থাইল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী কিত্তিরাত না-রানোং দেখাতে চাইলেন, দেশের বার্ষিক রফতানি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। সেটি ১৫ শতাংশে দেখানোর জন্য তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলেন এবং সেটি প্রকাশ্যে স্বীকার করেন। তারপর থাইল্যান্ডে ব্যাপক হইচই পড়ে যায়। কিত্তিরাত দাবি করেন, ভালো অনুভূতি তৈরি করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে মাঝে মধ্যে মিথ্যা বলতে হয়। বিশ্ব একে ‘সাদা মিথ্যা’ হিসেবে জানে। এই মিথ্যার লক্ষ্য হলো আস্থা তৈরি করা, যা পুরো দেশের জন্য উপকারী।
পাকিস্তানেও একই রকম একটি ঘটনা সামনে আসে। যেখানে সরকার স্বীকার করে যে, তারা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তথ্য জমা দেয়ার ক্ষেত্রে টাইপো করে ৪.৩ শতাংশের পূর্ববর্তী ভাষ্যের বিপরীতে ৩.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান উল্লেখ করে।
এই তথাকথিত মানবিক ভুলের পেছনে সচেতন ইচ্ছা কাজ করেছে। সরকার সমালোচনা থেকে বাঁচতে এটি করলেও বাঁচতে পারেনি। অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা গোপন করার ফলে রাজনৈতিক বিরোধীদের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়েছে। শরিফের নেতৃত্বাধীন পিএমএল-এনের প্রতিদ্ব›দ্বী পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ দল ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে, তারা তথ্য গোপন করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিশেষাধিকার প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করবে। পাকিস্তান সরকারের এই স্বীকারোক্তি বিদেশী ঋণদাতা ও বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের কাছে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। যেহেতু ঋণের কিস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় প্রদত্ত সরকারি অর্থনৈতিক তথ্যের ভিত্তিতে, তাই আইএমএফ দেশের জন্য ভবিষ্যতের ঋণ দ্রুত অনুমোদনে অনিচ্ছা দেখাতে পারে। একইভাবে, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা দূরে সরে যেতে পারেন এবং সরকার আস্থা হারাতে পারে।
পাকিস্তানের গণমাধ্যম এই ঘটনাটিকে ছোট করে দেখিয়েছে। কিন্তু এটি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে আরো বিস্তৃত সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। সেখানে শক্তিশালী জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার অভাব তীব্র। রাজনৈতিক অভিজাতরা যেকোনো সময় জনসাধারণের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারছেন এবং বিশ্বপরিমণ্ডলে দেশের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। এটি একটি সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং অগ্রহণযোগ্যের মধ্যে সীমারেখা অস্পষ্ট করে দেয়। সাধারণের কাছে যা ভুল তা পরিত্যাগ করা উচিত।
রাজনৈতিক সুবিধা লাভ এবং জনসাধারণকে প্রতারিত করার জন্য তথ্যের ভুল উপস্থাপন একটি জঘন্য কাজ যা শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকারের রাজনৈতিক নৈতিকতাকে আঘাত করেছে। পাকিস্তান বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে এবং চরমপন্থা, বিদ্যুৎসঙ্কট ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দাবি করছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো- তারা কি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পেতে পারবে, নাকি ‘সাদা মিথ্যাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকবে?
