Sabotage শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ sabot থেকে, যার অর্থ কাঠের জুতা। বলা হয়, ফ্রান্সে শ্রমিকরা পুরনো দিনে কখনো কখনো প্রতিবাদ হিসেবে তাদের কাঠের জুতা যন্ত্রে ছুড়ে দিত যন্ত্রপাতি বন্ধ করতে। তাহলে স্যাবোটাজ মানে বোঝায় কোনো কিছুকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস বা ব্যাহত করা। এর বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে : বাধা, ষড়যন্ত্রমূলক ক্ষতি, নাশকতা। বিশেষ করে শত্রুর ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে বা কোনো কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাতে ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতি করা। আমাদের গ্রাম দেশে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ বলতে যা বোঝায় স্যাবোটাজের অর্থ প্রায় তেমনই।
মামলায় জিতবার জন্য নিজের সন্তানকে হত্যা করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ঘটনা এ দেশে বিরল নয়। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই কৌশলের নানাবিধ প্রয়োগ দেখা যায়। ব্যক্তিগত প্রয়োগ অপপ্রয়োগের কথা সবারই জানা। কখনো দল, গোষ্ঠী ও গোত্রস্বার্থ সুবিধা অথবা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এই অপকৌশল গ্রহণ করে। প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসার জন্যও অনেকে অনেক কিছু করে। যুদ্ধের জেদে রাষ্ট্র যে কী করতে পারে গত সপ্তাহের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা থেকে খানিকটা আন্দাজ করা যায়। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে কাশ্মিরি মুক্তিযোদ্ধারা একটি ভারতীয় বিমান হাইজ্যাক করে লাহোরে নিয়ে যায়। হাইজ্যাকারদের জনাব ভুট্টো শাবাশি দেন। বিমানটি পরে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরে মুকচুন্দ দুবে রচিত গ্রন্থ 1971 and Beyond এ জানা যায়, এটি ছিল ভারতের স্যাবোটাজ। পাকিস্তানি বিমান ও সমরাস্ত্র যাতে ভারতের আকাশ ব্যবহার করে ঢাকায় নিয়ে আসতে না পারে এজন্য এই ছক সাজায় ভারত। আইন দেখে তো আর যুদ্ধ হয় না! পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম অসংখ্য স্যাবোটাজের ঘটনা আছে। তা ব্যক্তিক পর্যায় অতিক্রম করে রাষ্ট্রিক বলয় পর্যন্ত বিস্তৃত।
গত কয়েক দিনে ‘এনসিপি বনাম জামায়াত তর্ক যুদ্ধে’ স্যাবোটাজ শব্দটি ব্যবহার করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। প্রথম খুব কঠিন ও কঠোর ভাষায় দেয়া বিবৃতিটির পর দুটো কথা শিরোনামে নীতিনির্ধারণী ভাষায় ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, ‘একাত্তরের প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এ দেশে গণহত্যা চালিয়েছে। (পাকিস্তান অফিসিয়ালি ক্ষমা চাইলেও, তদুপরি আবারো ক্ষমা চাইতে রাজি হলেও, যুদ্ধাপরাধের সহযোগীরা এখনো ক্ষমা চায়নি)। ইনিয়ে বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোটাজ বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে।’ এখানে স্যাবোটাজ শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, পক্ষ-বিপক্ষ অথবা শত্রুপক্ষ- যেখান থেকেই হোক না কেন এটি রীতিমতো স্যাবোটাজ। চলমান বিতর্ক সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একটি দলের চেয়ারম্যানের ভাষায় ওই স্যাবোটাজের সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমরা অনেক দল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছি। আমাদের দাবি আংশিক পূরণের মধ্য দিয়ে সেটার সমাপ্তি হয়েছে। পরে যেসব স্লোগান, জাতীয়সঙ্গীত বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক করা হচ্ছে, তা অপ্রাসঙ্গিক। একসাথে আন্দোলনের তিন দিন পর হঠাৎ জামায়াতের বিরুদ্ধে আঙুল তোলা আওয়ামী লীগের কাজ। এটা ফ্যাসিবাদের নতুন ষড়যন্ত্র বলে মনে করি। (আমার দেশ, ১৪ মে ২০২৫)।
এই বিতর্কের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি সামনে এনে উত্তাপ ও উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে তা ‘নতুন করে পুরান ঘটনা’। এই উত্তাপ ও উত্তেজনার বাস্তবতা বাংলাদেশে নেই তা অস্বীকার করা যাবে না। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ চরম বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজতন্ত্র ও তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদ-নাজিবাদের দিকে ধাবিত করে। তারা অস্বীকার করেছে জনগণের হৃদয়ে গ্রথিত ইসলামী মূল্যবোধ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ইসলামী মূল্যবোধের ধারাকে ধারণ করেছেন। সেই থেকে রাজনীতি, সমাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় দুটো ধারার বিপরীতমুখী প্রবাহ স্পষ্টতর হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে বলেছেন ভাবাদর্শের সঙ্ঘাত (Conflict of Values)। বিগত অর্ধ শতাব্দীর ইতিহাসে এই দুটো ধারার দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ ও সংঘর্ষ অব্যাহত থেকেছে। যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তখনই তারা এ জাতিকে বিভক্ত করেছে- মুজিব নগরীয় ও অমুজিব নগরীয়, স্বাধীনতার সপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি হিসেবে। ইসলাম এ দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয়ে স্পন্দন হলেও এর লালন-পালন ও অনুশীলনকে তারা পাকিস্তানবাদ নামে চিহ্নিত করে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিকে নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়েছে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তি যখনই দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে তারা ইসলামকে লালন-পালন করে মূল ধারা হিসেবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের গরিষ্ঠ জনসংখ্যা সবসময়ই এই সম্মিলিত ধারাকে সমর্থন ও সার্থক করেছে।
নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই জনগণের হৃদয়ের ভাষা অনুভব করা যাবে। জনসংখ্যার একটি বিপুল অংশ ধর্মকে ব্যবহারিকভাবে পালন না করলেও বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে ইসলাম অনুসরণ করে। আওয়ামী লীগের সমর্থক জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী। সমাজতন্ত্রের তথা মার্কসবাদের সমর্থক নানা রঙে নানাভাবে বিভক্ত বাম ধারার গরিষ্ঠ অংশ আদর্শিক কারণে আওয়ামী লীগের অনুগমন করে। তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি সমর্থন করে এসেছে। ১৯৭১-৭৫ সময়কালে কমিউনিস্ট পার্টি ও মস্কোপন্থী ন্যাপের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠিত হয়। সেই একই ধারায় শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন থাকাকালীন ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত বামদের মস্কোপন্থী অংশ হাসিনা সরকারকে সমর্থন করতে থাকে। সর্বশেষ ইনু-মেননদের কথিত ১৪ দলীয় জোটের কথা বলা যায়। বামদের একটি ক্ষুদ্র অংশ অবশ্য সবসময়ই জাতীয়তাবাদী শক্তির সহায়ক হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে মাহমুদুর রহমান মান্না, সুব্রত রায়, কমরেড সাইফুল হক ও জোনায়েদ সাকীর মতো বাম ধারার নেতারা জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী ধারার সহযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছে। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর এই সময়ে সেই সম্পর্ক বহাল রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক জগতের সব পথ ও মতের এক ঐতিহাসিক ঐক্য দেখা গেল ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে। ডান বাম ও মধ্য ধারার সব রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণ-অভ্যুত্থানের সমর্থনে এগিয়ে আসে। নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যখন অভ্যুত্থানের প্রতিভূ হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন তখন তারা জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেন। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ইসলামী মূল্যবোধের বিরোধী আওয়ামী সরকার ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতি মুছে ফেলার নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে। দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ধার্মিক মানুষেরা চরম নিগ্রহের শিকার হয়। এমনকি জঙ্গি অভিযোগের সেই সময়কালে ইসলামী পোশাক তথা সুন্নতি লেবাসধারী মানুষদেরও হেনস্তা করা হয়। ইসলামী রাজনীতির প্রতি খড়গহস্ত হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। এই ধারার শীর্ষ নেতাদের তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের নামে জীবন দিতে হয়। অথচ ১৯৭১ সালে এসব নেতার কেউই ক্ষমতাসীন ছিলেন না। ছাত্রনেতা ছিলেন মাত্র। যা হোক, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে যে ভুল করে তার দায় এখনো নতুন প্রজন্মের ওপর আরোপের চেষ্টা করা হয়।
আওয়ামী লীগ যে শুধু জামায়াতের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল তা নয়। দেশের আলেম-ওলামা ও পীর মাশায়েখরা যখনই আন্দোলন করেছে তখনই হত্যা, জেল ও জুলুমের শিকার হয়েছেন। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের আলেম-ওলামা ও মাদরাসার ছাত্রদের তারা নির্বিচারে হত্যা করে। পরে মাওলানা মামুনুল হকের মতো অসংখ্য ধর্মীয় নেতা ও ওয়ায়েজিনের ওপর অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। দু’মুখো নীতি অনুসরণ করে তারা আলেমদের একাংশকে ক্রয় করে ‘কওমি জননী’ খেতাব অর্জন করে। এ সময় তারা সব মসজিদ মাদরাসায় দলতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা করে। হাক্কানি ইমাম যারা সত্য কথা বলতেন তাদের প্রকাশ্যে এমনকি মসজিদে আওয়ামী গুণ্ডারা অপমান অপদস্থ করে। মিজানুর রহমান আজহারীকে বিদেশে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়। ২০২৪ এর অভ্যুত্থানের পর এ অবস্থার অবসান ঘটে। ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর ইসলামী ভাবধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কেউ আদেশ করেনি, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে মূর্তিগুলো অপসারিত হয়। আন্দোলন, সংগ্রাম ও ক্ষমতায়নে ইসলামী মূল্যবোধের অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। এই প্রথম এই দেশের ক্যাবিনেটে একজন আলেমে দ্বীন সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিত্ব লাভ করেন।
২০২৪ সালের পরিবর্তিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগ সমূলে উৎখাত করা হয়। শেখ হাসিনা পলায়ন করেন। কিন্তু তিনি ভারত থেকে ক্রমাগত উসকানি দেয়ার ফলে ৩২ নম্বর বাড়িটি জনগণ গুঁড়িয়ে দেয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যাচারী আওয়ামী নেতাদের গ্রেফতার করে। গ্রামগঞ্জে আওয়ামী লীগের লোকেরা জনগণের রুদ্ররোষের শিকার হয়। এ অবস্থায় অনেকে আত্মগোপনে চলে যায়। বেশ কিছু সংখ্যক ভারতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু আওয়ামী ভাবধারাপুষ্ট বাম বুদ্ধিজীবীরা একরকম নিরাপদ থাকে। তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসলামী ভাবধারাবিরোধী ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে। ৩২ নম্বরের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয়ার পর তারা একটি বিবৃতিও দেন। ইসলামী নারীনীতির বিরুদ্ধে যখন ইসলামী জনতা মাঠে নামে তখন তাদের নানা প্রকারে তৎপর দেখা যায়। অবশেষে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আক্রোশে ফেটে পড়ে। দূরের এবং কাছের বিদেশী বন্ধুদের বিবৃতি তাদের সাহস জোগায়। ২০২৪-এর গণ-অভুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজে ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে বিরোধ এবং দ্বন্দ্ব দেখা দিলে বাম ধারার লোকেরা ও তাদের প্রতিপত্তিশালী অংশ প্রকাশ্যে ও গোপনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাম ধারার আদর্শপুষ্ট। পাশ্চাত্যের আধুনিকতা, ঔপনিবেশিক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও মার্কসবাদ তাদের ইসলামবিরোধী করে তুলেছে। আওয়ামী-বাম ধারার রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের জন্য অনাকাক্সিক্ষতভাবে একটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে শাহবাগে যে আন্দোলন হয়েছিল সেখানে শুক্রবার রাতের কিছু স্লোগান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়। জাতীয়সঙ্গীত গাইতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। স্বাভাবিকভাবে সেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটার কথা নয়। যারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন তাদের দ্বারা এ ধরনের অযাচিত, অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত স্লোগান ও কার্যক্রম আশা করা যায় না। তবুও যদি সেটা হয়ে থাকে তা দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশে জাতীয় মৌলিক আদর্শের বিষয় জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত নয়। তবুও মানুষ কিছু বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল। যেমন ধর্মীয় বিষয়। এখনে আঘাত এলে তারা আহত হয়। আবার মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়েও তারা স্পর্শকাতর। জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি এর প্রতিবাদ করেছে। এটিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করেছে আওয়ামী বাম ধারার জনগোষ্ঠী। এখন সেই বিবৃতি যুদ্ধ চলছে। এই বিবৃতি যুদ্ধের সবটুকুই যে অসার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা নয়। তারা সঙ্গতভাবেই বলেছেন স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার প্রচেষ্টা মেনে নেয়া হবে না। তবে একটি ভুলকে আরেকটি ভুল দিয়ে সংশোধন করা যায় না। তাৎপর্যের সাথে লক্ষণীয়, প্রদত্ত যে বিবৃতি ও বার্তা উত্থাপিত হয়েছে তা পরাজিত আওয়ামী শক্তির উচ্চারিত। সেখানে রাজাকার প্রসঙ্গটি যেমন এসেছে তেমনি হাতিয়ার গর্জে ওঠার কথাও বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, ‘তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়’। এই ঘটনায় আন্দোলনকারীদের বিজয় ও উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা সচেতন নাগরিকদের বিব্রত করে। এ ঘটনার পর যারা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছে তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ দেখা দিয়েছে। এই বিরোধ গোটা দেশের জন্য এবং অতি কাক্সিক্ষত জাতীয় ঐক্যের জন্য ক্ষতিকারক। এটি সুযোগ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও মিত্রদের। অথচ দীর্ঘ ৯ মাসে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী যুদ্ধে শরিক হয়েছে। আওয়ামী নিষিদ্ধকরণ আন্দোলনও চাঙ্গা হয়ে ওঠে তাদের উপস্থিতিতে যাদের নিয়ে এখন বিবৃতিযুদ্ধ চলছে।
তবে আশার কথা, গত কয়েক দিনে উভয়পক্ষের বিবৃতির ভাষা অনেকটা নমনীয় হয়ে আসছে। আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না জামায়াত। তারা সবাইকে উসকানিমূলক বক্তৃতা বিবৃতি ও কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলেছে। অন্যদিকে এনসিপি বলেছে, ‘যারা ১৯৭১ সালে এই জনপদের মানুষের জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, আমরা চাই তারা নিজেদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান জাতির সামনে ব্যাখ্যা করে জাতীয় সমঝোতা ও ঐক্য সুদৃঢ় করবে এবং ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের জন-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সহযোগী হবে... জনগণের সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য সবপক্ষকে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানায় এনসিপি।’ জামায়াতের এক নেতা বলেছেন, এনসিপির সাথে সম্পর্ক আগে যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে।
আমরা শুরু করেছিলাম স্যাবোটাজ শব্দ দিয়ে। আর এ শব্দটির প্রতি সমর্থন ছিল তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের। অন্যেরাও বিষয়টিকে স্যাবোটাজ বা ষড়যন্ত্র দিয়েই ব্যাখ্যা করেছেন। বিষয়টি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে স্যাবোটাজ ব্যতীত এ ধরনের বিভ্রান্তি ও বিতর্কের অবকাশ নেই। মানুষ তার চেতন ও অবচেতন মনে অসাবধানতাবশত অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্যাবোটাজ করতে পারে। আর স্যাবোটাজের আবহাওয়া তৈরির নীলনকশা প্রণীত হয় দূর বহুদূর থেকে। ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে ফাটল ধরেছে তাতে ঘৃতাহুতি ঘটে এমন আচরণ কাম্য হতে পারে না। উভয়পক্ষের বিবেকের কাছে, মানবিকতার কাছে ও দেশপ্রেমের কাছে জনগণের আবেদন, ক্ষান্ত হন গৃহযুদ্ধে, জয়ী হবেন আপনারা অবশেষে।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]