এক মহীয়সী নারীকে নিয়ে কিছু কথা

বুলবুল দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পরও বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে, দেশের স্বার্থে পতিত স্বৈর সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা জারি রাখেন। তখন আশঙ্কা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী সংবাদিক কনক সরওয়ারের পরিবারের সাথে পতিত শেখ হাসিনা সরকার যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল, সেই রকম আচরণের শিকার বুলবুলের জননীর ওপর হতে পারত। তবে পুত্র ও জননীর তা নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না।

এক মহীয়সী নারীকে নিয়ে কিছু লিখতে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেল। তার ইন্তেকালের পরপর লেখার ইচ্ছে ছিল, সাথে আবেগ ও অনুভূতি জড়িত ছিল। আজ বড় লজ্জা অনুভব করছি। কেননা, ইতোমধ্যে তাকে নিয়ে বেশ কিছু লেখা, একটি জাতীয় দৈনিকে (আমার দেশ) প্রকাশিত হয়েছে। সেসব লেখাও আমি পড়েছি। এমন দ্বিধাদ্ব›েদ্বর মাঝে মনের ভেতর থেকে একটি চেতনার সৃষ্টি হলো। কোনো মহৎপ্রাণের কথা কারো একার পক্ষে বলা সম্ভব হয় না। যারা লিখেছেন, আমি যখন তাকে দেখেছি, হয়তো তারা সে সময় তাকে দেখেননি বা সুযোগ হয়নি। আমার এখানেই ভরসা। আমার লেখা নিঃসন্দেহে একটি জীবন সংগ্রামের খণ্ডিত অংশ। আমার কৈশোরে মহীয়সী ওই নারীকে আমি যেভাবে দেখেছি তার একটি খণ্ডচিত্র আমার লেখায় আঁকার চেষ্টা করব।

আজ থেকে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগে তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এখানে আর একটি দুর্ভাগ্যের কথা না লিখে পারছি না। সময় বিভ্রাটে আমি তার নামাজে জানাজায় শরিক হতে পারিনি। যোগ দিতে পারিনি শোক মিছিলে। কেননা প্রথমে খবর পেয়েছিলাম তার নামাজে জানাজা বাদ আসর। পরে জানলাম বাদ আসর নয়, বাদ যোজর। সময়ের সাথে পেরে উঠতে না পারায় তখন আর সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এমন শোকাবহ ঘটনা জীবনের বাকি সময়টুকুতে ভুলে যেতে পারব বলে মনে হয় না।

যে মহীয়সী নারীকে নিয়ে আজ লিখছি তিনি আর কেউ নন, অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম। আজ থেকে প্রায় ষাট বছরের বেশি সময় আগে আমরা পুরান ঢাকা (যে ঢাকাকে আদি ঢাকা বলে মনে করি)। তদানীন্তন সূত্রাপুর থানা এলাকা গেন্ডারিয়ার ২৯ সতিশ সরকার রোডে আমরা থাকতাম। অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম তার একমাত্র মেধাবী সন্তান (তখন তিনি ছোট্ট বালক) মাহমুদুর রহমান বুলবুল ও স্বজনদের নিয়ে বসবাস করতেন সেই সতিশ সরকার রোডের বড়–ইতলা মাজারসংলগ্ন একটি ভবনের নিচতলায়। প্রতিদিন সকালে অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম তার বাসা থেকে অনতিদূরে গেন্ডারিয়া রেলস্টেশনে বেশির ভাগ সময় হেঁটে যেতেন। কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। পরন্ত বিকেলে আবার ট্রেনে করে গেন্ডারিয়ায় ফিরতেন। ঝড়-বাদলের দিনেও এটা ছিল তার নিত্যদিনের কর্মসূচি। এটা শুধু প্রতিদিনের রুটিন ছিল না, বরং তা ছিল দীর্ঘদিনের সংগ্রামের একটি অংশ।

সেই সম্মানিত অধ্যাপিকার যাওয়া-আসার মাঝে এক অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছি কৈশোরে। পরতেন সাদা শাড়ি ও সাদা বøাউজ। কাঁধে ঝোলানো থাকত একটি ব্যাগ। অসম্ভব এক গাম্ভীর্য ছিল তার চেহারায় এবং চলার ভঙ্গিতে। ধীরস্থির পায়ে হেঁটে যেতেন তিনি। অবাক হতাম তার পথ চলায়। তার প্রতিটি কদমে বিচ্ছুরিত হতো অভূতপূর্ব ব্যক্তিত্ব।

ওই সময় গেন্ডারিয়া থেকে বহু যাত্রী ট্রেনে চেপে নারায়ণগঞ্জে যেতেন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে। তার সহযাত্রীরাও স্টেশনে যেতে আসতে শ্রদ্ধা সমিহ প্রদর্শন করে চলার পথে সবসময় তার কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতেন। এমন স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিত্বের জন্য আমাদের কৈশোর বয়সে তার প্রতি শ্রদ্ধা মিশ্রিত একটা ভয় ছিল। তিনি সড়কের ডান পাশ দিয়ে চললে আমরা বাম পাশ দিয়ে হাঁটতাম। ভয়ে ভয়ে সালাম দিতাম। আমি যখন গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণীর ছাত্র, বুলবুল তখন প্রাইমারির ছাত্র। তার সহপাঠী আমার ছোট ভাই, বাবুল। দু’জনের গলায় গলায় ভাব। আজো দুজনের বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন আগের মতোই রয়েছে। বুলবুলের মমতাময়ী মা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগমের অনেক গুণগাথা বাবলুর কাছ থেকে ‘হরদম’ শুনেছি, শুনে অবাক হয়েছি। বুলবুল সর্বত্র আমাকে তার বড় ভাই হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেন, তখন গর্বে বুক ভরে ওঠে। আনন্দে চোখের পানি ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, আবেগে আপ্লুত হই।

