আপিল বিভাগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার (যে মামলা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে) শুনানির সময় এক অস্বাভাবিক যুক্তি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন যুক্তি তুলে ধরেন, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের দেয়া রায়টি আইনগতভাবে অকার্যকর, কারণ তাতে তিনি অবসর গ্রহণের পর স্বাক্ষর করেছিলেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল অত্যন্ত সরল- একজন বিচারক যখন অবসর গ্রহণ করেন, তখন তিনি আর সংবিধানের অধীনে ‘শপথবদ্ধ’ থাকেন না। জনাব আবেদীনের মতে, একটি রায় অবশ্যই লিখিত এবং স্বাক্ষরিত হতে হবে যখন বিচারক বিচারিক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন; অন্যথায় সেটি রায় হিসেবে গণ্য হবে না, অর্থাৎ- সেটি বাতিলযোগ্য। সেই মতে, যদি প্রধান বিচারপতি সত্যিই অবসর গ্রহণের পর তার মতামত স্বাক্ষর করে থাকেন, তাহলে পুরো রায় এবং সেই রায়ের সাথে একমত হওয়া অন্যান্য রায়ও বাতিল হয়ে যাবে। কারণ কেউ বাতিল রায়ের সাথে ‘একমত’ হতে পারেন না, এটি আইনি দিক থেকে অস্তিত্বহীন। প্রথম দিকে যুক্তিটি আকর্ষণীয় ও সহজ বিষয় বলে মনে হলেও এর ফল হতে পারে ভয়াবহ। এ ব্যাখ্যা মেনে নিলে বছরের পর বছর ধরে আদালতের অসংখ্য রায় প্রশ্নের মুখে পড়বে, বহু নজির অস্থিতিশীল হয়ে যাবে এবং সুপ্রিম কোর্টের অনেক চূড়ান্ত রায়ের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতে পারে। এ প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণের চেষ্টা করব, তৎকালীন প্রধান বিচারপতির রায় কেবল অবসরোত্তর স্বাক্ষরের কারণে বাতিল ঘোষণার যুক্তিটি কতটা টেকসই।
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশটি ২০১০ সালের ১০ মে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষণা করা হয়। সে সময় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে বহাল ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে তখন তার রায় প্রদানের আদেশ দেয়ার ক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। বিতর্ক শুরু হয় পরে, যখন রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশিত হয়। দেখা যায়, প্রধান বিচারপতি অবসরের পর, অর্থাৎ- তিনি যখন আর পদে নেই বা সাংবিধানিক শপথের অধীন নন, তখন বিস্তারিত মতামতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এ কারিগরি ত্রুটি একটি অত্যন্ত উত্তপ্ত আইনি যুক্তির জন্ম দেয়। যদি রায়ের লেখক আর বিচারকের দায়িত্বপ্রাপ্ত না থাকেন, তবে তার অবসর-উত্তর স্বাক্ষর কি রায়টিকে বৈধতা দিতে পারে? বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মনে করেছিল- না, পারে না। আপিল বিভাগে তাদের অবস্থান ছিল, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের স্বাক্ষরিত রায় আইনত অকার্যকর। এ দাবির সমর্থনে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ১৯৬৪ সালের পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের উদ্ধৃতি দেন, যখন উভয় দেশ একই বিচারিক ব্যবস্থা অনুসরণ করত। সেই ১৯৬৪ সালের রায়ে, দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮-এর একটি বিধানের ব্যাখ্যা করে সুপ্রিম কোর্ট এ মর্মে মতামত ব্যক্ত করেন- একজন বিচারক পদত্যাগ করলে তিনি বিচারিক শপথের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হন এবং ফলস্বরূপ রায় প্রস্তুত বা স্বাক্ষর করাসহ বিচারকের কোনো কাজ করতে পারেন না। এ যুক্তি প্রয়োগ করে, জনাব আবেদীন দাবি করেন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অবসর নেয়ায় পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করার সাংবিধানিক ক্ষমতা তার আর ছিল না।
দৃশ্যত, যুক্তিটি যথেষ্ট প্রভাবশালী বলে মনে হতে পারে। তবে এর ফল একটি এলোমেলো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেত পারে। উদাহরণ হিসেবে বিখ্যাত মাজদার হোসেন মামলার কথা ধরুন। যুগান্তকারী এই রায়ের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের বহুল প্রত্যাশিত পৃথকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ঐতিহাসিক রায়টি লিখেছিলেন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, যিনি আমাদের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে অন্যতম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। রায়টি প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর, আর বিচারপতি মোস্তফা কামাল ওই মাসের ৩১ ডিসেম্বর অবসর গ্রহণ করেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করার আগে। যদি আমরা অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনের উপস্থাপিত যুক্তি গ্রহণ করি, তাহলে বিচারপতি মোস্তফা কামালের ঐতিহাসিক রায়টিও বাতিল বলে গণ্য হবে। অন্য কথায়, আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ভিত্তি রাতারাতি বিলীন হয়ে যাবে, রাজনীতি বা নীতির কারণে নয়; বরং একটি ‘ভুল সময়ে’ স্বাক্ষরের কারণে।
আর এ পরিস্থিতি সেখানে থেমে যাবে না। আইনজীবীরা ফাঁকফোকর খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে যারা চিরকাল অত্যন্ত দূরদর্শী তারা অবসর গ্রহণের পর স্বাক্ষরিত রায়গুলোর সন্ধানে পুরনো মামলার ফাইল ঘাঁটতে শুরু করবেন। তাদের আশা থাকবে সেই রায়গুলো বাতিল করিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মীমাংসিত হয়ে থাকা মামলাগুলো আবার চালু করা। এর ফল হবে বিচারিক নৈরাজ্য। ফলে পুনঃশুনানির ঢল নামবে, বহু সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাবে এবং পুরো বিচারব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়বে।
