প্রথমেই অধিকার শব্দটির একটি সংজ্ঞা দেয়া যাক। অধ্যাপক লাস্কি বলেন, ‘অধিকার হচ্ছে সমাজজীবনের সেসব শর্ত যা ছাড়া ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে না।’ একই রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন টি এইচ গ্রিন। তার মতে, ‘অধিকার হলো সমাজের বাহ্যিক সেসব দিক বা শর্ত যা মানুষের আত্মিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন।’ অধিকারকে রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত করে অধ্যাপক বার্কার বলেন, ‘অধিকার হলো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও সামর্থ্য বিকাশের সেসব প্রয়োজনীয় বিষয় যা রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত ও নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত। মানুষ জন্মগতভাবেই কিছু অধিকার অর্জন করে। এই অধিকারগুলো সমাজ ও রাষ্ট্র নিশ্চিত করে।’ অধিকারের পরিধিও অনেক বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে নৈতিক অধিকার, আইনগত অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার।
নৈতিক অধিকার ব্যক্তিগত। আইনগত অধিকার আইনের সাথে সম্পর্কিত। আর রাজনৈতিক অধিকার রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। আমাদের আজকের বিষয়টি যেহেতু রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত, রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যেই আমাদের আলোচনা সীমিত থাকবে। রাজনৈতিক অধিকারেরও প্রকারভেদ আছে। রাজনৈতিক অধিকার হচ্ছেÑ ক. ভোটাধিকার প্রয়োগ : ভোটদানের অধিকার জন্মগত রাজনৈতিক অধিকার। সরকারব্যবস্থায় নাগরিকদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার অধিকার নিশ্চিত হতে পারে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। খ. নির্বাচিত হওয়ার অধিকার : প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার অধিকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্যতম অধিকার। নির্বাচিত হয়ে শাসনকার্যে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অধিকার ভোগ করা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত।
রাজনৈতিক অধিকারের তালিকা অনেক দীর্ঘ। সেগুলো আমাদের প্রাসঙ্গিক নয়। কোনোভাবেই এসব অধিকার একতরফা নয়। আমরা সবাই জানি অধিকার ও কর্তব্য একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, পরস্পরের পরিপূরক। কর্তব্যহীন অধিকার হতে পারে না। একজনের অধিকার অন্যের কর্তব্যের সাথে জড়িত। যদি একজনের অধিকার থাকে, ওই অধিকার সম্পর্কে ধরে নিতেই হবে যে, অন্যের কর্তব্য রয়েছে। এভাবেই রাষ্ট্র ও সমাজ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে। নির্বাচিত করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকারটি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিক সাধারণের যেসব সাধারণ কর্তব্য রয়েছে তার মধ্যে আরো রয়েছে রাষ্ট্রীয় সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখা। রাষ্ট্রের প্রদত্ত দায়িত্ব কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করা। রাষ্ট্রের যেকোনো দুর্যোগ বা সঙ্কটে নাগরিকের যথাযথ ভূমিকা কাঙ্ক্ষিত।
এসব তত্ত্বকথার অবতারণা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অধিকার সম্পর্কে কথা বলার জন্য। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই এ বিষয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার নিউ ইয়র্ক সফরের পর আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে যে মতামত এসেছে তা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। অবশেষে প্রেস নোট দিয়ে বক্তব্যটির ফয়সালা করতে হয়েছে। আমরা বুঝতে পারি একজন পাশ্চাত্যমুখী সাংবাদিক যখন কোনো সংবেদনশীল প্রশ্ন করেন তা পাশ্চাত্যের মূল্যবোধকেই ধারণ করে। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগকে পছন্দ না করলেও সরকারপ্রধান হিসেবে তাকে আনুষ্ঠানিক বা আইনানুগ জবাব দিতে হয়- এ কথা আমাদের বুঝতে হবে। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমানের আওয়ামী নির্বাচন সম্পর্কিত বক্তব্যও নাগরিক সাধারণ্যে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো তারেক রহমান কোনো গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাৎকার দিলেন।