আজ যে বুলবুলকে সবাই মাহমুদুর রহমান হিসেবে চিনেন। তার ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করেন- তা আসলে অনেকটা তার মা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগমের প্রতিবিম্ব। একসময় যে অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম ছাতা হাতে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। জীবন সায়াহ্নে এসে যুদ্ধের ক্ষেত্র পাল্টালেও সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটেনি। সে যুদ্ধ ছিল একাকী ধৈর্য ধারণ, পুত্রের ওপর নির্যাতন সম্বরণের মর্মবেদনা। তার একমাত্র পুত্র বুলবুলের ওপর ছিল ভয়ঙ্কর ‘রাজ রোষ’ তথা স্বৈরাচারের আক্রোশ। অর্থাৎ জুলুম নির্যাতন, জখম, বাকি ছিল দেশান্তরী হওয়া। ঘরের বাইরে সম্মুখসমরে ছিলেন বুলবুল। গৃহ অভ্যন্তরে থেকেও অপরিসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম। দেশ থেকে চলে যেতে যখন বাধ্য হয়েছিলেন বুলবুল, তখন তার মা চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। অসুখ-বিসুখে ‘ভগ্ন স্বাস্থ্য’ নিয়ে পুত্রের জন্য একাকী বুলবুলের মা রাত-দিন একমাত্র ছেলের দেশে ফেরার অপেক্ষায় থেকে অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। তার এমন সব যুদ্ধের খবর পেতাম ছোট ভাই বাবলুর কাছ থেকে।

বুলবুলের লেখালেখি নিয়েও তাকে হাজারো বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সে কথা সবার জানা। এই লেখালেখি তথা দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক হিসেবেও দেশ ও দশের স্বার্থে মানুষের প্রতি ভালোবাসায় সাহসী ভূমিকার কারণে হুমকি ধমকিসহ তার শরীরের রক্ত ঝরেছে। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে বহু বিজ্ঞজন দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু স্বৈরাচার ও তার দোসরদের পাষাণ-হৃদয় কাঁপেনি।

বুলবুল আমার দেশ প্রকাশের আগে শহীদ মীর কাসেম আলীসহ আমাদের অনুরোধে নয়া দিগন্তে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে নয়া দিগন্তে পাঠকপ্রিয় কলামিস্ট হয়ে উঠেন। নয়া দিগন্তে লেখালেখির সময় সরকারের বিভিন্ন স্তর বিন্যাসের কাছে চোখের বালি হয়ে উঠেছিলেন এই তরুণ কলামিস্ট। বুলবুল ১/১১ এর সময় সাময়িক গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তদানীন্তন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমীন এক সন্ধ্যায় আমাদের জানালেন, মাহমুদুর রহমানের আর কোনো লেখা নয়া দিগন্তে ছাপা যাবে না। তারপর নয়া দিগন্তের বর্তমান নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী ব্রি. জেনারেল আমীনের সাথে যোগাযোগ করে পরদিন জনাব ফরহাদ মজহার, জনাব বুলবুল, জনাব খলিলী ও আমি কচুখেতে যাই। আলাপকালে জেনারেল আমীনের কাছে জনাব ফরহাদ মজহার প্রশ্ন রাখলেন, মাহমুদুর রহমানের কলামে যে লেখাগুলো প্রকাশ পায় তাতে কখনো কি রাষ্ট্রবিরোধী কথা থাকে। যদি থেকে থাকে সেটা অবশ্য পরিত্যাজ্য। তবে মাহমুদুর রহমানের লেখায় তেমন কিছু কি আপনারা পেয়েছেন? জেনারেল আমীন তখন নীরব রইলেন। সরকারের মন্দ কাজের সমালোচনা হয়তো লেখায় রয়েছে। তাহলে সরকারকে মন্দ কাজের জন্য কি কিছু বলা যাবে না? তখনো জেনারেল সাহেব নীরব। পরে জেনারেল আমীন এতটুকু শুধু বললেন, তিনি যেন, একটু রয়েসয়ে লেখেন। কিন্তু বুলবুল যতদিন নয়া দিগন্তে লেখার সময় পেয়েছেন, কখনো তেমন রয়েসয়ে লেখেননি।

বুলবুলের আরো একটি বিষয় আমাকে মুগ্ধ করে, সেটি তার স্পষ্টবাদিতা। সে কখনো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলেন না। রাষ্ট্র ও জনস্বার্থে কথা বলতে কখনো দ্বিধা বা আপস করেন না। এজন্য কেউ তার সমালোচনা করলেও এসবের তোয়াক্কা করেন না। এখানে একটা কথা যোগ করতে চাই। সমালোচনা নয় বরং তার সাহসিকতা নিয়ে আলোচনা করা উত্তম। আর একটি তথ্য- সেটা কেউ জানলেও জানতে পারেন। নয়া দিগন্ত প্রকাশে যখন সবে উদ্যোগ নিচ্ছিলেন শহীদ মীর কাসেম আলী ও তার সহযোগী কয়েকজন সাহসী সহযোগী উদ্যোক্তা; মীর কাসেম ভাই তখন বুলবুলকে বেশ কয়েকবার তার অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়ে দীর্ঘ আলাপ করেন।

বুলবুল দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পরও বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে, দেশের স্বার্থে পতিত স্বৈর সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা জারি রাখেন। তখন আশঙ্কা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী সংবাদিক কনক সরওয়ারের পরিবারের সাথে পতিত শেখ হাসিনা সরকার যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল, সেই রকম আচরণের শিকার বুলবুলের জননীর ওপর হতে পারত। তবে পুত্র ও জননীর তা নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না।