কিন্তু ব্যাপারটি কোনো দেশের বা কয়েক দেশের সমস্যা নয়।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের শর্তাধীন ঋণ (Structural Adjustment Programs) আফ্রিকার বহু দেশেই অর্থনৈতিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। ঘানা, নাইজেরিয়া, জাম্বিয়া প্রভৃতি দেশে সরকার বাস্তব মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের পরিসংখ্যান কম দেখায়। কারণ, ঋণদাতারা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির কাগুজে ছবি না পেলে ঋণের কিস্তি ছাড় দিত না। আশি-নব্বইয়ের দশকে জাম্বিয়া সরকার আইএমএফকে সন্তুষ্ট করার জন্য কাল্পনিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখায়। পরে স্থানীয় গবেষণা সংস্থা (Zambia Economic Association) সত্যটা প্রকাশ করে। দেখা যায়, প্রকৃত প্রবৃদ্ধি অনেক কম ছিল।
লাতিন আমেরিকায় তথ্য বিকৃতির রাজনীতি বিশেষভাবে দৃশ্যমান। আর্জেন্টিনার (২০০৭-১৫) কির্চনার সরকারের আমলে সরকারি পরিসংখ্যান দফতর ওঘউঊঈ ইচ্ছাকৃতভাবে মুদ্রাস্ফীতি কম দেখাতো। এ জন্য আইএমএফ আনুষ্ঠানিকভাবে আর্জেন্টিনাকে ‘পবহংঁৎবফ’ করেছিল।
মাদুরো সরকারের সময় ভেনিজুয়েলায় তেলের আয়ের পতন হয়। কিন্তু সরকার প্রবৃদ্ধির কাগুজে হিসাব দেখায়। আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা পরে সেই তথ্য ভুয়া প্রমাণ করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রীয় সংস্থা চবঃৎড়নৎধং-এর আর্থিক কেলেঙ্কারির তথ্য চাপা দেয়া হয় ব্রাজিলে।
এতে বোঝা যায়, আইএমএফের শর্ত আর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ফলে রাষ্ট্র মিথ্যা পরিসংখ্যানের দিকে ধাবিত হয়।
আইএমএফের ঋণ পেতে হলে বাজেট ঘাটতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে ইতিবাচক রিপোর্ট দরকার। তাই মিসরের অর্থ মন্ত্রণালয় প্রায়ই প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখায়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা পরে বলেছেন, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব আসলে রিপোর্টের চেয়ে অনেক বেশি।
ইরাকে, ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের সময় বলা হয়েছিল, সাদ্দামের কাছে ডবধঢ়ড়হং ড়ভ গধংং উবংঃৎঁপঃরড়হ (ডগউ) আছে। মার্কিন সরকার এই ভুয়া তথ্য জাতিসঙ্ঘে হাজির করে যুদ্ধের বৈধতা দেয়। পরে প্রমাণ হলো- কোনো অস্ত্র ছিল না। কিন্তু এর ফলে এটি দেশ ধ্বংস হয়ে গেল। পশ্চিমারা মিথ্যার আশ্রয়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করল, তাকে উদযাপনও করল। টনি বেøয়ার সরকার বলেছিল, ইরাক ৪৫ মিনিটে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে।
পাশ্চাত্য নিজের ঘরে ঠিক সেই কৌশলই ব্যবহার করে যা তারা দক্ষিণ এশিয়া বা আফ্রিকায় শেখায়।
২০০৮ সালে আমেরিকায় বড় বড় ব্যাংক ও ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো সাবপ্রাইম মর্টগেজকে নিরাপদ দেখিয়ে ভুয়া রেটিং দেয়। এতে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, অথচ দায় এড়াতে বলা হয়, অপ্রত্যাশিত বাজার ব্যর্থতা ঘটেছে। এর মানে পরিষ্কার। তথ্য বিকৃতির রাজনীতি কেবল উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা নয়; বরং পশ্চিমা শক্তিগুলোও ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা চাপিয়ে দেয়।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ‘মেক-আপ পরিসংখ্যান’ তৈরি করতে শেখায়। জনগণের সামনে রাজনৈতিক নৈতিকতা ধসে পড়ে-রাষ্ট্র সত্য বলার দায় ভুলে যায়। দীর্ঘমেয়াদে এটি রাষ্ট্রকে দুর্বল করে, আর রাষ্ট্রকে পরিণত করে এক ঢ়ড়ংঃ-ঃৎঁঃয ঢ়ড়ষরঃু-তে, যেখানে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বিলীন হয়ে যায়।
কিন্তু রাষ্ট্রচালনা ও রাজনীতিতে এই যে সাদা মিথ্যা, এর অর্থ কী? এর অর্থ তালাশ করলে আমরা দেখব বহুস্তরীয় অবনতি। যেমন-
১. রাজনীতি একসময় মানুষের কল্যাণ, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন, নীতির প্রয়োগ ও রাষ্ট্রের সঠিক পরিচালনার জন্য নিবেদিত ছিল। এখন রাজনীতি ক্রমশ ক্ষমতা অর্জন ও ধরে রাখার কৌশলে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। নৈতিকতা এখানে গৌণ হয়ে গেছে।
২. আজকের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে বিভ্রান্ত করতে তথ্য বিকৃত করে, অর্ধসত্য ছড়ায়, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে, সামাজিক মাধ্যমকে অনৈতিক অনুশীলনের হাতিয়ার বানায়। ম্যাকিয়াভেলি বলেছিলেন, রাজনীতির সাথে নীতির কোনো সম্পর্ক নেই- এই ধারণাই বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে।
৩. রাজনীতিকে ব্যবসায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। অর্থ, করপোরেট লবি, দাতাগোষ্ঠী- সব কিছুই নীতিকে চাপা দিয়ে স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে মানুষের কল্যাণ নয়, গোষ্ঠীর মুনাফা অর্জনই মুখ্য হয়ে উঠছে।
৪. যখন সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, মিথ্যা বলে, দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়- তখন জনগণের চোখে রাজনৈতিক নৈতিকতা নিছক মরা লাশ। মানুষ মনে করে রাজনীতিবিদরা নীতিহীন, তারা শুধু ক্ষমতার জন্য নাটক করেন।
৫. ইতিহাসে আমরা দেখেছি কিছু নেতা নৈতিকতার প্রতীক ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক নৈতিকতা ধীরে ধীরে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান দুনিয়ায় রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা পশ্চিমা একাধিপত্যের শিকার। পশ্চিমা দেশগুলো রাজনীতিকে নৈতিকতাবিচ্ছিন্ন চর্চায় পরিণত করেছে। তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও স্বচ্ছতার বুলি তোলে কিন্তু নিজেদের স্বার্থে এ নীতিগুলোকে অগ্রাহ্য করে।
তারা সামরিক শাসনের বিরোধী, গণপ্রতিনিধিত্বে বিশ্বাসী। কিন্তু মিসরে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো সিসিকে সমর্থন দেয়। তারা বিভিন্ন দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রণধ্বনি উচ্চারণ করে নানা পদক্ষেপ নেয়। আবার স্থিতিশীলতা বজায় রাখার নামে বহু দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারকেও সমর্থন দেয়, যদি সেই সরকার তাদের স্বার্থ রক্ষা করে।
তারা গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক আইনের অনুশীলন প্রশ্নে সোচ্চার। কিন্তু ইসরাইল প্রতি মুহূর্তে সেগুলো পদদলিত করছে, তাতে নির্বিকার। শুধু নির্বিকার নয়; বরং একে পৃষ্ঠপোষকতা করছে নির্লজ্জভাবে। এতে বিশ্বব্যবস্থায় রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। পশ্চিমারা দেখাচ্ছে, তারা যাকে সমর্থন করে, সে-ই টিকে যাবে। আইন, বিবেক, সত্য-মিথ্যা, নৈতিকতা-অনৈতিকতা কোনো বিষয়ই নয়।
পশ্চিমারা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, রেটিং এজেন্সির মতো প্রতিষ্ঠান দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা জানে, সরকারগুলো প্রকৃত অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ করলে জনগণ অসন্তুষ্ট হবে। তাই তারা সাজানো পরিসংখ্যান মেনে নেয়। এতে স্থানীয় সরকারগুলো শেখে যে মিথ্যা বলা যায়, কারণ পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো তা জানলেও চুপ থাকে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী রেজিম এই মিথ্যার অনুশীলন করেছে ভয়াবহ ধরনে। পশ্চিমারা চায় এখানে রাজনৈতিক বিকাশ না ঘটুক এবং নৈতিকতার অনুশীলন নিয়মে পরিণত না হোক। তাতে সরকারগুলোর দুর্নীতি ও তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ একই সাথে চলমান থাকবে।
পশ্চিমা মিডিয়া দক্ষিণ এশিয়া বা মুসলিম বিশ্বের ঘটনাকে এমনভাবে কাভার করে, যাতে রাজনৈতিক নৈতিকতার মৃত্যু আরো গতি পায়। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলোর বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনকে অনেক সময় তারা অস্থিতিশীলতা হিসেবে দেখায়। কিন্তু সরকার মিথ্যা বললে সেটি প্রচার না করে ছোটখাটো ভুল বা টাইপো হিসেবে ফ্রেম করে। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে অনৈতিক শাসকেরা বিপদে পড়ে না, আশকারা পেয়ে যায়। আবার সেই শাসকদের যখন তারা চাপ দিতে চায়, তখন তথ্যগুলোকে এমনভাবে হাজির করা হয়, যেন তারা অপরাধী বলে চিত্রিত হয়।
সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির এই খেলা বহু পুরনো এবং ম্যাকিয়াভেলির দর্শনের প্রতিফলন। ম্যাকিয়াভেলির রাজনীতি থেকে শুরু করে আধুনিক পশ্চিমা পলিসি থিওরিগুলো বলতে গেলে এক ধরনের বার্তা দেয়। সেটি হলো নৈতিকতা ছাড়া রাজনীতি সম্ভব; বরং মাঝে মধ্যে মিথ্যা বলাই বুদ্ধিমত্তা। এই ধারণাকে উন্নয়নশীল দেশের শাসকরা নিজেদের বৈধতার জন্য ব্যবহার করে।
থাইল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী যে বলেছেন, ‘সাদা মিথ্যা’র দরকার আছে, এ শব্দটিই পশ্চিমা দর্শন থেকে ধার করা।
মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রে এ ধরনের সাদা মিথ্যার উপর দাঁড়ানো সরকার সবল হতে পারে না। তারা রাষ্ট্রকেও দুর্বল করে রাখে। পশ্চিমা শক্তি অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল রাষ্ট্রকাঠামো টিকিয়ে রাখে। কারণ দুর্বল রাষ্ট্র মানে সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য রাষ্ট্র। ফলে রাজনৈতিক নৈতিকতার মৃত্যু সাম্রাজ্যবাদের অভিপ্রায়। এটি পশ্চিমাদের জন্য এক ধরনের নিয়ন্ত্রক হাতিয়ার।
সাদা মিথ্যাকে যদি তত্ত¡ীয় চোখে দেখা হয়, তবে তিনটি বড় প্রশ্ন সামনে আসে :
প্রথমত, সত্য বনাম মিথ্যার ড়হঃড়ষড়মরপধষ (অস্তিত্বগত) প্রশ্ন : সত্য কি নিজেই একটি মূল্যবোধ, নাকি কেবল রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহারযোগ্য একটি উপকরণ? প্লেটো মনে করতেন, রাষ্ট্রনেতার দায়িত্ব সত্যকে ধারণ করা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা। তার রিপাবলিকে মহৎ মিথ্যা (হড়নষব ষরব) ধারণা এসেছে কিন্তু সেটি ছিল রাষ্ট্রের ভিত্তিকে ন্যায় দিয়ে দৃঢ় করার জন্য, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নয়। অন্যদিকে, ম্যাকিয়াভেলি বলেছিলেন, রাজনীতির অবস্থান নীতির বাইরে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা গেলে মিথ্যা বা প্রতারণাও গ্রহণযোগ্য। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো এই দর্শনই অনুসরণ করছে।
কিন্তু মুশকিল হলো- যে মিথ্যা রাষ্ট্রকে সাময়িক স্থিতি দেয়, সেটি তো টেকসই হতে পারে না। মিথ্যা সর্বদা সত্যের ক্ষয় ঘটাতে ঘটাতে রাষ্ট্রকে দুর্বল করে ফেলে।
দ্বিতীয়ত, নৈতিকতার দ্ব›দ্ব : কর্তব্য নাকি ফলাফল?- নৈতিক দর্শনে দু’টি প্রধান ধারা আছে। কান্টের কর্তব্যবাদ বা উবড়হঃড়ষড়মু এক ধারা। যা বলে, মিথ্যা বলা সর্বদাই ভুল, কারণ এটি মানুষের স্বাধীন বিচারবুদ্ধিকে অসম্মান করে। কোনো কারণেই মিথ্যা বৈধ হতে পারে না।
আরেক ধারা হলো- উপযোগবাদ বা টঃরষরঃধৎরধহরংস। সে বলে, ফলাফল ভালো হলে মিথ্যা গ্রহণযোগ্য। যদি রাষ্ট্র মিথ্যা বলে জনগণকে আশাবাদী করে তোলে, তবে তা নৈতিকতার মধ্যে পড়ে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই ফলাফলের যুক্তি (যা মন্ত্রীরা তুলে ধরেন) আসলে স্বল্পমেয়াদি।
তৃতীয়ত, হাবারমাস ও যোগাযোগের ন্যায়নীতি : সমাজসংহতি ও রাষ্ট্র যোগাযোগমূলক যুক্তিবোধ ও সংহতির উপর দাঁড়ায়। শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থ বা কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য তা গঠিত হয় না; বরং কল্যাণভিত্তিক, মুক্ত ও বিকৃতিহীন আলোচনার মাধ্যমে পারস্পরিক বোঝাপড়া অর্জনের উদ্দেশ্যে সামাজিক সংহতি পরিচালিত হয়। এখানে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী যুক্তি দেবে, শোনাবে এবং আলোচনায় সংশোধনের জন্য প্রস্তুত থাকবে। যুক্তির ভিত্তি হতে হবে সত্য ও নীতিনির্ভর। সে দাঁড়াবে বাস্তবতার উপর, কেবল শক্তি বা প্ররোচনার উপর নয়। এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী সবাই সত্য (ঃৎঁঃয), সঠিকতা (ৎরমযঃহবংং), ও আন্তরিকতার (ংরহপবৎরঃু) দাবি করতে পারে এবং তাদের সত্য, সঠিকতা ও আন্তরিকতাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে। কারণ তাকে তা প্রমাণ করতে হবে। এর মানে হলো- রাষ্ট্রসংহতি স্বচ্ছ, সত্যনিষ্ঠ ও সমতাভিত্তিক সংলাপে অগ্রসর হবে। রাষ্ট্র যদি মিথ্যাকে স্বাভাবিক বানায়, তবে এই যোগাযোগমূলক সংহতি ভেঙে যায়। নাগরিকরা আর বিশ্বাস করে না, ফলে গণতন্ত্র কেবল ফাঁকা কাঠামো হয়ে দাঁড়ায়। আর এটিই দেখা যাচ্ছে।
আমরা জানি, ক্ষমতা সর্বদাই জ্ঞান নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্র যখন তথ্য বিকৃত করে, তখন শুধু অর্থনীতির পরিসংখ্যানে সংখ্যা বদলায় না; আসলে ‘সত্য’ কী, সেটির সংজ্ঞাই শাসকের হাতে চলে যায়। ফলে সাদা মিথ্যা আর ছোটখাটো ভুল থাকে না; এটি হয়ে ওঠে এক শক্তির প্রযুক্তি, যা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইতিহাসে পতনের কালে প্রতিটি সভ্যতা মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে টেকসই হতে চেয়েছে কিন্তু টেকেনি।
লেখক : কবি, গবেষক