাকর্মে, ধ্যানে-জ্ঞানে অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ সব দুর্নীতি। দুর্নীতির বুৎপত্তিগত বিস্তার ব্যাপক- যেমন প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার, প্রচলিত নৈতিক ধ্যানধারণাকে এড়িয়ে চলা, মানসিকভাবে প্রতিবন্ধিত্ববরণ, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের অভাব, চিন্তাভাবনায় একদেশদর্শিতা, অসদাচরণ, অসততা, অসাধুতা, অমিতাচার, অনুচিত, অশোভন, অসমীচীন, অন্যায়, দলীয়করণ ও পক্ষভুক্তকরণ, নিষ্ঠুর আচরণ, ন্যায়বিরুদ্ধতা সব দুর্নীতির সংসারে শরিকানাভুক্ত।
আমি গণতন্ত্র দুঃখের সাথে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মানবজীবনে দুর্নীতির সূত্রপাত সেই স্বর্গবাসের কাল থেকে। আদি পিতা-মাতা শয়তানের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিধাতার নির্দেশনা অমান্য করেছিলেন। নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার মতো অবৈধ কাজের প্রতি তাদের মনে আগ্রহের বীজ বপন করে দিয়েছিল যে শয়তান সে এখনো সক্রিয়, সর্বদা-সর্বত্র তার তৎপরতা। বৈধতার চেয়ে অবৈধতার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র সর্বজনীন। এ ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়াই দুর্নীতি।
মানুষের অস্থিমজ্জায় প্রবাহিত খারাপ প্রবণতা সুযোগ পেলে অবৈধতার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। মানবমনে নৈতিক ও অনৈতিক শক্তির নিরন্তর লড়াই চলছে। নৈতিকতার শক্তি পরাস্ত হলে অনৈতিক পক্ষ বিজয়ী হয়। ফলে সে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নৈতিকতার শক্তিকে সাহস জোগাতে, প্রবল করতে যুগে যুগে ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, আইন-কানুন, নানান উপায় ও উপলক্ষ নির্মাণ করে চলেছে। আইনের শাসন, বিবেকের আদালত, সুশাসন ও জবাবদিহির সুস্থ পরিবেশের প্রভাব যেখানে বেশি সজ্ঞান-সক্রিয়, সেখানে দুর্নীতি কম। আবার যেখানে পরিস্থিতি ভিন্ন সেখানে দুর্নীতি বেশি। বর্তমান বিশ্বে যেসব দেশে ও অঞ্চলে সরকারি সম্পদ-সম্পত্তি-সৌভাগ্য ‘ভাগাভাগির’ অর্থনীতি, ‘আত্মসাৎ অপব্যয়ের’ অর্থনীতি-আর্থিকসহ নানা রাজনৈতিক উৎকোচের ‘কেলেঙ্কারির’ অর্থনীতি যুগপৎভাবে বেগবান ও বিদ্যমান সেসব সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বিষবাষ্প বা দুর্নীতির দুষ্টচক্র বহুবিধ পরিচয়ে পরিব্যাপ্ত। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে এর সামাজিক বিস্তার।
‘জনগণের জন্য’, ‘জনগণের দ্বারা’ নির্বাচিত ‘জনগণের সরকার’ এ ধারণা ও দর্শনে জনগণ সব ক্ষমতার উৎস। আমার বেলায় এটি সাফ কথা। এ নীতিবাক্যের আলোকে জনগণের সম্পদ, দেশ ও অর্থনীতির সার্বভৌমত্বসহ সব স্বার্থ, নিরাপত্তা ও অধিকার, ক্ষমতা সব সংরক্ষণের দায়িত্ব যেমন সরকারের ওপর বর্তায়, তেমনি দায়িত্বশীল আচরণের দায়-দায়িত্ব জনগণের। নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথে দলীয় সরকার দলমত নির্বিশেষে সব পক্ষের হয়ে যায়, ‘কোনো প্রকার রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী’ হয়ে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করার শপথ সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে যায়। সেই শপথের ব্যত্যয়ে সব জনগণের সম্পদ ও স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব পালনে অপারগ পরিবেশ পরিস্থিতিতে রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে তা তুল্য হয় মহাদুর্নীতির (গ্র্যান্ড করাপশন) সাথে। সে পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের মৌলিক মর্মমূলে আসে আঘাত।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে কয়েকটি ছোট বড় দেশে, অঞ্চলে ও অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে নির্বাচিত কয়েকটি গণতান্ত্রিক সরকার। এসব সরকার নিজে কলাকৌশলে দুর্নীতির আশ্রয় প্রশ্রয়ে চলে গেছে। আমজনতার অর্থনীতিতে ভাগ বসিয়েছে আত্মসাতে উন্মুখ দুর্নীতিবাজ নীতিনির্ধারক, জনগণের ভাগ্যবিধায়ক সরকার। তাদের সাফল্যগুলো ম্লান হয়ে গেছে সীমাহীন দুর্নীতিতে, সেখানে ব্যাহত হয়েছে উন্নয়ন আর নানা নেতিবাচক মনোভাব এসে চিড় ধরিয়েছে জনগণের আস্থায়। এমন পরিস্থিতিতে কোথাও কোথাও উদ্ভব হয়েছে ভিন্ন পথ ও পন্থার। দেখা গেছে, যতগুলো কারণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পথ ও পন্থার সরকারের পতন বা পরিবর্তন ঘটেছে তাদের দুর্নীতি বরাবর শীর্ষ কারণ হিসেবে সামনে এসেছে।
লেখক : অনুচিন্তক