প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১১ ডিসেম্বর (২০২৫) জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। সে অনুযায়ী, আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ একই দিনে সাধারণ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে কি না এ নিয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয়ের অবসান ঘটল। সবাই এখন নির্বাচনের মাঠে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন।
জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি একই দিনে যেহেতেু গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, সেহেতু বিষয়টি নিয়ে আজকে আলোচনা করব। পাঠকদের স্মৃতিকে একটু তাজা করতে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ প্রণয়নের পটভ‚মি উল্লেখ করা সমীচীন হবে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। তার ধারাবাহিকতায় ৭ অক্টোবর ২০২৪ সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো ছিল- সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলো ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখের মধ্যে তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে আরো পাঁচটি কমিশন গঠন করা হয়। সেগুলো হচ্ছে- স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রম সংস্কার কমিশন ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। সেগুলোও যথাসময়ে তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করে।
জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সার্বিক সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে অন্তর্বর্তী সরকার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানকে সহসভাপতি এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সদস্য করে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। পরে ওই কমিশন কিছুটা পুনর্গঠন করা হয়। কমিশনের দায়িত্ব ছিল- নির্বাচন সামনে রেখে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারে গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনে রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সাথে আলোচনা করা এবং এ মর্মে পদক্ষেপ সুপারিশ করা। কমিশন তার দায়িত্ববোধ ও সুপারিশের অংশ হিসেবে ঐকমত্যের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংবলিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। ৫ মার্” ২০২৫ পুলিশ সংস্কার কমিশন ব্যতীত অন্য পাঁচটির প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ সম্পর্কে মতামতের জন্য ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পাঠানো হয়। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কারবিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কারবিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমনবিষয়ক ২৭টি সুপারিশ ছিল। মতামত গ্রহণের পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ৩২টি দল ও জোটের সাথে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ৪৭টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করে কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় ১৮টি বিষয় নিয়ে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সাথে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় মিলিত হয়। এ প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ কয়েকটি ভিন্নমতসহ সর্বসম্মতভাবে প্রণীত হয়। সনদটি ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়।
জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ প্রদানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন পুনরায় রাজনৈতিক দল ও সংবিধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে সিরিজ বৈঠকে মিলিত হয়। এসবের ফলে কমিশন সরকারের কাছে দ্বিতীয় দফায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে নিম্নলিখিত প্রস্তাবনা সুপারিশ আকারে দাখিল করে :
ক. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর সুপারিশসমূহের যেসব বিষয় নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন সম্ভব অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারে।
খ. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর সুপারিশসমূহের যেসব বিষয় অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব; বর্তমান অন্তর্বর্র্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
গ. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর সুপারিশসমূহের যেসব বিষয় সংবিধান সংশোধনের সাথে সংশ্লিষ্ট সেগুলো সম্পর্কে নাগরিকদের অভিমত গ্রহণে গণভোট অনুষ্ঠান করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ জারি করবে। এ ছাড়া গণভোট অনুষ্ঠানে আলাদা একটি অধ্যাদেশ জারি করবে। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দলগুলো গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একমত হলেও তা কি সংসদ নির্বাচনের দিনে বা আগে পরে হবে এ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে কমিশন কোনো পক্ষ না নিয়ে সুপারিশ করে, গণভোট সংসদ নির্বাচনের দিনে বা আগে হবে তা নিয়ে সরকার নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশগুলো বিবেচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার ১৩ নভেম্বর ২০২৫ জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ জারি করেন। ওই আদেশে উল্লেখ করা হয় যে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে গণভোট অধ্যাদেশও জারি করা হয়েছে।
গণভোটের ব্যালটে কী প্রশ্ন উপস্থাপন করা হবে সে সম্পর্কে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে নিম্নরূপ বলা হয়েছিল, ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫ এবং উহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’
জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫-এ গণভোটের প্রশ্নটি ভিন্নভাবে পেশ করা হয়েছে যা নিম্নরূপ : ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’
(ক) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হইবে।
(খ) আগামী জাতীয় সংসদ হইবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হইবে এবং সংবিধান সংশোধন করিতে হইলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হইবে।
(গ) সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি, বিরোধী দল হইতে ডিপুটি স্পিকার ও কয়েকটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হইয়াছে- সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকিবে।
(ঘ) জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত অপরাপর সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রæতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হইবে।
গণভোটের প্রশ্নটি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ও জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫-এর মধ্যে পার্থক্যটি লক্ষণীয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকৃত প্রশ্নে ৪৮টি সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল। জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫-এ উল্লিখিত প্রশ্নটিতে ৩০টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যে ঐকমত্য হয়েছিল তা বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। তবে অবশিষ্ট ১৮টি বিষয়ে যে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে তার মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন- উচ্চকক্ষ গঠন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীন কমিশন কর্তৃক গঠনে ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ করেছে তার সাথে বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছিল। তা সত্তে¡ও গণভোটের প্রশ্নে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে, কম গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ের সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সত্ত্বেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোটে প্রশ্ন থাকছে এবং গণভোটে ‘হ্যাঁ’ বিজয়ী হলে যে দলই ক্ষমতায় যাক তা মানতে বাধ্য হবে।
মনে রাখা যেতে পারে, ২৫টি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ স্বাক্ষর করা হয়েছে তাতে তারা নিম্নরূপ অঙ্গীকার করেছেন:
জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতির ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপরিপ্রেক্ষিতে জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।
জনগণ এ রাষ্ট্রের মালিক; তাদের অভিপ্রায় সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। এমতাবস্থায়, আমরা রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ গ্রহণ করেছি বিধায় এ সনদ সংবিধানে তফসিল হিসেবে সংযুক্ত করব।
আমরা জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করব না; উপরন্তু উক্ত সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করব।
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।
আমরা ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি যে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভ‚তপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করব।
আমরা সম্মিলিতভাবে ঘোষণা করছি যে, গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোর যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।
আমরা এ মর্মে একমত যে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে নির্বাহী আদেশ ও অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে। অবশিষ্ট যেসব সিদ্ধান্ত সংবিধান সংশ্লিষ্ট সেগুলো যথোপযুক্ত প্রক্রিয়ায় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করব।
উল্লেখ করা যেতে পারে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলোর মধ্যে শুধু রাজনৈতিক দলগুলো ছিল না; বরং অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কমিশনের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যিনি একই সাথে সরকারপ্রধান। তার মানে, অন্তর্বর্তী সরকারও ঐকমত্য কমিশনের একটি পক্ষ ছিল। কমিশনের উক্ত সনদের সুপারিশগুলোর মধ্যকার বেশ কিছু অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার তার ওপর অর্পিত সনদ বাস্তবায়নের কাজ কতটুকু করে যাচ্ছেন; তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। দুই মাস পরে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দায়িত্বগ্রহণ করলে অন্তর্বর্তী সরকার বিদায় নেবে। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে তারা তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পারলেন তা খতিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, যেসব সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব সেগুলো চিহ্নিত করে তারা তা সরকারের কাছে দাখিল করেছে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলোর কতটা বাস্তবায়ন করেছে এবং আগামী দুই মাসে করবে তা জনগণের সামনে স্বচ্ছতার সাথে তুলে ধরা প্রয়োজন। আরো উল্লেখ্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মোট ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে কাজ করেছে। অবশিষ্ট পাঁচটি কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বা ভবিষ্যৎ সরকারের বিবেচনায় রেখে যাওয়া হচ্ছে; সে সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য জনগণের কাছে প্রকাশ করা উচিত।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব



