গাজা থেকে প্রতিদিন মৃত্যু আর ধ্বংসের খবর আসছে। সর্বসাম্প্রতিক ঘটনায় গাজায় আলজাজিরা টেলিভিশনের পাঁচ সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইসরাইল। এ ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। বেলফাস্টে, তিউনিসিয়ায়, জার্মানিতে, দক্ষিণ আফ্রিকায়, ফিলিপাইন ও পাকিস্তানে বড় বিক্ষোভ হয়েছে। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, ‘সাংবাদিকরা বেসামরিক লোক। তাদের কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। এমন কাজ করা যুদ্ধাপরাধ।’ নিন্দা করেছে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু ইসরাইলি বাহিনীর এ ভয়ঙ্কর অপকর্ম থেমে নেই। এ পর্যন্ত গাজায় ২২ মাসে ২৭০ সাংবাদিক হত্যা করেছে ইসরাইল।
যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিক হত্যার একটি চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে, যা থেকে বুঝা যাবে গাজা পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্টস অব ওয়ার প্রকল্পের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ এবং ৯/১১-পরবর্তী আফগানিস্তান যুদ্ধে মোট নিহত সাংবাদিকদের চেয়ে বেশি। মনিটরিং ওয়েবসাইট শিরিন, পিএসর হিসাবে, ২২ মাসের যুদ্ধে গাজায় ইসরাইলি হামলায় ২৭০ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন, অর্থাৎ মাসে গড়ে ১৩ জনের মতো। ওই ওয়েবসাইটটির নামকরণ করা হয়েছে আলজাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর নামে, যাকে ২০২২ সালে অধিকৃত পশ্চিমতীরে ইসরাইলি বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানিয়েছে, ২০২৪ ছিল সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর। বিশ্বজুড়ে ১২০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। চলতি বছরে গাজায় ইসরাইলি হামলায় ৫০ জনের বেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন। (সূত্র : আলজাজিরা)
মৃত্যুক‚প গাজায় সাংবাদিকতা : ১১ আগস্ট সর্বশেষ হামলার ঘটনায় গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালে আলজাজিরার পাঁচ সাংবাদিক নিহত হন। তারা হলেন- সংবাদদাতা আনাস আল-শরিফ ও মোহাম্মেদ কুরেইকেহ, ক্যামেরাম্যান ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মেদ নৌফাল এবং মোয়ামেন আলিয়া। হামলার সময় তারা হাসপাতালের মূল গেটের কাছে সাংবাদিকদের জন্য তৈরি করা একটি তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। স্থানীয় সময় রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে একটি ইসরাইলি ড্রোন ওই তাঁবুতে হামলা চালায়। মোট সাতজন ওই হামলায় নিহত হন। সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে হত্যা ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আরেকটি সুস্পষ্ট ও পরিকল্পিত আঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করে এর নিন্দা জানিয়েছে আলজাজিরা। সংবাদমাধ্যমটির ভাষ্যে, আল-শরিফ ও সহকর্মীরা ছিলেন গাজার ভেতর থেকে খবর প্রচারের শেষ কণ্ঠস্বরগুলোর মধ্যে, যেখানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রবেশ ইসরাইল নিষিদ্ধ করেছে। জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি মিশন অভিযোগ করেছে, ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে আল-শরিফ ও কুরেইকেহকে হত্যা করেছে, যারা ‘ইসরাইলের গণহত্যা ও অনাহারের নথি তুলে ধরছিলেন’। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলেন, সাংবাদিকদের নির্ভয়ে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর গাজার খান ইউনিসে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হন আলজাজিরার ক্যামেরাপারসন সামের আবুদাকা। একই হামলায় গাজার ব্যুরোপ্রধান ওয়েল দাহদুহ আহত হন। আবুদাকাকে ঘটনাস্থলে মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখা হয়, কারণ ইসরাইলি সেনারা উদ্ধারকর্মীদের পৌঁছাতে বাধা দেয়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি খান ইউনিসে গাড়িতে যাওয়ার সময় মিসাইল হামলায় নিহত হন ওয়েলের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও আলজাজিরা সাংবাদিক হামজা দাহদুহ।
২০২৪ সালের ৩১ জুলাই, শাতি শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলায় সাংবাদিক ইসমাইল আল-ঘোল এবং ক্যামেরাপারসন রামি আল-রিফি নিহত হন, যদিও তাদের গাড়িতে স্পষ্ট ‘গণমাধ্যম’ চিহ্ন ছিল এবং দু’জন গণমাধ্যমের সদস্য হিসেবে পরিচয় বহনকারী ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট পরেছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর মধ্য গাজার নুসেইরাত শিবিরে বিমান হামলায় নিহত হন আলজাজিরার আহমেদ আল-লুহ আর ২৪ মার্চ উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় নিহত হন সাংবাদিক হোসাম শাবাত।
সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করা যুদ্ধাপরাধ : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ হত্যাকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ আখ্যা দিয়ে আল-শরিফকে ‘সাহসী ও অসাধারণ’ সাংবাদিক হিসেবে উল্লেখ করেছে। ২০২৪ সালে তিনি মানবাধিকার রক্ষক পুরস্কার পান। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে সাংবাদিকদের হত্যা ও আটক গাজায় এমন এক তথ্যশূন্যতা তৈরি করেছে, যা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ আড়াল করে দিচ্ছে। এ বছরের জুনে আরএসএফ, সিপিজে ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম যৌথ বিবৃতিতে জানায়, গাজায় স্থানীয় সাংবাদিকরা যারা বহির্বিশ্বের জন্য খবর সরবরাহ করছিলেন, তারা ক্রমাগত জীবন-নাশের মুখে রয়েছেন। তবে এসব ঘটনায় বিশ্ব বিবেক খুব একটা জাগ্রত হতে পারছে না। শুধু নিন্দা জানিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। এ যুদ্ধাপরাধের বিচারের তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
গাজায় হামলা শুরু যেভাবে : ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলি ভ‚খণ্ডে হামাস অতর্কিত হামলা চালালে এক হাজার ২০০ জন নিহত হয়। তাদের হাতে জিম্মি হয় ২৫০ জন। হামাস আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণে একান্ত বাধ্য হয়ে এ কাজ করেছিল। পরদিন ৮ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজায় যে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, তা এখনো থামেনি। মাঝে দুই দফায় কিছু দিনের যুদ্ধবিরতি বাদে পুরো সময়টা ইসরাইলি হামলা অব্যাহত আছে। আন্তর্জাতিক মহলের যুদ্ধবিরতির আহ্বান উপেক্ষা করে তারা এ হামলা অব্যাহত রেখেছে। ২২ মাসে ইসরাইলি আগ্রাসনে ৬১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীর মধ্যে এক লাখের বেশি নিহত হয়েছে। এটা ইসরাইলের জাতি নির্মূলের অংশ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
আর মাঝে একটি যুদ্ধবিরতি হলেও ইসরাইল তা ভেঙে দেয়। গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মেয়াদ শেষ হয় ২ মার্চ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ে; কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে আবারো গাজায় নির্বিচার হামলা চালায় ইসরাইল। এরপর আর যুদ্ধবিরতি আলোচনায় কোনো ফয়সালা আসেনি, সমঝোতায় আসতে পারেনি হামাস ও ইসরাইল।
যুদ্ধবিরতির মধ্যে বন্দিবিনিময় এবং অন্যান্য চুক্তির মাধ্যমে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৩৮ জিম্মি মুক্তি দিয়েছে হামাস। বিনিময়ে মুক্তি পেয়েছেন দুই হাজারের মতো ফিলিস্তিনি। গাজা অভিযান চালানোর সময় ইসরাইলি সেনারা ৪০ জিম্মির লাশ উদ্ধার করে। তাদের মধ্যে কেউ গাজায় ইসরাইলের অভিযানের সময় ইসরাইলি সেনাদের হাতে নিহত হন। এখনো ৫০ জন আটক আছেন বলে জানা যাচ্ছে। এর মধ্যে জীবিত আছেন ২০ জন। সম্প্রতি কাতারে যুদ্ধবিরতি আলোচনার সময় ১০ জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয় হামাস। কিন্তু সেই যুদ্ধবিরতি আলোচনা সফল হয়নি। ফলে এসব জিম্মির মুক্তির বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে।
জানা যাচ্ছে, ২৩ জুন ২০২৫ পর্যন্ত ১৪৮ জিম্মিকে জীবিত ইসরাইলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যার মধ্যে ২০২৩ সালের গাজা যুদ্ধবিরতিতে ১০৫ জনকে মুক্তি দেয়া হয়, পাঁচজনকে হামাস কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তির কাঠামোর বাইরে মুক্তি দিয়েছে, আটজনকে ইসরাইলি প্রতিরক্ষাবাহিনী উদ্ধার করেছে এবং ৩০ জনকে ২০২৫ সালের গাজা যুদ্ধবিরতিতে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক শক্তি বা বিশ্ব মোড়লরা গাজা প্রশ্নে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। কিছু উদ্যোগ নিলেও ইসরাইল মানেনি। ইসরাইলের সহযোগী আমেরিকা তাতে ভেটোসহ বিভিন্ন বাগড়া দিয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াওভ গালান্তের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এ ছাড়া গাজায় গণহত্যার অভিযোগে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও (আইসিজে) মামলা চলমান রয়েছে। তবে তার অগ্রগতি সামান্য।
যুদ্ধবিরতি না হওয়ায় গাজায় ইসরাইলি হামলা এখন আরো ব্যাপকতা পেয়েছে। গত কয়েক দিনে আট শতাধিক গাজাবাসী হামলায় নিহত হয়েছেন, যাদের অনেকে ত্রাণ সংগ্রহকালে নিহত হন। ত্রাণ বিতরণের নামে গাজাকে ভয়াবহ মৃত্যুকূপ বানানো হয়েছে। অন্য দিকে ইসরাইলি বাহিনী গাজা সিটি দখলের ভয়ঙ্কর এক পরিকল্পনা করেছে বলেও খবর প্রকাশ হয়েছে। এতে গাজায় রক্তপাত ও ধ্বংসলীলা আরো বাড়বে। বাড়বে নিপীড়িত মানুষের হাহাকার এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।