কেবল এই একটি কারণে যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবে এর একটি গভীরতর দিকও আছে। আমাদের উচ্চ আদালতগুলোতে এ ধরনের রায়কে অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করার কোনো প্রথা বা রেওয়াজ কখনো ছিল না। আমাদের দেশে, প্রাসঙ্গিক বা বিবেচ্য তারিখ হলো সেই দিন, যেদিন জনসমক্ষে রায়টি ঘোষণা করা হয়, রায় স্বাক্ষরের তারিখ নয়।
অন্য দিকে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন যে ১৯৬৪ সালের পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন, সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেয়া হয়েছিল। ওই মামলাটি দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসারে দায়ের করা আপিলসংক্রান্ত ছিল। সেই আইনটি দেশের নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে দেওয়ানি মামলা পরিচালনার নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে। সেই রায় ছিল মূলত উচ্চ আদালতের একজন বিচারক অবসর গ্রহণের পর দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসারে আপিল নিষ্পত্তির সময় তিনি কী করতে পারতেন বা পারতেন না তা নিয়ে। কিন্তু, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানি হয়েছিল, আর এটা তার নিজস্ব বিশেষ বিধিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই নিয়মগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- আপিল বিভাগের কার্যক্রমে দেওয়ানি কার্যবিধি প্রযোজ্য নয়। সুতরাং ১৯৬৪ সালের রায়টি ব্যবহার করে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের আপিল বিভাগে বসে প্রদত্ত রায়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না।
আসলে, অতীতে এমন বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে যা প্রমাণ করে, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অবসর গ্রহণের পর তার রায়ে স্বাক্ষর করে কোনো অনৈতিক বা অনুচিত কাজ করেননি। যুক্তরাজ্যের আদালতগুলো (যেখান থেকে আমাদের আইনি ঐতিহ্যের বহুলাংশ এসেছে) এ ধরনের বিষয়ে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। ইংল্যান্ডে এমন কিছু মামলা হয়েছে, যেগুলো আমাদের পরিস্থিতির চেয়েও অনেক বেশি অস্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, ১৯১৫ সালে আপিল বিভাগ একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তাদের একজন বিচারক, লর্ড জাস্টিস কেনেডি, আদালতে উন্মুক্তভাবে রায় ঘোষণা করার আগে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি সে সময়ের আগে তার লিখিত মতামত সম্পন্ন করেছিলেন। বাকি দুই বিচারক সিদ্ধান্ত নেন, তার লিখিত মতামতকে আদালতের চূড়ান্ত রায়ের অংশ হিসেবে গ্রহণ করার এবং রায় ঘোষণার তারিখটিও তার মৃত্যুর আগের দিন হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
তার আগেও ১৮৯৯ সালে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল, যখন হাউজ অব লর্ডস একটিমাত্র বিচারককে অনুমতি দিয়েছিল যে, তিনি তার সদ্য মৃত সহকর্মীর রায় প্রকাশ্যে পাঠ করতে পারবেন। অর্থাৎ- ইংল্যান্ডের আদালত মৃত্যু হলেও কোনো বিচারকের মতামত শোনানো বন্ধ করত না। এ প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও চালু ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬২ সালে লর্ড হডসন তার নিজের রায়ের সাথে যুক্ত করেন লর্ড মেরিম্যানের রায়। এই মেরিম্যান রায় ঘোষণার দিন সকালে কয়েক ঘণ্টা আগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আবার ১৯৭১ সালে হাউজ অব লর্ডস প্রয়াত লর্ড আপজনের রায়কে সমর্থন করে, যার সিদ্ধান্ত একটি মামলায় জীবিত বিচারকদের মধ্যে দুই-দুই বিভাজিত মতামতের ক্ষেত্রে নির্ণয়ক ভোট হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই উদাহরণগুলো একটি বিষয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরে- রায় কখন স্বাক্ষরিত বা ঘোষণা করা হবে, সে বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। গুরুত্বপূর্ণ হলো- বিচারিক যুক্তির সারবত্তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা, রায় লেখকের স্বাক্ষরের সময় নয়।
অর্থাৎ- বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়ের অবস্থান অনেক বেশি সুরক্ষিত। কারণ বিচারপতি হক তার অবসর গ্রহণের আগে জনসমক্ষে রায়টি ঘোষণা করেছিলেন। তিনি কেবল তার কারণগুলো পরে সরবরাহ করছিলেন। তার ত্রুটি এই ছিল না যে, তিনি অবসরের পর রায়ে স্বাক্ষর করেছিলেন; বরং তিনি জনসমক্ষে দেয়া রায়টিকে পরিবর্তন করেছিলেন। কাজটি তিনি সৎ বিশ্বাসের অভাববশত করেছিলেন, যার জন্য তিনি এখন ফৌজদারি অভিযোগের সম্মুখীন। যেহেতু একজন বিচারক কখন রায় স্বাক্ষরের অযোগ্য হন, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধি বা আইন নেই, সেহেতু আপিল বিভাগ এ বিষয়ে নির্দেশিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীন। প্রথাগত দিকগুলো এড়িয়ে বিচারব্যবস্থাকে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন করা যাবে না যাতে পুরো বিচার বিভাগ অস্তিত্ব সঙ্কটে ভোগার ঝুঁকিতে পড়ে। আমাদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন, প্রথাও আইনের অন্যতম উৎস।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং দ্য হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি



