জ্ঞান মানুষের অস্তিত্ব ও জীবনবোধের প্রাথমিক ভিত্তি। আমরা জেনে, বুঝে, বিচার করে সিদ্ধান্ত নিই। সবই জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। প্রশ্ন হলো, এই জ্ঞান কোথা থেকে আসে এবং কিভাবে স্থায়ী ও সর্বজনীন সত্যের সাথে যুক্ত হয়। জ্ঞানতত্ত¡ এই অনুসন্ধানের মূল হাতিয়ার। জ্ঞানতত্তে¡র জরুরত বহুমুখী। সে জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে; আমাদের অভিজ্ঞতা, যুক্তি, নৈতিকতা, অন্তর্দৃষ্টি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করতে সহায়তা করে। সে পরীক্ষা করে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সীমা, স্থায়িত্ব, নৈতিকতা এবং মানববোধের গভীরতা।
পশ্চিমা জ্ঞানতত্তে¡র গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হলো ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক ও স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ (ঊসঢ়রৎরপরংস)। এটি দাবি করে, চোখে দেখা, কানে শোনা, ত্বকে স্পর্শ করা ইত্যাদির মতো অভিজ্ঞতা হচ্ছে জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক উপাদান।
জন লক বলেন, মানুষ কোনো সহজাত ধারণা বা নৈতিকতা নিয়ে জন্মায় না। মানুষের মন যেন এক খালি, সাদা পাতা (ঃধনঁষধ ৎধংধ)। কিছুই সেখানে লেখা থাকে না। তারপর ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের সব লিখন তৈরি করে। এর মাধ্যমে লক মানব চেতনাকে অভিজ্ঞতার জন্য একটি শূন্যস্থান হিসেবে হাজির করেন। তার মতে অভিজ্ঞতাই (বীঢ়বৎরবহপব) জ্ঞান উৎপাদনের একমাত্র মাধ্যম। আমাদের দর্শন, ধারণা, নৈতিক বোধ এবং জ্ঞান- সবই ধীরে ধীরে জীবন ও পরিবেশের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে তৈরি হয়। এই ধারণা জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে এক মৌলিক দিক নির্দেশ করে। অর্থাৎ, জ্ঞান কোনো জন্মগত বা আধ্যাত্মিক ভিত্তি থেকে আসে না; বরং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। এটিই ইম্পিরিসিজমের মূল ভিত্তি।
ডেভিড হিউম দাবি করেন, সব জ্ঞানের উৎস ওসঢ়ৎবংংরড়হ বা অভিজ্ঞতা এবং ধারণা বা ওফবধ। ইম্প্রেশনকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করি। এটি ইন্দ্রিয়ের জীবন্ত, তীব্র অভিজ্ঞতা। যেমন সূর্যের তাপ অনুভব করা, লাল রঙ দেখা, রাগ অনুভব করা। আইডিয়া হচ্ছে ইম্প্রেশনের স্মৃতি বা প্রতিফলন। যেমন- সূর্যের কথা মনে করা, রাগের ধারণা করা। এর মানে হলো, প্রতিটি আইডিয়া কোনো না কোনো অভিজ্ঞতার অনুলিপি। জ্ঞান আসে অভিজ্ঞতার হাত ধরে। চোখে যা দেখি, কানে যা শুনি, ত্বকে যা ছুঁই- এসবই সত্যের দরজা।
কিন্তু সত্য কি কেবল এতটুকুই?
ক. জ্ঞানের উৎস হিসেবে কেবল অভিজ্ঞতাকে চিহ্নিত করার বিপদ অনেক। এটি মানুষের অন্তর্নিহিত চিন্তা ও জ্ঞানকে অস্বীকার করে। অভিজ্ঞতা পরিবর্তনশীল ও অনিশ্চিত; তাই জ্ঞানের ভিত্তি স্থায়ী থাকে না, স্থায়ী হতে পারে না। তাহলে জ্ঞান কি শুধু পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতার পেছনে দৌড়ানো এক ক্লান্ত পথিকের নাম?
আমি দেখি, শুনি, স্পর্শ করি। কিন্তু সেই দেখা-শোনার মধ্যে কতখানি অন্ধকার, কতখানি মায়া! আমার অভিজ্ঞতা সীমিত, আমার দৃষ্টির পরিধি ক্ষণস্থায়ী। আজ যা সত্য মনে হয়, কাল তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। একই সূর্যাস্ত একদিন মনে হয় লালচে, অন্য দিন কমলা। একজন মানুষ ঠাণ্ডা পানিতে হাত ডুবাল। তারপর গরম পানি স্পর্শ করল। তখন সাধারণ গরম পানিও খুব গরম মনে হবে। মানে, ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা ব্যক্তি-ভেদে আলাদা এবং পরিস্থিতি-ভেদে ভিন্ন হয়, এমনকি সময়-ভেদে পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতার ওপর অপরিবর্তনশীল সত্যজ্ঞানের ভিত্তি নির্মাণ কিভাবে সম্ভব? কিভাবে সেই জ্ঞান স্থায়ী হবে? কী করে হবে সর্বজনীন?
পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতায় যে নিশ্চয়তা খোঁজে, সে চাঁদের আলোয় দুপুরকে ধরতে চায়। ইন্দ্রিয়ের জানালা ছোট। এতে সত্য নামক মহাবিশে^র ক্ষুদ্র অংশই দেখা যায়।
খ. অভিজ্ঞতা তথ্য দেয়; কিন্তু জ্ঞান তৈরি করে না। জ্ঞানে উপনীত হয় মন। সে তথ্যকে শ্রেণীবদ্ধ করে, বিশ্লেষণ করে। আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা বোধশক্তির কিছু স্থায়ী কাঠামো রয়েছে, যা অভিজ্ঞতার বাইরে অবস্থান করে। কিন্তু তারা অভিজ্ঞতাকে দেয় অর্থ ও সত্যবোধ। অভিজ্ঞতা নিজের তরফে যতটা আলোকিত, তার চেয়েও বেশি আলোকিত এমন সব বোধ থেকে, যা অভিজ্ঞতা নয়।
কিন্তু ইম্পিরিসিজম আমাদের মানসিক গঠন ও বোধশক্তির ভূমিকা অস্বীকার করে। আমরা আকাশে তারা দেখি। তারা যার যার মতো। আমাদের মন নক্ষত্র দেখে গঠন করেছে নক্ষত্রমণ্ডলের ধারণা। এক তারা থেকে আরেক তারার দূরত্ব যাচাই করে আমাদের মন। চোখ কেবল আলোর বিন্দু দেখে। আলোকবিন্দুগুলোর সম্পর্ক, দূরত্ব এবং নকশা সাজায়। তথ্য বা অভিজ্ঞতা নিজে কিছু বলে না। সিদ্ধান্ত দেয় না, সত্য স্থির করে না। মন তাকে কাঠামো দেয়। সময়ের প্রশ্নে, স্থানের প্রশ্নে কারণ ও ফলাফলের প্রশ্নে অভিজ্ঞতা আমাদের মন ও মস্তিষ্কের মুহতাজ (মুখাপেক্ষী)।
গ. অভিজ্ঞতা কী জানায়? সে জানাতে পারে কেবল যা আছে তাকে। কী সে জানে না বা জানাতে পারে না? সে জানাতে পারে না যা হওয়া উচিত (ড়ঁমযঃ) তাকে। তাহলে বিষয় জানলাম, উচিত-অনুচিত জানলাম না, এই জানা কতটুকু জ্ঞান হতে পারল? যেহেতু নৈতিক জ্ঞান ও মূল্যবোধ অভিজ্ঞতা থেকে জন্মে না, তাই ইম্পিরিসিজম নৈতিক জ্ঞান বা আদর্শকে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
মানুষ মিথ্যা বলে, হত্যা করে, প্রতারণা করে। এই দেখাটা হলো অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার তথ্য। কিন্তু এ থেকে আমরা কখনো নৈতিক সিদ্ধান্ত জানতে পারি না। মানে, অভিজ্ঞতা বলে না যে, মানুষের মিথ্যা বলা উচিত নয় বা হত্যা করা অনৈতিক। কী হওয়া উচিত বা উচিত নয় সেটি জানা আমার বেশি দরকার।
ঘ. আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি তার বেশির ভাগই আইডিয়া বা ধারণা। আইডিয়া হিসেবে যা অস্তিত্বশীল, বাইরের বাস্তবতায় তার অস্তিত্বের নিশ্চয়তা নেই। ইম্পিরিসিজম যেহেতু বাস্তবতা খোঁজে অভিজ্ঞতায়, ফলে বাস্তবতার মানে দাঁড়ায় শুধু মানসিক ধারণা।
এতে একটি অস্তিত্ববাদী সঙ্কট জন্মায়। আমরা ধারণা করি, আমাদের অভিজ্ঞতায় ধরা পড়া জিনিসগুলো বাস্তব; কিন্তু বাস্তবের সাথে আমাদের ধারণার মিল সর্বদা নিশ্চিত নয়। যেমন- আমরা কল্পনা করি পৃথিবী খুব সুন্দর কিংবা বিদ্যমানকে অনুভব করি। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা শুধুই ইন্দ্রিয় ও মস্তিষ্কের মধ্যবর্তী প্রতিফলন। বাস্তবতার অস্তিত্ব আমাদের ধারণার বাইরে থাকতে পারে, অর্থাৎ- আমরা যা জানি তা প্রায়ই চেতনার অভ্যন্তরীণ খেলার ফল।
এখানেই চেতনা ও অবচেতন মনের গুরুত্ব প্রবলভাবে উঠে আসে। চেতনা ও অবচেতন মন জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার; কিন্তু তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা প্রায়ই সেই গভীর স্তরে পৌঁছায় না। অনেক নৈতিক বোধ, অন্তর্দৃষ্টি, সৃজনশীল ধারণার জন্ম হয় ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার বাইরে, তাদের অবস্থান অভিজ্ঞতার সীমার বাইরে। কিন্তু ইম্পিরিসিজম এই সমস্ত অন্তর্দৃষ্টি, অন্তর্জগৎ ও অবচেতন মনকে অন্ধকারে রেখে শুধু বাহ্যিক অভিজ্ঞতার আলোকে জ্ঞান নির্ধারণের চেষ্টা করে।
ইম্পিরিসিজম মানুষের অন্তর্জগতের জটিলতা ও অস্তিত্বের গভীরতা স্বীকার করতে ব্যর্থ এবং এই সীমাবদ্ধতার কারণে জ্ঞানকে আপেক্ষিক, অসম্পূর্ণ হিসেবে দেখে এবং প্রায়ই অন্ধকার এলাকায় অন্ধকারের আবর্তন হিসেবে উপস্থাপন করে।
ঙ. কিছু জ্ঞান এমন যা অভিজ্ঞতা ছাড়াই জানা যায়, যেমন- গণিত, যুক্তিবিদ্যা, নৈতিক সত্য। এগুলো যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব। ইম্পিরিসিজম যুক্তির স্বকীয় ও বাস্তব ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করে।
ধরা যাক, আমরা বলছি ২+২=৪।
এই যোগফল কেউ অভিজ্ঞতা থেকে শেখে না। আমরা চারটি পাথর দেখে বুঝতে পারি ‘চার’ মানে কী। কিন্তু ২+২=৪ এই সমীকরণটি অভিজ্ঞতা নয়; বরং যুক্তি, গাণিতিক বিন্যাস যুক্তির অন্তর্গত।
আরেকটি উদাহরণ টানতে পারি। একই সময়ে এক বস্তু একই স্থানে দুই অবস্থায় থাকতে পারে না। এ হচ্ছে বিরোধ-বর্জন নীতি। এটি সত্য এবং যুক্তির মৌলিক সত্য, অভিজ্ঞতা থেকে তা অর্জিত নয়। নৈতিক উদাহরণও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যায়ের চেয়ে ন্যায় উত্তম। এই নৈতিক ধারণা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, এটি চেতনার অন্তর্গত বোধ। এগুলো অভিজ্ঞতাহীন অথচ অপরিহার্য জ্ঞান। ইম্পিরিসিজম এদের ব্যাখ্যা করতে পারে না।