সাক্ষাৎকারে জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ব্যাপারে নিজের ও দলের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তারেক রহমান আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘দেখুন, আমি ১৭ বছর ধরে প্রবাস জীবনে আছি। তথাকথিত ১/১১ সরকারের সময় যে শারীরিক নির্যাতন আমার ওপর হয়েছিল তারপরে চিকিৎসার জন্য আমি এ দেশে আসি। আমি যখন এখানে আসি আমি রেখে এসেছিলাম আমার ছোট ভাইকে। আমার সুস্থ মাকে রেখে এসেছিলাম। একটি ঘর রেখে এসেছিলাম। যে ঘরে আমি এবং আমার ছোট ভাই বড় হয়েছি। যেই ঘরে আমার বাবার স্মৃতি ছিল। যে ঘরে আমাদের দুই ভাইয়ের সন্তানরা জন্মেছিল। যে ঘরে আমার মায়ের বহু স্মৃতি ছিল। সেই স্মৃতিগুলো ভেঙেচুড়ে ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। যে ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম সেই ভাই এখন আর নেই। যে সুস্থ মাকে রেখে এসেছিলাম সেই সুস্থ মা এখন সুস্থ নেই। শুধু অসুস্থই নন, তার ওপরে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে।’
তারেক রহমান আরো বলেন, এটি প্রতিশোধের বিষয় নয়; বরং ন্যায়ের কথা। এটি আইনের কথা। অন্যায় হলে তার বিচার হতে হয়। কার সম্পর্কে কী মনোভাব সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এসব বাক্যের দ্বারা তারেক রহমান সঙ্গতভাবেই অন্যায়ের প্রতিকার চেয়েছেন। বিচারের ন্যায্যতার কথা বলেছেন। তার কথার মর্মার্থ দ্বারা আমরা এটা বুঝতে পারি যে, একটি বিচারিক প্রক্রিয়ার অবশেষে তিনি আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক অধিকার দিতে চান। এ সময় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারা-না পারার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে তারেক রহমান বলেন, ‘দল হিসেবে তারা যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। দেশের আইন সিদ্ধান্ত নেবে। সোজা কথায় অন্যায়কারীর বিচার হতে হবে। তো সেটি যে ব্যক্তি বা যে দলই হোক। যারা জুলুম করেছে তাদের তো বিচার হতে হবে।’ এ সময় আবারো ব্যক্তিগত অভিমত জানতে চাইলে তারেক রহমান বলেন, ‘আমার মনে হয় আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম যে, আমরা রাজনীতি করি জনগণের জন্য। আমরা বিশ্বাস করি এবং বিভিন্ন সময়ে বলিও- আমরা বিএনপি যারা করি, আমাদের রাজনৈতিক সব ক্ষমতার উৎস জনগণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করতে চাই- যে দলের ব্যক্তিরা বা যে দল মানুষ হত্যা করে, মানুষ গুম করে, মানুষ খুন করে, দেশের মানুষের অর্থসম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করে, জনগণ তাদের সমর্থন করতে পারে না।’ তারেক রহমান আরো বলেন, ‘জনগণ যদি সমর্থন না করে তাহলে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের টিকে থাকার কোনো কারণ আমি দেখি না। যেহেতু জনগণের শক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তে আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের সিদ্ধান্তের ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। আমি মনে করি, এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিচারক জনগণ।’
সঙ্গতভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিএনপির কর্ণধার তারেক রহমান সরাসরি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কথা না বলে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর সমাধান চেয়েছেন। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দল হিসেবে আওয়ামী লীগের গণহত্যার বিচারের কথা বলেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে বিচারিক ব্যবস্থা চলছে তা দ্রুতই শেষ হবে বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ট্রাইব্যুনাল জনগণকে নিশ্চিত করছে। দল হিসেবে নিপীড়ন-নির্যাতন, হত্যা ও গুমের বিচার হলে আইনানুগভাবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়ে পড়বে। তার আর নির্বাচন করার সুযোগ থাকবে না। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের এবং তারেক রহমানের প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, উভয় নেতা বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে চাইছেন। এখন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নয়, শুধু তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ। অথচ দাবি ছিল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক ভেবে চিন্তে এমন ব্যবস্থা নিয়েছেন, যাতে জনগণ তুষ্ট থাকে এবং পাশ্চাত্য ও প্রতিবেশী তুষ্ট থাকে। উভয় শক্তিকে তুষ্ট রাখার এই কাজটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে করতে হচ্ছে। নির্বাচনের ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশটির বক্তব্য ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছে।
ভারত বলেছে, ‘‘বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন কেবল অভ্যন্তরীণ বৈধতার জন্য নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বৈধতা নিশ্চিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের সম্পর্ক বহু পুরনো, সময় পরীক্ষিত এবং তা সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বন্ধনে দৃঢ়ভাবে চিহ্নিত। ভারত এই সম্পর্ককে ‘জনমুখী’ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে।’’ গত সোমবার দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়- সাউথ ব্লকে আয়োজিত বাংলাদেশ কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন- ডিক্যাব প্রতিনিধিদলের সাথে মতবিনিময়কালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারই আসুক তার সাথে ভারত কাজ করতে প্রস্তুত। নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হলে তা দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ পররাষ্ট্র সচিব কূটনীতির ভাষায় কথা বললেও অন্যত্র অন্য ভাষ্যে তাদের আসল কথা, মনের কথা প্রকাশ পাচ্ছে।
তবে সবচেয়ে বড় প্রতিজ্ঞা ও প্রতিরোধ আসতে হবে জনগণের পক্ষ থেকে। রাজনীতি দিয়েই রাজনীতির মোকাবেলা করতে হয়- এটি স্বতঃসিদ্ধ কথা। বিগত এক বছরে দেখা গেছে যে, যখনই যেখানে আওয়ামী স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে- বিচারালয় কিংবা সচিবালয়, জনগণ তথা ছাত্ররা তার মোকাবেলা করেছে। যেখানে যেখানে আওয়ামী লীগের উঁকিঝুঁকি দেখা যাচ্ছে সেখানেই গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠছে। মানুষ আওয়ামী লীগের দুষ্কৃতকারীদের এখনো ধরিয়ে দিচ্ছে। জনগণের মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত আওয়ামী ঘৃণা রয়েছে সেটিই নির্বাচনে তাদের প্রতিহত করতে যথেষ্ট। শোনা যাচ্ছে, সাবের হোসেন চৌধুরী বা তাজউদ্দীনের উত্তরাধিকার সূত্রে ‘বিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ’ গঠনের চিন্তাভাবনা চলছে। অথবা জাতীয় পার্টির ওপর আওয়ামী লীগ সওয়ার হওয়ার চিন্তা করছে। কোনোভাবেই জনগণ আওয়ামী লীগকে গ্রহণ করতে চায় না। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না তেমনি আওয়ামী লীগ যে নামে বা যে ধামেই অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করুক, জনগণের দ্বারা প্রতিহত হবে। আওয়ামী লীগকে কোনোভাবেই কোনোক্রমেই এই সময়ে ছাড় দেয়া যায় না। তারা সুযোগ পেলে আবারো রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার হিসেবে আবির্ভূত হবে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, যতদিন পর্যন্ত এই জেন-জি স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে জাগরূক থাকবে ততদিন আওয়ামী লীগের আগমন দুঃস্বপ্নই থেকে যাবে।
আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিএনপি-জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দল এক ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। আওয়ামী লীগ আর কোনোকালেই কোনোভাবেই ক্ষমতায় আসবে না- এটাই জাতীয় ঐকমত্য। আওয়ামী লীগের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি এ জন্য যে, আওয়ামী লীগ জন্ম থেকেই একটি ফ্যাসিবাদী শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। তারা কখনোই গণতন্ত্রকে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেনি। পাকিস্তান আমলে তারা যে গণতন্ত্রের কথা বলেছে বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার পর তাদের সে কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তারা ক্ষমতাসীন হয়েই মানুষ হত্যা করেছে। বাকশাল কায়েম করেছে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন থেকে ২০২৪ সালের আমি-ডামির নির্বাচন পর্যন্ত যা-ই করেছে সবই ফ্যাসিবাদী প্রবণতায় দুষ্ট। সুতরাং গণতন্ত্রবিরোধী, মানবতাবিরোধী ও স্বৈরাচারী কোনো শক্তিকে দ্বিতীয়বার আর গণতন্ত্র নস্যাতের সুযোগ দেয়া যায় না। এটাই জনগণের শেষ কথা। যারা অধিকার অস্বীকার করে, কর্তব্যের বিপরীত কাজ করে তাদের সাধারণ অধিকার থাকে না।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]