চ. বিজ্ঞানের তত্ত¡গুলোকে শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রমাণ করা যায়? না, যায় না। কারণ কোনো পরিমাণগত তথ্য থিউরিকে ‘চূড়ান্তভাবে সত্য’ সাব্যস্ত করে না। বিজ্ঞান কাজ করে ভধষংরভরধনরষরঃু নীতিতে, অর্থাৎ- তত্ত¡কে ভুল প্রমাণের সম্ভাবনাই সেটিকে বৈজ্ঞানিক করে তোলে। ইম্পিরিসিজম পর্যবেক্ষণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল। সে বিজ্ঞানের মৌলিক পদ্ধতিগত সত্য হারায়। বিজ্ঞান কোনো তত্ত¡ চূড়ান্ত করার জন্য অভিজ্ঞতাকে চূড়ান্ত মাধ্যম বানায় না।
বহু বছর ধরে মানুষ দেখেছে, সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিক থেকে ওঠে। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সবাই বিশ্বাস করেছে, ‘সূর্য সবসময় পূর্ব দিক থেকেই উঠবে’। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করতে পারে না যে, একদিন সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উঠবে না। অর্থাৎ- হাজার অভিজ্ঞতাও একটি তত্ত¡কে ‘চূড়ান্ত সত্য’ বানাতে পারে না। একটি ব্যতিক্রমই সেটিকে ভেঙে দিতে পারে।
আরেকটি উদাহরণ হতে পারে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত¡, যা অভিজ্ঞতায় মাপা নিউটনীয় পদার্থ বিজ্ঞানের অনেক ধারণা খণ্ডন করেছে।
তাহলে বৈজ্ঞানিক থিউরির হাতে অভিজ্ঞতা তো বদলে গেল। তাহলে আগের অভিজ্ঞতা কি মিথ্যা ছিল? হ্যাঁ, সে ছিল নিছক অভিজ্ঞতা। বৈজ্ঞানিক সত্য নয়। এভাবেই ইম্পিরিসিজমের অভিজ্ঞতা-নির্ভরতা বিজ্ঞানকেও অনিশ্চিত করে তোলে।
ছ. অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জ্ঞান গঠন মানে ভাষাকে অভিজ্ঞতার প্রতিফলন মনে করা। কিন্তু ভাষা নিজেই এক সামাজিক খেলা। তাই অভিজ্ঞতা দ্বারা ভাষার অর্থ নির্ধারণ সম্ভব নয়। ইম্পিরিসিজম ভাষার প্রেক্ষিত-নির্ভরতাকে অগ্রাহ্য করে। ভাষায় ‘অর্থ’ কোনো বস্তু বা অভিজ্ঞতার সাথে জড়িত নয়; বরং তা নির্ধারিত হয় ভাষার ব্যবহারে।
যেমন, ‘খেলা’ শব্দটি শিশুদের মাঠে খেলার অর্থ দেয়, রাজনীতিতে কৌশলের অর্থ দেয়, প্রেমের ক্ষেত্রে ছলনার অর্থ দেয়। অভিজ্ঞতা দিয়ে শব্দের অর্থ ধরতে গেলে এই ভিন্নতার ব্যাখ্যা অসম্ভব। ভাষার অর্থ গঠন করে অভিজ্ঞতার বাইরের এক সামাজিক ও প্রাগনির্ধারিত রূপ।
জ. অভিজ্ঞতা ‘বিশুদ্ধ’ নয়, তা সর্বদাই অস্তিত্বের প্রেক্ষাপটে ঘটে। মানুষ শুধু পৃথিবীতে আছে, তা নয়। পৃথিবীও মানুষের সাথে আছে। মানে পরস্পরের মধ্যে পরস্পরে বাস করছে।
কেউ সমুদ্র দেখে ‘সৌন্দর্য’ অনুভব করে, কেউ অনুভব করে ‘ভয়’। অর্থাৎ- অভিজ্ঞতা কেবল চোখের দেখা নয়, অস্তিত্বের অবস্থান অনুযায়ী পরিবর্তিত হচ্ছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে সূর্যোদয় দেখলে একজন সৈনিকের যে প্রতিক্রিয়া হয়, সাধারণ ভ্রমণে সেই প্রতিক্রিয়া হয় না। একই সূর্যোদয় একজন কৃষক দেখলে একরকম অনুভব ও আয়োজন তার মধ্যে কাজ করছে, একজন কর্মকর্তার মধ্যে কাজ করে ভিন্ন অনুভব ও আয়োজনের তাড়া, কবির কাছে এটি ভিন্ন অর্থ হাজির করে।
কারো অভিজ্ঞতা স্থায়ী নয়, ‘বিশুদ্ধ’ নয়। কারণ যার যার অস্তিত্ব, মানসিক অবস্থা ও ইতিহাস দ্বারা প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা প্রভাবিত। ফলে অভিজ্ঞতা আপেক্ষিত, ভিন্নতামুখর ও প্রেক্ষিতনির্ভর। সে ধ্রুব নয়, নিরপেক্ষ নয়, সবার জন্য যথাযথ নয়।
আবার জ্ঞানের অভিজ্ঞতা সমাজ, ইতিহাস ও ক্ষমতার কাঠামোর দ্বারা নির্ধারিত। জ্ঞান কখনো সমাজের বাইরে তৈরি হয় না; বরং জ্ঞান ও ক্ষমতা একে অপরকে তৈরি করে।
অতএব, অভিজ্ঞতার কোনো ‘সর্বজনীন সত্য’ নেই। সে সর্বদাই সমাজ ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়। তাই অভিজ্ঞতাকে স্থায়ী, সর্বজনীন ও নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তি স্থির করা যায় না।
ঝ. স্থায়ী, সর্বজনীন ও নিশ্চিত জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বহুস্তরী উৎস জানা। এর কেন্দ্রে আছে জগতস্রষ্টার সৃষ্টি ও পরিচালনার নীতি এবং প্রক্রিয়া। যার বিকাশ ঘটে জীবন ও জগতে। অতএব, প্রথমত ওহি ও ফিতরাত জরুরি, হৃদয়ের অন্তর্দৃষ্টি ও তথ্যের বিন্যাস জরুরি। যুক্তিপ্রক্রিয়া ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় জরুরি।
যুক্তি দেহ, অভিজ্ঞতা ইন্দ্রিয়, হৃদয় হচ্ছে উভয়ের আত্মা।
জ্ঞান কেবল অভিজ্ঞতার প্রতিবিম্ব নয়। জ্ঞান হচ্ছে অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টি, মন ও হৃদয়ের সমন্বয়। অভিজ্ঞতা জ্ঞানের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান; কিন্তু তা একমাত্র ভিত্তি নয়। অভিজ্ঞতা পরিবর্তনশীল, ব্যক্তিগত এবং প্রেক্ষিতনির্ভর; তাই একমাত্র অভিজ্ঞতার ওপর স্থায়ী, সর্বজনীন ও নৈতিক জ্ঞান গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
জ্ঞানের স্থায়িত্ব ও সত্যের বহুমাত্রিকতা বোঝার জন্য মন এবং বোধশক্তির ভূমিকা অপরিহার্য। নৈতিকতা, গণিত, যুক্তি ও মূল্যবোধ ইত্যাদি অভিজ্ঞতার সীমার বাইরে অবস্থান করে। ভাষা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটও অভিজ্ঞতার সীমা ছাড়িয়ে যায়; অর্থ এবং সত্যের ধারণা তৈরি হয় অভিজ্ঞতার বাইরে, সামাজিক ও মানসিক কাঠামোর মধ্যে।
অতএব, জ্ঞান মূলত বহুস্তরী : অভিজ্ঞতা দেহের চোখ, যুক্তি বোধের আলো, হৃদয় অন্তর্দৃষ্টির প্রদীপ। এই সমন্বয়ই মানুষের জন্য স্থায়ী, প্রামাণ্য ও নৈতিক জ্ঞানার্জনের পথনির্দেশ করে। কিন্তু তার ওপরে আছে ওহি; বিশ্বব্যবস্থার স্রষ্টা ও পরিচালকের প্রজ্ঞা। জীবন ও জগতকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সৃষ্টির নীতিমালাই জীবন ও জগতের সবচেয়ে নিশ্চিত ও স্থায়ী জ্ঞান। বিশ্বব্যবস্থা ও মানবনিখিল পরিচালনার তাঁর নীতি ও আইনগুলো নিখিলের সর্বত্র প্রতিফলিত ও অনুরণিত হচ্ছে। সেই আইন ও নীতিগুলোর সাথে পরিচয় আমাদেরকে নিশ্চিত সত্যের ঘনিষ্ঠ করে। এর সাথে যুক্তি, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, মনন ও হৃদয়ের সম্মিলনে আমাদের জ্ঞানদৃষ্টি পূর্ণতা পেতে পারে, আমাদের সত্য ও ন্যায়ের দিশা দেখাতে পারে।
লেখক : কবি, গবেষক



